লতার লাল জামা

লতার লাল জামা
লতার লাল জামা
রুদ্র মুহম্মদ আনারুল
শহরের জুরাইন রোডের শেষ মাথার সরু গলির শ্যাওলা ধরা আমগাছটার নিচের টেনশেডের বাড়িটা লতাদের। বাড়ি বলতে একটা থাকার ঝুপড়ি ঘর,আর একটা ঘরের একপাশে দুটা ছাগল আর একটা গরু থাকে আরেকপাশে রান্নাঘর। দুবছর হলো লতার মা মারা গেছে। বাবাও বিয়ে করতে দেরি করলো না। লতার নানি লতাকে নিয়ে যেতে চাইলে তার বাবা বলে, ও এখানেই থাকবে।
লতার নতুন মা প্রথম কয়েকদিন ভালো ব্যবহার করলেও এখন লতাকে একটুও সহ্য করতে পারে না। প্রতিরাতে লতার নামে তার বাবার কাছে সৎ মা মিথ্যা নালিশ করে। ও পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলে। বাড়িতে থাকে না। কিছু বললে একদম ভ্রুক্ষেপ করে না। আরও নানারকম কথা বলে লতার নামে। লতার বাবা এসব শুনে খুব রেগে যায়। সকালে কান কচলে দেয়। হাটু গেড়ে বসিয়ে রাখে।
তার বাবার একটা ঝালমুড়ির দোকান আছে শহরের পৌর পার্কে। সামান্য আয়ে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। লতা বাড়ির পাশের একটা এনজিও এর স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বেতন নেই বরং ক্লাস শেষে সাদা ভাত, ডাল ও ডিম খাওয়ায়। সপ্তাহে একবার মাংস।
লতার উপর তার সৎ মার অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলছে। রাতে খাবার খুব সামান্য দেয়। সকালে সন্ধ্যায় ও দুপুরে বাসনগুলো পরিস্কার করিয়ে নেয়। গালি দেয়, মারপিট করে। একদিন লতার হাত থেকে টিউবওয়েলের একটা ইটের উপর  একটা গ্লাস হাত ফসকে পড়ে ভেঙে যায়। গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনে লতার সৎ মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। লতাকে একটা জোরে থাপ্পড় দেয়। কানের মধ্যে লাগে। লতা পড়ে যায়। সেদিন রাতে লতার খুব জ্বর আসে। মনে হচ্ছে তার শরীর একটা চুলায় পরিণত হয়েছে আর তাতে কেউ রান্না করছে। এমন জ্বর লতার কখনো হয়নি। জ্বরের প্রকোপে  মা মা বলে আওয়াজ করে লতা। রাতে স্বপ্নে দেখে তার মা তাকে নিতে এসেছে। সাথে হরেকরকম খাবার ও খেলনা।  সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে খুব কষ্ট হয় লতার। শরীরে ব্যথা। এখন কানেও একটু কম শুনতে পায় লতা।
লতার বাবা সকালেই বেড়িয়ে পড়ে। লতা খুব কষ্ট পায়। আম গাছটার নিচে বসে কান্না করে। তার জ্বর অথচ বাবা একবারও কাছে আসলো না। ঔষধ আনলো না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে লতা। লতাদের বাড়ির উত্তর দিকে রাহেলাদের বাড়ি। রাহেলার বাবা তার জন্য একটা লাল জামা এনেছে । দেখতে খুব সুন্দর। জামাটা পড়ে রাহেলা বিকেলে সবাইকে দেখাচ্ছিল। রাহেলার বাবা শহরে একটা ফ্যাক্টরিতে লেবারের কাজ করে। লতা জিজ্ঞেস করে, কোথা থেকে—কত নিয়েছে জমাটা? রাহেলা হাত নাড়িয়ে জবাব দেয় সাতশো টাকা!  লতা মুখ কালো করে বাড়ি ফিরে। সন্ধ্যায় বাসন মাজতে মাজতে ভাবে বাবাকে বলবো একটা লাল জামা কিনে দিতে। তখন আমিও সবাইকে দেখাবো। সবার আগে রাহেলাকে দেখাবো। কী ভাবটা না দেখালো আমাকে।
রাতে বাবা আসা অবধি জেগে থাকে লতা। রাত ৯টায় ঘরে ফিরে তার বাবা। বাবা খেতে বসলে লতা ভয়ে ভয়ে তার বাবার ঘরে ঢুকে।
–কী লতা এখনো ঘুমাওনি কেন?
–বাবা আমায় একটা লাল জামা কিনে দিবে?
লতার বাবা চোখ বড় করে লতার দিকে তাকায়। ওর সৎ মা হুংকার দিয়ে বলে খাওয়া জুটে না আর জামা। লতার বাবা বলে জামা টামা এখন হবে না। ঈদে একটা কিনে দিবো।
লতা ঘুমানোর আগ পর্যন্ত খুব কান্না করে। আজ তার মা বেঁচে থাকলে। এমন কষ্ট করতে তাকে হতো না। তার মনে পড়ে একদিন স্কুল ছুটির পর খুব ঝড় শুরু হয়। চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। সেই সাথে প্রচন্ড গতির বাতাস,মনে হচ্ছিল ঘরের চালা, রাস্তার ধারে রাখা গাড়িগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই ঝড়ে লতার মা লতাকে নিতে আসে। লতাকে পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। লতাও ভয়ে খুব কেঁদে ছিলো।
লতাদের স্কুল করোনার জন্য বন্ধ। তবে রোজ বিকেলে ক্লাসের মহেশ,রাজু,মিতার সাথে দেখা হয়। ওদের কেউ ফুল বিক্রি করে। কেউ বোতল কুড়ায়। রাজু একটা চায়ের দোকানে কাজ করে। প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকা পায়।
লতা বাড়ি আসে। রাতে ভাবতে থাকে আমিও রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করবো। একটা লাল জামা নিবো। আর টাকা বাঁচলে একটা পুতুলও কিনবো। মেয়ে পুতুল। আজ রাতেও লতা স্বপ্নে দেখে তার মা তাকে নিতে এসেছে। সাথে লাল জামাটাও নিয়ে এসেছে।
–লতা,চল আমার সাথে। এখানে তুই মেঘের সাথে খেলতে পারবি। যা ইচ্ছে খেতে পারবি। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবি। আয় লতা আমার সাথে আয়।
–মা আমি তোমার সাথে যাবো। এখানে আমার খুব কষ্ট হয়। খেতে দেয় না। আর খুব মারধর করে।
লতার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরের ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আলো আসছিলো। মনে হচ্ছে সূয্যি মামা টর্চ মারছে তার বিছানায়। লতা তার সৎ মাকে বলে আমি ফুল বিক্রি করবো। কিছু টাকা দিবে? লতার মা খুশি হয়। সংসারে বাড়তি আয় হবে। কিন্তু সে একবারও ভাবে এতটুকু মেয়ে কেন ফুল বিক্রি করবে। কত টাকায় বা আয় করবে। এখন তো তার পড়ার সময়। লতার সৎ মা ত্রিশ টাকা দেয়। সাথে শর্ত দেয় সন্ধ্যায় টাকা ফেরত দিতে হবে।
লতা ফুল কিনে মিতার সাথে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে। মিতা করোনার শুরু থেকেই ফুল বিক্রি করতো। কোন মানুষগুলো ফুল কিনতে পারে। কোন মানুষগুলোকে অনুরোধ করে ফুল বিক্রি করতে হয় সব শিখিয়ে দেয় মিতা লতাকে। প্রথম দিনে লতা একশো টাকার ফুল বিক্রি করে। বাড়িতে আসলে তার সৎ মা সব টাকা নিয়ে নেয়। লতা টাকাগুলো দিতে চায় না। লতাকে চড় দেয় আর বলে প্রতিদিন টাকা জমা দিবি না হলে পিটের চামঠা তুলে নিবো। রাতে লতার বাবাকে লতার সৎ মা টাকার লোভ দেখায়। সব ছেলে–মেয়ে আয় করছে লতা কেন বসে থাকবে–সেও আয় করুক। লতার বাবা রাজি হয়।
আজ লতা কয়েকটা গোলাপ আর রজনীগন্ধা কিনে বিক্রি করেছে পৌর মার্কেট আর শহরের চায়নিজ রেস্টুরেন্টের সামনে। আজকেও তার সৎ মা সবটাকা জোর করে নিয়ে নেয়। লতা খুব কান্না করে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করে শুধু  একটা  লাল জামা কেনার জন্য । অথচ সব টাকা নিয়ে নেয়। বাবাও কিছু বলে না। সেদিন রাতে সে বুদ্ধি করে কিছু টাকা লুকিয়ে রাখবে। প্রতিদিন অল্প করে রাখবে আর সাতশো টাকা হলে মিতাকে নিয়ে বাজারের কাপড়ের দোকানগুলোতে গিয়ে একটা টকটকে লাল জামা কিনবে। এসব ভাবতে ভাবতে লতা ফুল বিক্রি করার কষ্ট, বাসন মাজার কষ্ট ভুলে যায়।
লতা এখন জানে কোথায় ফুল বেশি বিক্রি হয়। কে ফুল কিনতে পারে। কার কাছে ফুল বিক্রি করার আবদার করতে হয়। আজ সে নজরুল এভিনিউ এর সামনে ফুল বিক্রি করে। এখানে কিছুক্ষুণ পরপর জাম লাগে। জামের কারণে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোতে ফুল বিক্রি হয়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত কারগুলোতে। ট্রাফিক বক্সের পিছনের একটা সাদা গাড়ির জানালা থেকে মাথা বের করে একজন মেমসাহেব লতাকে ডাক দেয়। লতা এই মেমসাহেব কে চিনে। প্রথম দিন লতার কাছ থেকে ফুল নিয়েছিলো। এতটুকু মেয়েকে ফুল বিক্রি করতে দেখে অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিলো। কোথায় থাকে?বাড়িতে কে কে আছে?,পড়ালেখা করছে কিনা?লতা মেমসাহেবর গাড়ির দিকে দ্রুত যেতে থাকে। এমন সময় পিছন থেকে একটা কার লতাকে ধাক্কা দেয়। লতা ছিটকে পড়ে ফুটপাতের লোহার ডিভাইডার । মাথা থেকে রক্ত ঝরে। পুরো শরীর  রক্তে ভিজে যায় । চোখ বন্ধ হয়ে আসে লতার।সে দেখতে পায় তার মা একটা টকটকে লাল জামা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর বলছে,লতা এই যে তোর লাল জামা। আয় আমার কাছে আয়।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত