খুব একটা গভীর রাত নয় তবে ঘন আঁধারে ভরে গেছে সবকিছু। চাঁদ যেন ইচ্ছে করেই দেখা দেয় নি এ রাতে। এমন রাতে আবার আঁধার এর সাথে সন্ধি করেছে তীব্র কুয়াশা। তবে এতে ও ক্ষান্ত হয় নি নিষ্ঠুর প্রকৃতি, এদের সাথে আবার শীতল হাওয়া এসে যুক্ত হয়ে গেছে। ভীতিকর এক পরিবেশ, এমন আঁধারে নিজের নিশ্বাস এর গরম হাওয়াকেও ভূতের ইংগিত বলে মনে হয়। আর এ শীতল হাওয়া যেন মানবদেহের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রকৃতির তাপমাত্রা অস্বাভাবিক, তাপমাত্রা সাধারণ এর থেকে অনেকখানি কমে গেছে। সবমিলিয়ে প্রকৃতি যেন এক ধারালো অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ স্বাভাবিক ভাবেই এই অস্ত্রের সম্মুখীন হওয়ার ইচ্ছে কারোরই নেই, তাই শীতের কাপড় পড়ে গরম বিছানায় শুয়ে লেপ,কাঁথা,কম্বল গায়ে দিয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকে। তবে রক্ষা পেতে চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না ঢাল তো আর সবার থাকে না। আজ এই রাতে রেললাইন এর উপর হালকা কাপড় বিছিয়ে শুয়ে থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে ছোট্ট ছেলে প্যাটলা। দেহের তুলনায় ওর পেট বড় হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে এই নাম দিয়েছে। পঁচা-বাসি খাবার খেয়ে ওর পেটের এই দশা। বয়স বড়জোর ৮বছর হবে। ওর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই ও তাদেরকে দেখেও নি কখনো। বস্তিতে এক বুড়ি-মার কাছে ছিল প্যাটলা। বছর দুয়েক আগে ওর বুড়ি-মা মারা যায়, এতে পুরোপুরি একা হয়ে যায় প্যাটলা। প্রতিদিন কাগজ, পলিথিন, বোতল কুড়িয়ে ভাংরির কাছে বিক্রি করে ৫-১০টাকা পেয়ে সেটা দিয়ে হালকা কিছু খেয়ে না খেয়ে পৃথিবীতে শুধু নিজের অস্তিত্ব টুকু ধরে রাখে প্যাটলা। ওর জামা-কাপড় বলতে শুধু একটা হাফ প্যান্ট আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর থাকার যায়গা রেললাইন। রেললাইন এর উপর কয়েকটা পলিথিন আর ছেড়া কাপড় বিছিয়ে রাত কাটায় প্যাটলা। গত কয়েক রাতে ঠান্ডা লেগে, না খেয়ে, অযত্নে অসুস্থ হয়ে পড়েছে প্যাটলা। ওকে দেখার মত কেউ নেই, ওষুধ সে তো দূরের কথা খোজ নেওয়ার মতো ও কেউ নেই। আজ ওর শরীর খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে। দুদিন ধরে কিছু খায় নি সে, জ্বরে দেহ পুরে যাচ্ছে , মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, পেটে ব্যাথাসহ নানাবিধ সমস্যা। অসুস্থ প্যাটলা যেন কথা বলার শক্তি ও হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে, দূর্বল হয়ে গেছে প্যাটলা। মৃত্যু যেন ওর কাছে চলে এসেছে। অসুস্থ প্যাটলার জ্বরের উষ্ণ মাথায় বারবার শুধু নানাবিধ প্রশ্ন জাগছে, “আমার জীবন কেন এমন হলো? গাড়িতে করে যে ছেলে-মেয়ে গুলো যায় ওদের মত কেন হলো না? আমার কেন বাবা-মা নেই? আমার কেন কাপড় নেই? আমার কেন খাবার নেই? আমি কেন বিছানায় ঘুমোতে পারি না? আমি কেন ওদের মত স্কুলে যেতে পারি না? আমাকে কেন কেউ আদর করে না? আমার কেন কেউ খোঁজ নেয় না? আমি কেন অন্যসব ছেলে-মেয়েদের মতো হলাম না? ” । প্যাটলার জ্বর ক্রমশ বাড়ছে, কুয়াশা পড়ে ওর উষ্ণ শরীরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, শীতল হাওয়া বুক চিরে প্রবেশ করছে দেহে। থরথর করে কাপছে অসুস্থ ছোট্ট ছেলেটি। প্যাটলার এ অবস্থার জন্য কে দায়ী,নিষ্ঠুর প্রকৃতি না কি নিষ্ঠুর সমাজ? আজ এই বিষন্ন রাতে মৃত্যুকে হার মানিয়ে পরের সকাল এর নতুন সূর্য দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগছে প্যাটলার মনে ৷ অসুস্থতা সাথে নিষ্ঠুর প্রকৃতি আবার নিষ্ঠুর সমাজ এত কিছুর সাথে যুদ্ধ করে নতুন সূর্য দেখার ইচ্ছে প্যাটলার হয়ত পূরণ হবে হয়তো বা হবে না। হয়তো নতুন সূর্য এর কিরণ জ্বরের কারণে উষ্ণ আর কুয়াশায় ভেজা শরীরে আলতো করে পড়বে নয়তো রাত পোহাবার পূর্বেই ছোট্ট ছেলেটি পৃথিবীর সাথে আঁড়ি নিয়ে পরপারে চলে যাবে।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প