সকাল থেকেই অনেক চিৎকার চেচামেচি হচ্ছে বাসায়, কারণ আমার বড় মেয়ের হাতের আংটিটা পাওয়া যাচ্ছেনা। আমার শ্বাশুড়িমা আংটিটা দিয়েছেন আমার মেয়েকে। উনি মালয়েশিয়া থেকে এনেছিলেন।প্রথমে আমার মেয়েটাকেই দুই চার ঘা বসিয়ে দেওয়া হলো, আংটি কি করেছে এটা জানার জন্য। তারপর যেহেতু বাসায় কোন কাজের মেয়ে নাই, আর বাহিরের লোক বলতে আমার আব্বা আম্মা ছাড়া আর কেউ নাই, তাই আব্বা আম্মার ব্যাগ চেক করা হলো দুই দফায়।
কিছু না পাওয়া যাওয়াতে আব্বার পকেট আর ওষুধের বক্স চেক করা হলো, এমনকি আমার আম্মার পানের পাত্রও বাদ গেল না। কিছু না পেয়ে সবাই একটু হতাশ হলো মনে হচ্ছে। আব্বা আম্মার গ্রামে ফিরে যাবার জন্য আজকে রাতের টিকেট কাটা হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে এমন হবার পরে আব্বা আম্মা কেউই সারাদিন কিছুই মুখে দিলোনা। আব্বা কাদতে পারছেন না,কিন্তু আম্মা একটু সময় পরপর কিছুটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাদছেন। আমার আব্বা অসুস্থ,খুব বেশি অসুস্থ। গ্রামের চিকিৎসায় খুব একটা উন্নতি হচ্ছেনা বলা যায়। বাধ্য হয়েই শহরে এনে আমার বাসায় রাখতে হয়েছিলো আব্বা আম্মাকে। আসলে ভুল বললাম আমার বাসা না, আমার শ্বশুড়ের বাসা। আমার বিয়ের ১৮ বছর হলো। ২ কণ্যা সন্তানের জননী আমি,স্বামী সরকারি চাকুরিজীবী। আমি বাদে,দুই জা,এক ননদ আর শ্বশুর শাশুড়ী মিলে বেশ বড় পরিবার আমার শ্বশুরবাড়ির। আব্বা আম্মা আসাতে বেশ অসুবিধে হয়েছে সবারই। যদিও আমার আব্বা আম্মাকে আলাদা কোন রুম দেওয়া হয়নি থাকার জন্য।
আমাদের টিভির রুমের ডিভানটা বেশ চওড়া ওখানেই ম্যানেজ করে নেন ওনারা দুজনেই। আমার বাবা মা আবার ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে বেশ পারদর্শী। আমার আব্বা একটা ছোট্ট মুদির দোকানের মালিক ছিলো, ছোট থেকেই ঐ এক দোকানের উপর দিয়েই আমাদের ৪ সদস্যের সংসার বেশ ভালো ভাবেই চলতো। গ্রামের কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে আমি যখন ডিগ্রীতে ভর্তি হলাম। তখন আমার শ্বশুর আমাকে পছন্দ করে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। বিয়ের সময় আমার সরকারি চাকুরিজীবী স্বামীকে বেশি না মাত্র ৫লক্ষ টাকা দিতে হয়েছিলো, ২০০২ সালের বাজারে একটা ছোট্ট মুদি দোকানদার ৫ লক্ষ টাকাও ম্যানেজ করে নিয়েছিলেন খুব ভালো ভাবেই। যদিও আমার জায়েরা তাদের বাবার বাড়ি থেকে যা যা এনেছেন, তার কাছে আমার এই ৫লক্ষ টাকা অতি নগন্য।এ নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি আমাকে এ বাসায়। শুধু মাত্র বাবার বাসা থেকে কম টাকা এনেছি আর নিজের কোন আয়-রোজগার নেই জন্যেই এ বাসায় আমার ভাগের কাজের পরিমাণ বেশি আর খাবার পরিমাণ কম।
আমার শ্বাশুড়িমা বলেন যে রাধে, তাকেই বেড়ে খাওয়াতে হয়। আর যে বেড়ে খাওয়ায়, তাকে সবার খাওয়া শেষে খেতে বসতে হয়। এ বাসার রান্না আর খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার আর বাকি সব সেল্ফ সার্ভিস। মানে নিজেরা নিজেদের কাপড় ধুবে, নিজেদের ঘর পরিষ্কার করবে,নিজেদের বাসন মেজে রাখবে। যদিও সকালের নাস্তাটায় আমার ছুটি;ওটা আমার বড় জা তৈরি করেন। আর ছোটজন চাকুরিজীবী তাই তার সব কিছুতেই মাফ। আমার ননদ ভার্সিটিতে পড়ে,পড়াশুনার যেন ক্ষতি না হয় তাই তাকে সব কাজ থেকে যোজন যোজন দূরে রাখা হয়। আব্বা আম্মা আসায় খরচের পরিমাণ বেশ বেড়ে গেছে, এক্সট্রা খাবার খরচ,এক্সট্রা সাবান,পানি, বিদ্যুৎ খরচ এসবে বেশ বিরক্ত আমার স্বামী। গত কিছুদিন আগে শোবার সময় বেশ রাগ নিয়েই বলেছিলো- “মিলি আজ ৮দিন হলো তোমার বাবা মা এ বাসায় পড়ে আছেন, তোমার সাথে কি এখন ওদের দায়িত্বটাও নিতে হবে আমাকে?
৫লক্ষ টাকায় তোমাকে ১৮ বছর ধরে খাওয়াচ্ছি, এখন কি পরিবারের বাকি সদস্যদেরকেও পুষতে হবে,মিশুকে বাদ রাখছো কেন ওকেও ডেকে নাও।” মিশু আমার ছোট বোন। আমি কোন উত্তর না করে আমার মতন কাজ করছিলাম। এতে হয়ত সাব্বির বেশিই বিরক্ত হলো, তাই একটু চিৎকার করেই বললো- “তোমার বাবা মাকে মিশুর বাসায় পাঠাচ্ছোনা কেন?” এবার বাধ্য হয়েই বললাম- “আব্বা যে ডাক্তারকে দেখান উনি তো ঢাকার, তাই তার কাছে চিকিৎসা নিতে আব্বা আম্মা ঢাকাতেই থাকতে হবে। খুলনায় মিশুর বাসায় গিয়ে কি করবেন?” সাব্বির উত্তর করলো-“তুমি প্লিজ ডাক্তার বদলাতে বলো তাদের। অন্যের ঘারে বসে চিকিৎসা করার ধান্দা বাদ দিতে বলো এ বয়সে।” আমি হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আব্বাকে তো চিকিৎসার কোন টাকাই দিচ্ছেনা ও শুধু ওর বাসায় আছে বলেই এত বড় কথাটা বলে দিলো কি সহজেই।
আমার আব্বা তো ডাক্তার দেখানো শেষে প্রত্যেকদিন এই বাসার মানুষ গুলোর জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন।
প্রথম ২/৪দিন আব্বা আম্মাকে সবাই একটু আদর যত্ন করলেও, গত কিছুদিন থেকে কেউ কথাই বলছেন না। কারণ গত কয়েকদিন আব্বা আম্মা খালি হাতেই ফিরেছেন, তার জন্যেই কি সাব্বিরও আব্বাকে ধান্দাবাজ বলবে! আব্বা আম্মাও বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, তাদের এ বাসায় থাকাটা কারোর পছন্দ হচ্ছেনা আর। বিকেলের নাস্তাটাও এখন দেওয়া হয়না ওনাদের। কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কি না, এটাও কেউ আর জিজ্ঞেস করছেনা; কিংবা আব্বার শরীরটা কেমন যাচ্ছে কেউ জানতেও চায়না। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে বেশ খরচ হচ্ছে আব্বা আম্মার। আব্বার কিডনির সমস্যা ধরা পড়েছে এখন থেকে এক দেড় বছর আগে। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ব্যবহার,সাব্বিরের আচরণ, আব্বার অসুস্থতা সব কিছু মিলিয়ে আমি বেশ অসহায় হয়ে গেছি।
এই লক ডাউনে আবার, আমার ভাসুর আর দেবরের বেতনও অর্ধেক হয়ে গেছে। গত পরশু আম্মা আমাকে ডেকে শুধু বললেন- “মিলি তোর বাবার শরীরটা আগের থেকে অনেক ভালো, আমরা আসার তো ২ সপ্তাহ হয়ে যাইতেছে এবার গ্রামে ফিইরা যাই।” আমি শুধু মাথা নাড়ালাম কারণ তাদের আটকাবার ক্ষমতা আমার নাই আর আমি জানি, তাদের চিকিৎসা করাবার সামর্থ্যটাও আর নাই। সেদিন রাতে সাব্বির কে অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝালাম, মা বাবার ফেরার টিকেটটা যেন অন্তত করায়। আজকে এতকিছুর পরে রাতে যখন আব্বা আম্মা ফিরে যাবেন কেউ তেমন একটা সৌজন্যবোধ দেখালোনা,আব্বা আম্মা বের হাবার সময় আমার মেয়ে দুটো আম্মার কোমড় জড়িয়ে কাঁদছিলো, আমি চুপ করে আম্মার হাতে পুটলি করা ৮হাজার টাকা ধরিয়ে দিলাম, আম্মা কোন ভাবেই সেটা নেবেন না। একপ্রকার জোড় জবরদস্তি করেই দিলাম। আব্বা আম্মা চলে গেলেন।
আমি বেশ অনেকটা সময় সিড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, বাসার পরিবেশটা বেশ থমথমে, বড় মেয়েটার রুমে ঢুকলাম, কেমন সংকোচ হচ্ছে,ও নিজেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো এবার আর পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে, হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম, শুধু কোনমতে ফিসফিস করে বললাম,সরি মা,আমাকে মাফ করে দিও প্লিজ। আমি আংটিটা নিতাম না,তোমার আম্মু অনেক অসহায় মা, আমি নতুন আংটি বানিয়ে দেবে যে কোন ভাবেই প্রমিস। মেয়েটাও কেমন আমার বুকে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প