মায়ের সংগ্রাম

মায়ের সংগ্রাম
মাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিলেন আমার বড় চাচা আর ফুফুরা। বাবার মৃত্যুর দশদিনের মাথাতেই যে তিনি শ্বশুর বাড়ির অধিকার হারাবে তা কখনোই ভাবতে পারেননি। আমার বয়স তখন সবে দুবছর। আমি কিছু না বুঝলেও মায়ের কষ্টটা আঁচ করতে পেরে অজস্র ধারায় কান্না করেছিলাম। মা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে আমাকে নিয়ে নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।
আমার নানা মাকে বের করে দেওয়ার কথা শুনে তৎক্ষনাৎই পুলিশ নিয়ে দাদাবাড়িতে উপস্থিত হন। কিন্তু একটা সময় পুলিশও চাচাদের থেকে টাকাকড়ি পেয়ে উল্টো পথে মোড় নিলো। একরকম নিরুপায় হয়েই মা আমাকে নিয়ে নানাবাড়িতে থাকা শুরু করলেন। মা তখনো যথেষ্ট যুবতী থাকায় নানা দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে লাগলেন। কিন্তু মা আমাকে রেখে কখনোই দ্বিতীয় বিয়ের পক্ষে ছিলেন না।বুঝতে পারলেন যে তিনি বাবা ভাইদের নিকট একটি মূল্যহীন বস্তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। একসময় নানা বলেই ফেললেন যে বিয়ে না করলে তার বাড়িতে জায়গা নেই।
যখন চাচারা অর্ধচন্দ্র দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন তখনও এতোটা কষ্ট পাননি যতটা পেয়েছিলেন নানার কথাতে। একজন বাবা হয়েও অসহায় মেয়েকে এমনটা বলতে পারলো? এসব ভাবতে ভাবতে ফের আমাকে নিয়ে ঘর ছাড়লেন অজানার উদ্দেশ্যে। একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্ত্রী আর মেয়ে হয়েও যে এভাবে থাকতে হবে তা তিনি কখনোই হয়তো ভাবতে পারেননি। নিজের সম্মানকে পিষে ফেলে শুরু করলেন মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ। আমিও বড় হতে শুরু করলাম এক নিম্নবিত্ত পরিবারের মতোই। কিন্তু আল্লাহ হয়তো আমার এই হাজারো কষ্টসমৃদ্ধ জীবনের মধ্যেও আমার মেধার পরিধিটা একটু বাড়িয়েই দিয়েছিলেন। মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই একটি কথা বলতেন,
-কখনো অহংকার করবি না আর মিথ্যা কথাও বলবি না। মায়ের সেই উপদেশটা আমি আজও পর্যন্ত ভঙ্গ করিনি। ক্লাসের ফার্স্টবয় হবার ফলস্বরূপ শিক্ষকদের মধ্যমণি ছিলাম আমি। আমার মা স্কুলে যখন আমার খোজখবর নিতে আসতেন তখন তিনি কখনোই একজন কাজের বুয়ার বেশ ধরে আসতেন না। কারণ তিনি খুবভালো করেই জানতেন তিনি যদি কাজের বুয়ার রূপ ধরে আসেন তবে অন্যান্য শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরা আমাকে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে কটুকথা বলতে পিছপা হবেনা। স্কুল লাইফে যখন প্রথমবার একটি মেয়ে আমাকে প্রোপোজ করে তখন সেই কথাটি আমি মাকে বলতে দ্বিধাবোধ করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করতাম যে এই পৃথিবীতে একমাত্র বেষ্টফ্রেন্ড হলেন আমার মা। মা সেদিন আমাকে একটি কথাই বলেছিলেন,
-নিম্নবিত্তদের প্রেম করা মানে জীবনের অর্ধেকটা ধ্বংশ করে দেওয়া। মায়ের সেই উক্তিটির জন্য জীবনে কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করিনি। কারণ মাকে অমান্য করার সক্ষমতা তৈরি হয়নি আমার আজ যখন জীবনের প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে মায়ের শাড়িটা কিনলাম তখন আমার হৃদয়ের অলিন্দ আর নিলয় গুলো এতোটাই স্পন্দিত হচ্ছিল তার শব্দ পাশে থাকা মানুষটাও হয়তো শুনতে পাবে। দোকানদার আমার এরূপ অবস্থা দেখে বললো,
-ভাই, কিছু হয়েছে? দোকানদারের কথায় কেনো যেনো চোখটা ভিজে এলো।
-না ভাই, জীবনের প্রথম বেতন দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছিতো তাই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। দোকানদার আমার কথা শুনে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-গুড লাক ভাই। শুনে ভালো লাগলো। আপনাকে হাফ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিলাম খুশি হয়ে।
কথাটা শুনে ভাবলাম জীবনের সব সুখ বোধহয় একত্রেই আসে? আমি আর একমুহূর্ত দেরী না করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মায়ের হাতে শাড়িটা দিতেই মা কোনো ভূমিকা না করেই আমায় জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন। আমি জানি এটা এক প্রাপ্তির কান্না যেই প্রাপ্তির সান্নিধ্যে আসতে যুগ যুগান্তর অপেক্ষা করতে হয়। আমি হয়তো মায়ের সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ করতে পারবোনা কিন্তু জীবনের শেষ অবধি মায়ের পদতলে থাকতে চাই। তবেই কেবল জীবনের সার্থকতা খুজে পাবো।
এটা কোন কল্পকাহিনী নয় বরং ঢাকা ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য গল্প। মাকে নিয়ে এরকম হাজারো গল্প লুকিয়ে রয়েছে প্রতিটি সফলতার অন্তরালে। যার বৃহদাংশই আমাদের অজানা। মোটকথা মাকে ভালোবাসুন কারণ পৃথিবীর একমাত্র পবিত্র ভালোবাসার শ্রেষ্ট নিদর্শন সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা। যা অস্বীকার করার ক্ষমতা একটি কুকুরেরও নেই।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত