এক রাজা সকাল-সন্ধ্যায় তার রাজপ্রাসাদের ছাদে হাটা-হাটি করতেন। রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়েই একটি মাটির পথ সোজা চলে গেছে ঐ দূরে গভীর বনে। রোজ সকালে সেই পথ দিয়ে একজন কাঠুরিয়া ঐ গভীর বনে কাঠ কাটতে যেত, বিকেল বেলায় ঐ পথটি ধরেই সে ফিরে আসত। রাজা তার রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে রোজ তা দেখতেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজা যখন সকাল বেলা কাঠুরিয়াকে দেখতেন তখন কাঠুরিয়া জন্য রাজা মনে খুব দয়ার ভাব দেখা দিত। কিন্তু সেই কাঠুরিয়াকেই বিকাল বেলায় রাজা যখন দেখতেন তখন তার মনে কাঠুরিয়ার জন্য এক হিংস্র ভাব দেখা দিত। রাজা ভাবতেন,” ইস! এই পাজিকে এখুনি ফাঁসি দেওয়া দরকার। এখুনি কয়েকশ চাবুক মেরে ওকে ঠাণ্ডা করা দরকার।”
এমনি করে দিনের-পর দিন চলতে লাগল। প্রতিদিন রাজার মনে সকাল-সন্ধ্যায় তেমনি ভাবের উদয় হতে লাগল। নিজের মনের এমন পরিবর্তনে রাজাও খুব অবাক, চিন্তিত। কিন্তু রাজা এর কোনও উওর পেলেন না। তাই একদিন তিনি মহামন্ত্রীকে সব খুলে বললেন। মহামন্ত্রী দুইদিন সময় চাইলেন।
পরের দিন সকালবেলা ছদ্মবেশে মহামন্ত্রী সেই কাঠুরিয়ার কাছে গেলেন, কথায়-কথায় তার সাথে খুব ভাব জমালেন, সারাদিন ওরা এক সাথে বনে-বনে অনেক ঘুরাঘুরি করলেন, বিকালে আবার ওরা ঐ পথ ধরে দু’জনে রাজধানীতে ফিরে এলেন। পরের দিনও তেমনটি হল।
দুদিন পর মহামন্ত্রী রাজার সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, “মহারাজ , আমি আপনার প্রশ্নের উওর খুঁজে পেয়েছি। কাঠুরিয়া সত্যি নির্দোষ। সে একজন অতি গরীব, সহজ, সরল কাঠুরিয়া। কঠোর পরিশ্রম করে, অতি কষ্টে নিজের সংসার চালায়। প্রতিদিন সে নিজের জীবন বিপন্ন করে সেই গভীর বনে কাঠ কাটতে যায়। সে যখন বনে কাঠ কাটতে যায় তখন মনে-মনে ভাবতে থাকে, ‘সারাদিনের জন্য বনে যাচ্ছি, কি-জানি আজ ভাল-শুকনো কাঠ পাবে কিনা! আজ ভাল লাকড়ি না পেলে তো ঘরের সবাইকে উপাস থাকতে হবে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কত কষ্ট পাতে হবে। না-না, আমাকে কঠোর পরিশ্রম করে ভাল কাঠ আনতেই হবে। আমার ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের আমি খালি পেটে থাকতে দেব না, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কষ্ট পেতে দেব না।'”
মহামন্ত্রী একটু থেমে বললেন, ” সেই কাঠুরিয়াই আবার বিকেল বেলায় যখন ঐ পথ ধরে ফিরে আসে, তখন সে মনে-মনে ভাবে, ‘ইস, ঘরে এতগুলি চন্দন কাঠ নষ্ট হচ্ছে, না-জানি কবে এই রাজা মরবে আর তার চিতা সাজাতে আমার চন্দন কাঠগুলির দরকার পড়বে। রাজবাড়িতে চন্দন কাঠগুলি বিক্রি করলে তো কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। তা দিয়ে আমার ছেলে-পুলেগুলি তো কয়েকদিন সুখে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবে। শালার রাজাও মরে না, আর আমার চন্দন কাঠগুলিও বিক্রি হয় না।'”
রাজা খুব মন দিয়ে মহামন্ত্রীর কথা শুনলেন। মহামন্ত্রী অতি বিনীত ভাবে বললেন,” মহারাজ, আমাদের মন একটা আয়নার মত। এতে অন্য মনের প্রতিবিম্ব অতি সহজেই তৈরি হয়। আমরা মনে-মনে যা ভাবি, সেই ভাল-মন্দের ছবি চারি পাশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে আর পরিবেশকে সেই মতন গড়ে তুলে। আর তেমনটাই আপনার সাথে হয়েছে। এই কাঠুরিয়া সকাল বেলার সহজ সরল ভাবনাগুলি আপনার মনে প্রতিফলিত হয়। আবার সেই কাঠুরিয়াই বিকেল বেলায় যখন নির্দয় ভাবে আপনার মৃত্যু কামনা করে, তখন তার সেই খারাপ ভাবনাগুলিও আপনার মনে প্রতিফলিত হয়। সেই কারণেই এক কাঠুরিয়া সম্পর্কে দুই সময়ে দুই রকম ভাবনা আপনার মনে আসতে থাকে।”রাজা সব বুঝতে পারলেন। পরদিনই তিনি কাঠুরিয়াকে ডেকে পাঠালেন আর তার সব চন্দন কাঠ সঠিক দামে কিনে নিলেন।