বহু আগের কথা। এক দরিদ্র কৃষক ছিল ব্রজলাল। সে সারাদিন ক্ষেতে-খামারে খুব পরিশ্রম করত। তার একটাই লক্ষ্য, একমাত্র ছেলে শোভমকে ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। শোভম পড়াশুনাতে খুব ভাল, গান ও গাইত খুব। যেমন সুন্দর ছিল তার গলা, তেমনি সুন্দর ছিল তার গায়কী; যেন ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা। এমন প্রতিভা লক্ষ্য-কোটিতে কারো-কারোর হয়।
ব্রজলাল ভেবেছিল, শোভম বড় হয়ে রাজসভায় স্থান পাবে, মা-বাবার দুঃখটা ঘোচাবে। কিন্তু হল বিপরীত, ঘড়ি চলতে লাগল উল্টো। শোভম সব কিছুতেই খামখেয়ালি শুরু করল। না সে ঠিক ভাবে পড়াশুনা করত, না গানের রেওয়াজ করত। অনেক আদর, খোসামোদ, রাগ, ভয় দেখিয়েও তাকে পথে আনা গেল না। এত বড় প্রতিভা দিনে-দিনে ধ্বংস হতে লাগল। নিজের ছেলের এমন পরিণতি ব্রজলাল সহ্য করতে পারল না। একদিন সে তার গুরুদেবের তপোবনে গিয়ে গুরুর কাছে নিজের মনের জ্বালা সব খুলে বলল। গুরুদেব, শোভনকে তপোবনে নিয়ে আসতে বললেন।
কিছুদিন পরে ব্রজলাল একদিন শোভমকে সাথে নিয়ে গুরুদেবের তপোবনে হাজির হল। গুরুদেব শোভমের কাছে একটি গান শুনতে চাইলেন। শোভম গান ধরল। শোভমের গান শুনে গুরুদেব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি মনে-মনে ভাবতে লাগলেন, “না, এই ছেলে তো সাধারণ ছেলে নয়। অত্যন্ত প্রতিভাধর এক রত্ন। রাজসভার গায়ক হবার ক্ষমতা রেখে ও। ও তো রাজ্যের সম্পদ, দেশের সম্পদ। ওকে মোটেই এ ভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতেই হবে, তা না হলে ঈশ্বরের এমন মহান এক সৃষ্টির অপচয় হয়ে যাবে। না-না, তা কখনোই হতে দেওয়া যায় না।”
গুরুদেব, ব্রজলালকে বললেন, “তোমার ছেলেকে কিছুদিন আমার কাছেই থাকুক। ওকে কিছুদিন এই তপোবনেই রেখে যাও।” শোভম তপোবনে রয়ে গেল। গুরুদেব তাকে নিয়ে রোজ সকাল-সন্ধ্যায় সমগ্র তপোবনটা ঘুরে বেড়াতেন। তপোবনের এক কোনে ছিল অনেকগুলি পায়রা। গুরুদেব তাদের খাবার দিতেন। গুরুদেব এলেই পায়রাগুলি উড়ে এসে গুরুদেবের হাত বসে শস্য-দানা খেত। কয়েকদিনেই গুরুদেব লক্ষ্য করলেন, শোভম এই পায়রাগুলিকে ভালবেসে ফেলেছে। সুযোগ বুঝে তিনি শোভমকে পায়রাগুলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, “এই দেখো, এই পায়রাগুলি হল গিরিবাজ। এদের একটি বিশেষ একটি গুন আছে,” বলেই তিনি কয়েকটি হাততালি দিলেন।
গুরুদেব হাততালি দিতেই দুটি গিরিবাজ উড়ে গেল আকাশে। ওরা গোল-গোল চক্কর কাটতে-কাটতে মেঘের ওপারে চলে গেল। তাদের আর দেখা গেল না। কিছুক্ষণ পরে পাখি দুটি আবার নীচে নেমে এল, গুরুদেবের হাতে। শোভম বেশ অবাক হল, খুব ভাল লাগল তার। তার এই ‘ভালোলাগা’ গুরুদেব ঠিক লক্ষ্য করলেন। তিনি রোজ শোভমকে ঐ যায়গায় পাখিগুলির সামনে নিয়ে আসতে লাগলেন। কয়েকদিন পরেই গিরিবাজগুলি শোভমের ইশারাকেও বুঝতে শুরু করলো। একদিন শোভম হাততালি দিতেই গিরিবাজগুলি আকাশে উড়তে লাগল, আর দেখতে-দেখতে মেঘের উপরে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার নীচে নেমে এল, শোভমের হাতে। শোভমের খুব ভাল লাগল, সে খুব আনন্দিত হল। এমনি চলতে লাগল কিছু দিন।
যথা সময় দেখে গুরুদেব নিজের খেলা খেললেন। একদিন শোভম ঘুম থেকে উঠে দেখল গিরিবাজগুলিকে একটি খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সে এক শিষ্যের কাছ থেকে জানতে পারল, গুরুদেবের আদেশেই পাখীগুলিকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। গুরুদেবের কঠোর নির্দেশ, পাখীগুলিকে যেন কোনও ভাবেই মুক্ত করা না হয়। পায়রাগুলির এই অবস্থা দেখে মনে-মনে খুব দুঃখ পেল শোভম। সে এই ঘটনার কারণ জানতে গুরুদেবের সাথে দেখা করতে চাইল। কিন্তু গুরুদেব তার সাথে দেখা করতে মানা করে দিলেন। মন মরা হয়ে সারাদিনটা কাটল শোভমের। সে একটু পর-পরেই গুরুদেবের সাথে দেখা করার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু প্রতিবারই তাকে গুরুদেবের আশ্রমের দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। শোভম আত্মমন্থন শুরু করল, কী এমন ভুল সে করছে যে, গুরুদেব তার সাথে দেখা পর্যন্ত করতে চান না, অথচ কাল পর্যন্ত তো সব ঠিক ছিল! পরের দিনও একই অবস্থা। তারপর দিনও এক।
গিরিবাজগুলিকে সেই খাঁচা থেকে আর মুক্ত করা হয়নি। গুরুদেবের আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা সেই তপোবনে কারোর ছিল না। মনের যন্ত্রণায় আর থাকতে না পেরে গুরুদেবের সাথে দেখা করার জন্য অধীর হয়ে উঠল শোভম। সঠিক মুহূর্তে গুরুদেব দরজা খুলে বের হয়ে এলেন আর শোভমের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
গুরুদেবকে সামনে দেখে, গুরুদেবের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়াল শোভম। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, “গুরুদেব! আমার সাথে আপনি দেখা করতে চান নি, তাতে আমি বিন্দু মাত্র কষ্ট পাই নি। কিন্তু আপনি এই নিরীহ পায়রাগুলিকে কেন এমন ভাবে খাঁচার মধ্যে বন্দি করে রাখলেন? পায়রাগুলি কত কষ্ট পাচ্ছে, কত যন্ত্রণা হচ্ছে তাদের? ওদের কান্না কী আপনি শুনতে পান নি? ঐ দেখুন, অন্য পায়রারা তাদের দেখে হাসছে, তাদের উপহাস করছে, অথচ এখানে এমন কোনও পায়রা নেই যারা এই পায়রাগুলির উড়ানের সামনে টক্কর দিতে পারে। শুধু আপনার জন্য ওরা এমন কষ্ট পাচ্ছে, এমন উপহাসের পাত্র হচ্ছে; এ আপনার কেমন অন্যায় আচরণ গুরুদেব?
শোভমের কথা শুনে গুরুদেব মিটিমিটি হাসলেন, তারপর অতি স্নেহের স্বরে বললেন, “বৎস, তুমি এই পায়রাগুলির কথাই ভাবছ, অথচ নিজের দিকে একবার চেয়ে দেখলে না? আমি এই পায়রাগুলির কথাও ভাবছি আবার তোমার কথাও ভাবছি। তুমিও তো আমার মতই একই অন্যায় করে যাচ্ছ, অথচ তুমি দেখতে পাচ্ছ না। তুমিও এই পায়রাগুলি থেকে আরও দুর, আরও উঁচু উড়ান ভরতে সক্ষম, অথচ তুমি নিজেই নিজেকে বন্দি করে রেখেছ। আমি নিশ্চিত, এই রাজ্যে এমন খুবই কম গায়কই আছে যে তোমার মোকাবিলা করতে পাররে, অথচ দেখ, তুমি কোথায় পড়ে আছে? সব তোমার নিজের আলস্যের কারণে। নিজেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, একবার কী ভেবেছ? এত উড়ান থাকা সত্যেও তুমি যদি নিজেকে নিজে বন্দি করে রাখতে পারো, তবে আমি এই পায়রাগুলিকে বন্দি করে রাখে দোষ কোথায় করলাম, বল?
গুরুদেবের কথা শুনে শোভমের ভিতরের মানুষটি কেঁপে উঠল। যেন জেগে উঠল শোভম, যেন নিজেকে চিনতে পারল সে। এবার শোভমের চোখের ভাষা বুঝতে বাকী রইল না গুরুদেবের। তিনি মহানন্দে বললেন, “যাও, পায়রাগুলিকে তুমি নিজ হাতে ছেড়ে দাও। ওদের মত তুমিও এবার সৎ, নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের পাখায় ভর করে খ্যাতির গগনে উড়তে থাকো।”দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে গেল। নিষ্ঠার সাথে নিরলস প্রচেষ্টায় একদিন শোভম সত্যিই সেই রাজ্যের রাজসভাতে স্থান পেল।