প্রিয় ইরা ,
আজ অনেক ইচ্ছে করছে তোমাকে একটা সাদামাটা গল্প শোনাই । আমার গল্প । শাহেদের গল্প । আমাদের গল্প !
গল্পের শুরুটা খুব এলোমেলো ছিল.. প্রচন্ড ইগোবাজ দুটি মানুষ কবে কখন একটি চাওয়া এক হয়ে গিয়েছিল সে কথা আজ আর মনে নেই ।
কোন দিন তারিখ ঠিক করে ভালবাসি বলা হয়নি কারুরই । তাই বলে আমাদের একসাথে কাটানো দিন গুলো একেবারেই বৈশিষ্ট্যহীন ছিল তা নয় ।
অন্যদের মত আমরা হয়ত নিয়মকরে উইকএন্ডে ঘুরতে যেতে পারতাম না , হয়ত শাহেদ কখনো বর্ষার প্রথম কদম ফুল আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেনি তুমি এর চেয়ে সুন্দর !
তবু মাঝে মাঝে ওর বোকার মত তাকিয়ে থেকে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলা ক্ষণ টুকুকে ভীষণ ভালবাসতাম ।
কিংবা “কাল তোমার ক্লাস আছে ?” প্রশ্ন শেষের লুকোনো আবেগটুকু অনেক আপন লাগত আমার !
আর আপন লাগত ওর সত্য বলার সাহস ! জানো , যেদিন প্রথম ওর বাসায় গেলাম ওর বৌ হয়ে , হ্যাঁ আমাদের বিয়ের কথাই বলছি !
সেদিন ওর কাকীমারা আমার সামনেই কেমন কপাল কুচকে ছিলেন । ফুলশয্যার রাতে আমার প্রথম কথা ছিল ” তোমার পরিবার আমাকে পছন্দ করেনি তাই না ? ”
শাহেদ মুচকি হেসে বলেছিল – সংসার তো আমি করব… আপাতত আমার পছন্দ হলেই চলবে ।
আমি একটুও কষ্ট পাইনি জানো । বরং আরো একটু বেশী ভালবেসে ফেলেছিলাম ওর সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে ।
এর পরের গল্পটা একটু অচেনা ছিল । ঠিক অচেনা নয়… বরং ভয়ঙ্কর রকম চেনা … এলোমেলো..
তুমি তো জানো আমি বেশ ভাল একটা রেজাল্ট নিয়ে গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করেছিলাম ।
একটা ফরেইন কোম্পানী থেকে অনেক ভাল একটা চাকরীর অফারও পেয়েছিলাম । হ্যাঁ , যা ভাবছো তা ই । শাহেদ আমাকে চাকরীটা করতে দেয়নি ।
ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দুমাস চেষ্টাও করেছিলাম । সেসময় ও জেদ ধরল পরিবারে নতুন একজন সদস্যের !
সত্যি বলতে ছোট্ট একটা হাতের মাঝে নিজের আঙ্গুল আকড়ে ধরার সুখ সুখ মুহূর্তটার আমিও ভীষণ লোভী হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর অনেক গুলো বিষন্ন আর ক্লান্ত বিকেল শেষে রোজালিন এল আমার সারাবেলার খুনসুটি হয়ে ।
ওকে ঘিরে আমাদের ভালবাসার কোন কমতি ছিলনা । গোলাপী গোলাপী রং এর ছোট্ট পুতুল টা আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল খেলনা ,শখের রান্না বাটি ছেড়ে।
আমার আর চাকরীতে ফেরা হয়নি ওকে সব টুকু পূর্ণতায় বড় করে তোলার চেষ্টাতে ।
আমি ওর মাঝে নিজের শৈশব কৈশোর টা দেখতাম । যা কিছু আমার হয়নি তার সবটুকু ওকে দিতে চেয়েছি আমি ।
রোজাও ঠিক ওর বাবার মত হয়েছিল । প্রচন্ড জেদী আর স্বাধীনচেতা । একদিন রাতে খাবার টেবিলে বসে জানালো ও আর এদেশে পড়াশোনা করতে চায়না ।
একটা স্কালারশীপও নাকি পেয়ে গেছে জার্মানীর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে । ওখানে থাকা ওর বন্ধু আর তার পরিবারই নাকি করে দিয়েছে সব ।
এখন শুধু আমাদের অনুমতির অপেক্ষা ।
আমি জানি এই অপেক্ষা টুকুর দেরী হয়ত ও পছন্দ করবেনা তাই বাঁধা দেইনি আর ।
ও যেদিন চলে গিয়েছিল শাহেদ আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে চাচ্ছিল না । ভেবেছিল আমি খুব কাঁদব । জানো ইরা , সেদিন আমি একটুও কাঁদিনি।
সত্যি বলছি ! শুধু বাড়িতে ফিরে ওর ছোট্ট বেলার জামা জুতো আর খেলনা গুলো জড়িয়ে রেখেছিলাম বুকের কাছটায় !
আমার পুতুল পুতুল বাবুটা কবে এত বড় হয়ে গেছে আমি কিচ্ছুটি টের পাইনি !
প্রথম প্রথম প্রতি সপ্তাহে মেইল করত । স্কাইপিতে কথাও হত । আমার ঘুরে ফিরে কি খাচ্ছো ,
ঠিকমত ঘুমাচ্ছো কিনা এই গদবাধা প্রশ্ন গুলো হয়ত ওর আর ভাল লাগত না কিংবা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল পড়াশোনায় তাই মেইল এর সংখ্যা কমতে লাগল আস্তে আস্তে ।
এর পর অনেক গুলো দিন কেটে গেছে নিঃসঙ্গতার সাথে ঘর করে। শাহেদও ইদানিং ভীষণ ব্যস্ত অফিসের কাজে ।
বয়স হয়েছে ,আগের মত আর চাপ সামলাতে পারেনা ঠিকঠাক । বেশীর ভাগ সময়ই মেজাজ খিটখিটে করে বাসায় ফেরে…
আর বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সর্ম্পকের দুরত্ব ।
ছুটির দিনের বিকেল গুলোতে একসাথে বসে চা খাওয়ার চেয়ে একবেলা ঘুমিয়ে নেয়া ওর কাছে বেশী আপন মনে হয় ।
আর আমার ? আমার এখন অসীম অবসর… এক চিলতে আকাশ ,
প্রিয় ঘরের কোন আর টুকরো মেঘেরা না থাকলে হয়ত বিষন্ন বাতাসের কাছে কবেই হেরে যেতাম ।
জানো ইরা , পঞ্চান্ন বছর বয়সটা খুব একলা । এলোমেলো ।
অকারনেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । বুকের কাছটায় অভিমানের মেঘ খুব ভারী হলে টুপটাপ বৃষ্টি নামে একটুতেই ।
সবকিছু থেকেও মনে হয় নিজের কিছু নেই । একটু একটু করে গড়া নিজের সংসারটা কেমন অচেনা লাগে ।
পঞ্চান্ন বছর বয়স টা কেমন যেনো… এলোমেলো । প্রিয় মানুষগুলোর কাছে নিজেকে বোঝা মনে হয় , জীবনে লাগে অর্থব ।
বুকের ভেতরে হলুদ পাতার দীর্ঘশ্বাস টুকু বাড়তে থাকে একটু একটু করে ।
ছোট্ট একটা চড়ুই বিকেলের জানালায় এসে বসলে তার সাথেও গল্প জুড়ে দিতে ইচ্ছে করে । অনেক ক্লান্ত আর একাকী বিকেলের গল্প !
তোমার কি বিরক্ত লাগছে ইরা ?
আমি জানিনা তুমি বাংলা পড়তে পারো কিনা ।
তোমার মা হয়ত তোমাকে কখনো জোনাকীর গল্প শোনায়নি, বৃষ্টি শেষে মাটির অদ্ভুত সুন্দর গন্ধের কথা বলেনি..
অনেক সবুজ আর এক চিলতে লালের গল্প বলেনি । আমার সেই সব গল্প তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করে ।
তোমার কি সময় হবে ইরা ?? আমাকে জানিও আর ভাল থেকো । সবটুকু ভাল ।
ইতি
তোমার নানু
চিঠিটা শেষ করে ছোট্ট একটা বাক্সে ঢুকিয়ে রাখে শাহেদ এর স্ত্রী , অনিন্দিতা । সে জানে এই চিঠি কখনো পাঁচ বছরের ছোট্ট ইরার হাতে পৌছোবেনা তবু খামের উপর ছোট ছোট অক্ষরে লিখে রাখে “ইরার পঞ্চান্নতম জন্মদিনের উপহার ” !
– –