আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক, ব্যবসায়িক সুত্রে আলাপ হয়ে পরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছেন। পঞ্চাশোর্ধ বিপত্নীক। একটি পুত্র সন্তান বোর্ডিং স্কুলে পড়ে। এক সন্ধ্যায় তিনি আমার বাড়িতে এসে হাজির। একটা বিয়ের কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন তিনি বিয়ে করছেন, তারিখ আর অনুষ্ঠানের স্থান বলে দিলেন। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে পাত্রী সম্মন্ধে বিশদ জানতে চাইলাম। তিনি মুচকি হেসে বললেন, বিয়ের পরে কথা হবে আজ বড় তাড়া। নির্দিষ্ট তারিখে সস্ত্রীক গেলাম অনুষ্ঠানে। খাওয়া শেষে নব বধুকে দেখলাম, যথেষ্ঠ সুন্দরী, বয়েস বড় জোর পঁচিশ হবে। বন্ধুর তুলনায় বয়েস বেশ কম মনে হলো। পরে আরো জানলাম নব বধুর একটি পা নেই। আমি এবার বুঝলাম বিয়ে কিভাবে হলো, দায় মুক্তির বিবাহ। বিয়ের মাস খানেক পর তিনি ব্যবসায়ীক কাজে আমার অফিসে এলেন।
কাজের শেষে নিজেই তাঁর বিয়ের কথা তুললেন। আমি এখানে বাকি আলাপ তাঁর নিজের জবানিতে দিচ্ছি। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন বারো বছর আগে। শিশু সন্তানকে নিয়ে আমি একা হয়ে পড়লাম। অনেকেই বার বার আমাকে পুণরায় বিয়ে করার তাগিদ দিয়েছিলেন, আমি পুত্রের মুখ চেয়ে রাজী হইনি। তবে শারীরিক চাহিদার কারনে মাঝে মাঝে বারবনিতার সংগ নিতাম। আমার এক বিশ্বস্ত লোক আমাকে নির্দিষ্ট কিছু বাড়িতে নিয়ে যেতো যেখানে গেলে বোঝাই যেতো না সেখানে দেহ ব্যবসা হয়। কয়েকটি মেয়ে থাকতো, তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে সময় কাটিয়ে ফিরে আসতাম। এমনই করে বছর তিনেক কাটানোর পর, আমার বিশ্বস্ত লোকটি জানালো যে সে একটি নতুন ঠিকানা পেয়েছে, সেখানে কিছু নতুন মেয়ের সন্ধান পেয়েছে।
এক সন্ধ্যায় আমি গেলাম তার সাথে, এক অভিজাত এলাকায় বাড়িটি। যে ঘরে নিয়ে গেল সেখানে সাতটি মেয়ে কয়েকটি সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল। অদুরে আরেকটি মেয়ে দুটি বাচ্চাকে সংগ দিচ্ছিল। সেই মেয়েটির বেশভূষা অন্য মেয়েদের তুলনায় যথেষ্ট মার্জিত। আমি সবাইকে দেখলাম, দেখে আমি পাশের আরেকটি ঘরে গেলাম। সেখানে একটি লোক এসে দাঁড়ালো, বলল, বলেন স্যার কারে আপনার চাই আমি ডেকে আনছি, পছন্দ না হইলে আমাদের কাছে আরো মেয়ে আছে। আমি বললাম, যে মেয়েটি বাচ্চা কোলে বসে আছে তাকে চাই। একথা শুনে লোকটি চমকে উঠল। বলল, না স্যার এটা কোনো মতেই সম্ভব না। আমি জোর দিয়ে বললাম, আমি ওই মেয়েটিকেই চাই।
একথা বার দুয়েক বলার পর লোকটি বলল, আপনি একটু বসেন, আমি আমাদের সর্দারণীরে ডাকি। কিছু পরে বেশ স্থুলকায়া মধ্য বয়েশী এক মহিলা এসে আমার সামনে বসলো। তার গা ভর্তি সোনার গহনা, মনেই হবেনা বারবনিতা । আমার কথা শুনে সে বলল, ওই মেয়েটিকে কোনো মতেই দিতে পারবো না। কারন জানতে চাইলে বলল, মেয়েটির একটা পা নেই, খুব ছোট বেলায় দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছে। দারিদ্রের কারনে তার মা তাকে আমার কাছে রেখে গেছে। সেই থেকে সে আমার কাছেই থাকে বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। আমি আবার বললাম, ঠিক আছে, তুমি তাকে আমার কাছে পাঠাও আমি এখানে বসে শুধু কথা বলে চলে যাবো। যা টাকা লাগে দেবো। মহিলা থ মেরে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এক ঘন্টায় দু’হাজার টাকা দিতে হবে। আমি তাতেই রাজি হলাম। সে তখন দালালকে বলল, এই শিউলিরে এখানে নিয়ে আয়।
কিছুপরে একটা ক্রাচে ভর দিয়ে শিউলি আমার কাছে এলো। আমার সামনে একটা সোফায় মাথা নিচু করে বসল। আমি মোহিত হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শিউলির দিকে। সাধারণত বারবনিতারা এমন হয় না। আমি তার সাথে কথা বলতে লাগলাম। সে খুব সামান্যই উত্তর দিচ্ছিল। এক ঘন্টা কেটে গেল। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সারা রাত ঘোরের মধ্যে কাটালাম, শিউলির কথা ভাবতে ভাবতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারলাম না। পরের দিন সকাল থেকে সারাটা দিন ঠিক মতো কাজে মন বসাতে পারলাম না। সন্ধ্যা হতেই গিয়ে হাজির হলাম শিউলিদের ডেরায়। সর্দারণীকে বললাম, আজ যতক্ষন খুশি বসবো। সে বলল, ঠিক আছে বসেন, তয় সেই আগের হিসাব, ঘন্টায় দু হাজার টাকা।
এই ভাবে কোনো দিন ছয় হাজার, কোনো দিন চার হাজার টাকা করে খরচ করেছি। পরপর দশ দিন গেছি। শেষ দিন সর্দারণীকে ডাকলাম, বললাম আমি শিউলিকে কিনে নেবো কি দাম নেবে বলো। সর্দারণী বলল, কেন আপনি কি তারে দিয়া ব্যবসা করবেন? কথাটা শুনে মনে হলো এক চড় বসিয়ে দেই তার গালে। অনেক কষ্টে রাগ চেপে বললাম, কতো টাকা লাগবে তাই বলো। সে বলল, দুই লাখ দিবেন। আমি সেদিন টাকা সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যাগ খুলে দুই লাখ টাকার বান্ডিল তার হাতে দিয়ে শিউলির হাত ধরে বেরিয়ে আসলাম। বাড়িতে নিয়ে এসে তাকে বললাম আমি তাকে বিয়ে করবো। এবার শিউলি বেঁকে বসল বলল, আপনার কি মাথা খারাপ হইসে, সমাজ কি বলবে। আমি বললাম সে ভাবনা আমার। অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করালাম।
সাত দিন পর শিউলিকে নিয়ে আবার তাদের ডেরায় গেলাম। সর্দারণী আমাকে দেখে মুচকি হেসে বলল, কি খায়েস মিটে গেল বুঝি, তয় টাকা কিন্তু ফেরৎ পাইতেন না। আমি তাকে বললাম, তোমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করতে এসেছি। আগামী মাসে পনেরো তারিখে আমার আর শিউলির বিয়ে। এ কথা শুনে সারা বাড়িতে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। মেয়েগুলি বলল, আমরা সবাই মিলে কনের গায়ে হলুদ দিবো, বিয়ের কনে সাজাবো। আমি বললাম, আমার পেল্লায় তিনটে ঘর তোমাদের ছেড়ে দেবো, তোমরা যেদিন থেকে খুশি এসো। সব শুনে সর্দারণী মুচকি হাসলো।
সব কিছু করলো মেয়েগুলিই। আমার কিচ্ছু করতে হয় নি। আমি যখন যেমন টাকা চেয়েছে দিয়েছি। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় তারা সবাই সেজেগুজে শিউলির চার দিকে ঘিরে গান করতে লাগলো। এমন সময় সর্দারণী এসে হাজির। আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে দুলাখ টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা আমি কনেরে দিলাম। আমি প্রবল আপত্তি করলাম।
সর্দারণী বলল, দেখেন হইতে পারি আমরা নরকের কীট হইয়া গেসি তবু আমাদেরও বিবেক আসে, আমাদের মন আসে, হৃদয় আসে। আপনি শিউলিরে পায়ে স্থান দিসেন এর চাইতে বড় কিছু আমাদের পাওয়ার নাই। আপনার কাসে শুধু একটা অনুরোধ তারে আপনি কখনও ফেলায়া দিয়েন না।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প