-স্যার আসতে পারি?
খাতার উপর থেকে চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন স্বদেশ বাবু।
স্বদেশ বাবু হলেন এদেশের একটি খ্যাতনামা কলেজের অধ্যক্ষ। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন।স্বদেশ বাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন ভেতরে আসার জন্য।
কি সমস্যা বলুন তো? অনেকটা অনিহা নিয়ে খাতার উপর চোখ বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলেন স্বদেশ বাবু।
-স্যার আপনার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা ছিলো। একটু বসে বলি?
লোকটির কথা শুনে স্বদেশ বাবু লোকটির দিকে মনোযোগ দিলেন।
-জরুরী কথা? আচ্ছা বসে বলুন।
-স্যার ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলি। স্যার, শুনতে যদিও গল্প মনে হবে কিন্তু আসলে এটা সত্য ঘটনা।
-যা বলতে চাচ্ছেন তা বলুন।
-স্যার ঘটনাটা খুব বেশিদিন আগের নয়। এইতো ৬-৭ বছর হবে। ছেলেটির নাম অপু। গ্রামে থাকতো। অনেক ভালো ছাত্র ছিল সে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। আর্থিকভাবে ততোটা সচ্ছল ছিলো না। তবে ছেলেটির ইচ্ছে ছিলো ঢাকার একটি খ্যাতনামা কলেজে ভর্তি হবে। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে একটি খ্যাতনামা কলেজে সে ভর্তি হয়। ভর্তি হওয়ার এক বছর পর তার বাবা মারা যায়। আত্নীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ না থাকায় বড় ছেলে হিসেবে পরিবারে দায়িত্বটা নিজের উপর পড়ে। তার একটা বোন ছিল। তার থেকে ১ বছরের ছোট। ভাই বোন দুজনেই পড়াশোনায় ভালো ছিলো বলে তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্ধবেতনে পড়াশোনার সুযোগ পেতো। তাই পড়াশোনার খরচ তেমন একটা ছিলোনা বললেই চলে। কিন্তু পরিবারের খরচ চলবে কি করে? অসুস্থ মা এবং পরিবারের খরচ চালানোর জন্য অপু টিউশনি করত। টিউশনির টাকা এবং গ্রামের চাষাবাদের জমিজমা বর্গা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে যেতো। পারিবারিক অসচ্ছলতা এবং টিউশনির কারণে অপু নিয়মিত কলেজে উপস্থিত থাকতে পারতো না, ঠিকমতো পরীক্ষার ফি গুলো দিতে পারতো না। অনেক সময় দেখা যেতো মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সে সময় অপুর পরীক্ষা চলছে। অপু পরীক্ষা না দিয়ে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। যেহেতু তার বাবা ছিলোনা তাই পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তার তো অনেক দায়িত্ব পালন করতেই হবে।
পারিবারিক ব্যস্ততা এবং অন্যান্য কারণে অপু তার কলেজের নিয়ম কানুন ঠিকমত মানতে পারছিল না।
কথা বলার এক পর্যায়ে লোকটি থেমে গেলো। অনেকক্ষন চুপ থেকে লোকটি বলল।
-স্যার, তারপর অপুর ভাগ্যে কি ঘটেছিল জানেন?
স্বদেশ বাবু বললেন, কি?
-অপুকে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি। অপু অনেক বুঝিয়ে ছিলো তার স্যারকে কিন্তু স্যারের একটাই কথা, “তুমি কলেজের নিয়ম কানুন মানতে পারোনি,তাই তুমি পরীক্ষা দিতে পারবে না।”
স্যার অপু এতোটাই কেঁদেছিল যে, তার কান্না দেখে অনেক স্যার ম্যাডাম কান্না চেপে রাখতে পারেনি। এমনকি অনেক ছাত্র-ছাত্রীও কেঁদেছিল সেদিন। যদিও পরে অপুকে নিয়ে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মানব বন্ধন করেছিলো কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
পরে অপুর খোঁজে তার বাসায় গিয়েছিলো অনেকে কিন্তু অপুকে পাওয়া যায় নি। কোথায় চলে গিয়েছিল কেউ জানতো না। পরে অবশ্যি কেউ আর অপুর খোঁজ করেনি। এভাবে অনেক বছর কেটে গেলো।
অনর্গল কথাগুলো বলে লোকটি উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন পর লোকটি আবার চেয়ারে বসে বললো,
-স্যার, আমার ঘটনাটা শেষ।
-আপনি কি আমার সাথে মজা করতে এসেছেন? আপনি আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। আপনি এবার যেতে পারেন, অনেকটা রাগান্বিত স্বরে কথাগুলো বলল স্বদেশ বাবু।
-স্যার আসল কথাই তো বলা হয়নি।
-কী কথা?
-স্যার আমি কিন্তু সেই অপুকে চিনি। তার সব খোঁজ খবর আমার কাছে আছে। স্যার একটা মজার ব্যাপার কি জানেন অপু কিন্তু আপনার কলেজের ছাত্র ছিলো এবং আপনি তাকে টিসি দিয়েছিলেন।
-মানে? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?
-না স্যার তেমন কিছুই না। স্যার, আপনি তো একজন শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে আপনার তো উচিৎ ছিলো আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজ খবর রাখা।
স্যার আপনাকে একটা কথা বলি?
-হুম। বলুন।
-অপু এখন কোথায় থাকে কি করে জানতে চান?
– না। জানার প্রয়োজন বোধ করছি না।
-আপনি প্রয়োজন বোধ করুন আর নাইবা করুন, আপনাকে জানানো আমার কাজ। অনেকটা ক্রুদ্ধ হয়ে কথাগুলো বলে উঠে দাড়ালো লোকটি।
-কি বলতে চান আপনি?
-স্যার সেই অপু আজ ভয়ংকর সন্ত্রাসী। আর তার বোন এখন পতিতা। মাঝরাতে ঢাকার নামীদামি হোটেল গুলোতে রাত কাটায় সে। স্যার আপনার কারণেই কিন্তু তার আজ এই অবস্থা।
-আমার কারণে? কি বলছেন আপনি?
– জ্বী স্যার আমি ঠিকই বলছি। অপুর ভবিষ্যৎ আরো সুন্দর হতে পারতো যদি আপনি তাকে টিসি না দিতেন। সেই দিনের অপু হয়তো আজকের ভয়ংকর সন্ত্রাসী হতো না, যদি আপনি তার প্রতি একটু সদয় হতেন। অপুর বোন আজ দেহ ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পরতো না যদি আপনি তার প্রতি একটু করুনা দেখাতেন, অপুকে আজ এইভাবে ফেরারী আসামী হয়ে ঘুরতে হতো না যদি সেদিন অপুর কান্না আপনার হৃদয়কে স্পর্শ করতো। আপনাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে দেখতে অনেক সুন্দর কিন্তু এখানেও যে শিক্ষকরূপী ভক্ষক থাকে সেটা অনেকের অজানা।
-আমি আর কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না। আপনি এবার আসতে পারেন, অনেকটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললেন স্বদেশ বাবু।
– স্যার আমি তো আমার কাজটা না করে যাবো না।
-আমি আপনকে চলে যেতে বলেছি। আপনি যদি না যান তাহলে আমি দারোয়ান ডেকে আপনাকে বের করে দেবো।
– জ্বী স্যার ডাকতে পারেন। তবে কেউ আসবে না।
লোকটির কথা শুনে স্বদেশ বাবু অনেকটা ঘাবড়ে গেলেন। দারোয়ান, কেরানীদের ডাকলেন কিন্তু কারো কোনো সাড়া নেই। এইবার তিনি ফোনটা তুললেন, দেখলেন যে ফোনটাও কাজ করছে না।
– কি স্যার বললাম না, কোনো লাভ নেই। স্যার অপুও কিন্তু সেদিন অনেক অনুরোধ করেছিলো, অনেক কেঁদেছিল, আপনাকে অনেকবার ডেকেছিল কিন্তু তার চিৎকার শুনে কেউ তাকে সাহায্য করতে আসেনি। আজকেও আপনাকে কেউ সাহায্য করতে আসবে না।
স্বদেশ বাবু ভীত হয়ে চুপচাপ বসে আছেন। কোনো কথা বলছেন না।
-স্যার সেই অপুকে আপনি দেখতে চান? আমার দিকে ভালো ভাবে দেখুন তো!দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা? অবশ্যি চেনার কথা নয়। স্যার সত্যি বলতে কি, আমি সেই অপু।
এইবার স্বদেশ বাবু সত্যি সত্যি অনেক ভয় পাচ্ছেন।
-তুমিই অপু? কি জন্য এসেছো?
– স্যার আমি আমার প্রতিশোধ নিতে এসেছি?
-প্রতিশোধ?
– জ্বী স্যার। প্রতিশোধ। আচ্ছা স্যার বলেন তো একজন সন্ত্রাসীর প্রধান কাজ কি?
স্বদেশ বাবু অনেক ভয়ে ভয়ে বললেন, মানুষ খুন করা।
-এইতো স্যার আপনি পেরেছেন। আমি আপনাকে………
অপুর কথা থামিয়ে স্বদেশ বাবু ভয়ার্ত স্বরে বললেন,
কি বলছো এই সব।
– জ্বী স্যার, যা বলছি তা ঠিক বলছি। তবে আমি আপনাকে নিজ হাতে খুন করবো না। আপনি নিজেকে নিজে খুন করবেন। সোজা ভাষায় যেটাকে আত্মহত্যা বলে। এই নিন পিস্তলটা হাতে তুলে নিন। এই বলে অপু পিস্তলটা স্বদেশ বাবুর হাতে দিলো।
– তবে স্যার তার আগে আপনাকে ছোট্ট একটি কাজ করতে হবে।
-কি কাজ? শান্ত স্বরে বললেন, স্বদেশ বাবু।
-আপনাকে একটি চিরকুট লিখতে হবে। যেখানে আপনি লিখবেন, “আমি শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য, আর তাই আমি বেঁচে থাকার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
স্বদেশ বাবু কথা গুলো একটি সাদা কাগজে লিখে নিলেন এবং নিজের একটি স্বাক্ষর দিলেন।
– স্যার, এইবার মাথার কাছে পিস্তলটা নিয়ে গুলি করেন। পিস্তলে মাত্র একটি গুলি আছে। মিস হলে আপনার প্রবলেম।
-কি প্রবলেম?
– তাহলে তো স্যার আমি আপনাকে গলা টিপে মারবো। মরতেও সময় লাগবে। শুধু শুধু মৃত্যু যন্ত্রণা পাবেন। এতো কষ্টের কি প্রয়োজন আছে? তার চেয়ে এক সেকেন্ডের মৃত্যু ভালো নয় কি?আপনি তো শিক্ষক মানুষ। অনেক জ্ঞানী লোক। উপযুক্ত কাজটিই আপনি করবেন।
মৃত্যু অবধারিত জেনে, স্বদেশ বাবু বাঁচার শেষ চেষ্টাটুকু করলেন না। পিস্তলটা মাথার একপাশে ধরলেন। ভীত হাতে পিস্তলের টিগারটায় আঙ্গুল রেখে চাপ দিলেন স্বদেশ বাবু।চাপা গোঙানির মতো একটু শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেলেন স্বদেশ বাবু। অপু হাসছে,ভয়ংকর এক হাসি।