অাপনারা যারা নিয়মিত অামার লেখা পড়েন তারা সবাই অামার ও অামার দুই মেয়ে সম্বন্ধে কম বেশী জানেন, অনেকেই অামার লেখা পড়ে বার বার জানতে চাইছেন অামার স্ত্রী সমন্ধে।অনেকে অভিযোগ করেছেন কেন অামার কোন লেখায় অামি তাকে প্রকাশ করিনা। অাপনাদের সকলের কৌতূহল মেটাতে অামার অাজকের লেখাটি সম্পুর্ন তাকে নিয়েই লেখা।
তাকে বর্ননা করতে গেলে প্রথমেই জীবনান্দদাশের কবিতার সেই চরন টা মনে পড়ে যায় ” চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;। অাসলে জীবনের কোন এক মূহুর্তে তার সেই অন্ধকার বিদিশার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই হারানোর মাঝেই অাজও অামি নিজেকে খুজে ফিরি।
তাকে অাসলে প্রথম দিকে অামি তেমন বুঝতে পারিনি। অামার কেন যেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “উৎসর্গ” (১৯১৪) কাব্যের ‘ছল’ কবিতার রহস্যময়ী এক নারীর কথা মনে হতো,
“তোমারে পাছে সহজে বুঝি তাই কি
এত লীলার ছল,
বাহিরে যবে হাসির ছটা ভিতরে থাকে আঁখির জল।
বুঝি গো আমি,
বুঝি গো তব ছলনা।”
কবিতার এ কথা গুলোর মতোন অামিও বুঝেছিলাম তার অাঁখির জলের কথা,বুঝেছিলাম তার ছল অার তার মনের কথ ।
তাকে যখন প্রথম দেখেছি আমি, আমার মনে হয়ে ছিলো সে একজন সাধারন নারী ।
আস্তে আস্তে আমি যখন তার সান্নিধ্যে এলাম ,আমার সামনে উম্মোচিত হতে লাগলো তার চরিত্রের এক এক অধ্যায়।
আমার কাছে মনে হতে লাগলো সে যেন, পথের পাচালীর “দুর্গা”, সে ছিলো চঞ্চল কিশোরী কন্যার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।তার চঞ্চলতা, হাস্যময়তা, সকলের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা অামাকে মোহনীয় করে তুলেছিলো। আমি হয়ে ছিলাম অভিভূত।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অামি তার মাঝে খুজে পায় এক নারীর বিভিন্ন চরিত্রের ভীন্নতাকে।
কখনো সে অামার কছে ধরা দেয় মানবজমিনের “তৃষার” মতোন।
অন্যান্য নারীরা যেমন কোমল,শান্ত সে ছিলে তার তার ব্যতিক্রম। কঠিন ও দৃপ্ত চরিত্রের অধিকারীনি সে,
সে স্বতন্ত্র ও লক্ষ্যাভিমুখী এক মেয়ে।মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভাংচুর,জোড় মেলানোর ঘাত প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বময় পরিবেশেও দমে যায়নি সে।
সমাজের কাছ থেকে সে তার প্রাপ্য টুকু ঠিক বুঝে নিয়েছিলো।
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছে, কখনো সমাজের,কখনো বা কঠিন দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই। এই সব কিছুই সে চরম সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছে। তাই তো তাকে মানবজমিনের “তৃষা” বল্লে ভূল হবে না ।
তার প্রতি আমার “তৃষার” ধারনা ভাংগতে না ভাংতেই তার চরিত্রের মাঝে দেখতে পেলাম সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র “দীপাকে”, সে ছিলো তার মতোন সাহসী ও স্বতন্ত্র চরিত্রের অধিকারীনি এক নারী।
যার মধ্যেই নিহিত ছিলো অন্ধকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুর্বাভাস। জয় করেছিলো নিজের ভাগ্য,পড়াশুনা।কাছের মানুষ এমনকি নিজের স্বজনদের ঘৃণা,শত্রুতা,তাদের ভিতরকার বিভৎস লোভী চেহারাও তাকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি।
সে সময়ের কাঁধে মাথা ঠেকিয়েছে, কিন্তু ভেঙ্গে পড়োনি।
কাছের মানুষ বলতে কেউই ছিলোনা তার ,দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলার সময় কেউ কাঁধ বাড়িয়ে দেয়নি তার দিকে।
সুযোগ ছিলো অনেক,চাইলেই তা হাত বাড়িয়ে নিতে পারতে সব। কিন্তু তা সে করোনি।
সাধারনের মাঝেই সে ছিলো অসাধারন।তার জীবনে ঘটেছে নানা বিধ ঘটনা, নান ঘটনা যেন মোহনার মতোন এসে মিশেছে তার জীবনে, তবুও নানা নাটকীয়তা,আর এসব নাটকীয়তাকে ছাপিয়েই তার জীবন এগিয়ে গেছে সমান্তরালভাবে। ঠিক যেন সে দীপাবলি বন্দোপাধ্যায়ের রুপ।
এ পরেই তার মাঝে দেখতে পেলাম পদ্মা নদীর মাঝির “কপিলাকে”,রহস্যময়ী এক নারী রূপে ।
দারিদ্র্যতা,কঠিন সামাজিক হেয়তা, নীচুতা, চরম হিংসা,এইসবের মাঝেও সে ছিলো নিজ স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। লোভ, ঘৃনা,প্রেম, রিপুর তাড়না,বাঁচার ইচ্ছে,উচ্চাকাংক্ষা সব মিলিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত করেছিলো সময় ।
আর ঠিক তখন আমি তার মাঝে “প্রফুল্লকে” আবিস্কার করলাম সে অতি সাধারন হওয়া সত্ত্বেও অসাধারন ব্যক্তিত্ব আর ভীষন আত্মমর্যাদার অধিকারীনি ছিলো ।
অামাকে সঙ্গে নিয়ে সে সময়ের সাথে লড়েছে প্রতিনীয়ত।
সমাজের নান নিগ্রহের শিকার হয়েও কেবল তার নিজেস্ব আত্মমর্যাদাই তাকে সাধারন এক মেয়ে থেকে দেবী চৌধুরানী বানিয়েছে।
সেই তাকেই আবার পেলাম ‘আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস সূর্য দীঘল বাড়ী’র জয়গুন এর মাঝে ।
তাকে আবিস্কার করলাম হোচট খাওয়া বাংলাদেশের চিত্রের সাথে। সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ তার মধ্যে রক্তচক্ষু বের করা কতিপয় মানুষ নামের চারপায়া জানোয়ার, দিনের পর দিন বছর শতাব্দী যাবৎ ধর্মীয় ভন্ডামীতে আবদ্ধ করে রেখেছে সবাইকে।
সেই সব মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
সমাজের বন্ধন দ্বারা প্রতিনিয়ত পিষ্ট হয়েও উঠে দাঁড়িয়েছে জয়গুন রুপি সে ।
সংকটে পড়ে যাওয়া সে, নীরবে সংগ্রাম করে চলতে থাক দিনের পর দিন।
সকল বৈরীতা,অমানবীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ শিকার সে আবারো বেছে নেয় অামাকে। অাবার শুরু করে
অামাকে নিয়ে জীবন সংগ্রামের কঠিন পথ।
স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ মানতেই হয়।
তাকে আবার পেলাম ‘শ্রীকান্ত’র রাজলক্ষীর মাঝে ,রাজলক্ষী সাহসী,দৃঢ় প্রত্যয়ী, দয়াময়ী,আবেগী সুন্দরী রমনী ঠিক যেন তার অপর রুপ ।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ রচিত ‘লালসালু’র জমিলার মতোন অত্যন্ত সাহসী এক নারী সে। অভদ্র মানুষ দ্বারা ভ্রান্ত না হয়ে সে সমাজের পরিবর্তন চেয়েছিলে।
আর শেষ পযন্ত তাকে পেলাম কোথাও কেউ নেই এর মুনার মাঝে , মুনা সাধারন ঘরের আটপৌঁঢ়ে নারী। শান্ত-শিষ্ট, আর কোমল মনের অধিকারিনী।
মুনার আশেপাশে এমন অসংখ্য মানুষের বসবাস ছিলো যাদের জীবনে মুনার প্রয়োজন অনেক,কিন্তু এত মানুষের ভীড়েও মুনা ভীষন ভাবে লড়েছে সমাজের সাথে।
কখনো মুখ খুলে কারো কাছে কিছু চায়নি,তাই হয়তো জীবন তাকে কিছুই দেয়নি।
জীবনের নানা জটিলতা আর সংগ্রাম মুনাকে রূঢ় হতে বাধ্য করেছে। মুনা হেসেছে,কেঁদেছে,রাগ করেছে,ঘৃনা করেছে,আবার ভালোও বেসেছে ভীষন।তারপরও জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে মুনাকে চরম ভাবে লড়তে হয়েছে ।
ঠিক সেভাবেই আজও সে একা লড়ছে অামাকে নিয়ে দরিদ্রতা,অার রোগের সাথে।
অাসলে তাকে দেবার অামার কিছুই নেই তবুও শেষ মূহুর্তে শুধু এটুকুই বলবো, যদি কখনো তোমার ক্লান্ত লাগে কিম্বা চলার পথে তোমার কোন অবলম্বন লাগে তবে যেন, আমি আছি কেবলি তোমার জন্যে।
অামার জীবনের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত থেকো তবুও তুমি ……….।