সারা বাজার ঘুরে ২০টাকা দিয়ে একটা লাউ, এক কেজি মিনিকেট(পুরোনো) চাল,এক পোয়া ইন্ডিয়ান মুসুরি ডাল অনেক দরকষাকষি করে কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সুফিয়া। প্রতিদিন বাজারের টেনশনে রাতে ঘুমটাও ভালো হয় না তার। ৮সদস্যের পরিবারে শুধু একজন (স্বামী লুৎফর) উপার্জন করেন। সকালে বাজারের জন্য কোনোদিন ৫০টাকা কোনোদিন ১০০ টাকা দিয়ে কাজে চলে যায় লুৎফর। তিনি একটা খাবারের হোটেলের কর্মচারি। রোজ ৩০০ টাকা বেতন। তারমধ্যে দৈনিক ১০০টাকা একটা এন.জি.ও তে লোন পরিশোধ করতে হয়। আর ১০০ টাকা জমা রাখেন ঘরভাড়া দেবার জন্য। শুধু শুক্রবারে একটু মাছ কিংবা ফার্মের একটা মুরগী কিনতে পারেন ঋণ টাকা না দেবার তাগাদা থাকায়। শুক্রবারে তিনি পরিবারের মুখে একটু ভালো কিছু তুলে দিতে পারেন।
বাকি ছয়দিন সুফিয়ার অনেক হিসেব করে বাজার করতে হয়। যা দিয়ে ৪ছেলেমেয়ে, একটা ননদ আর শাশুড়ী সবাই মিলে যেনো একটু পেট ভরে খাওয়া যায়। চালটা ধুয়ে চুলায় দিয়েছে সে। মনে হচ্ছে এই চালটা ভাতে বাড়বে না। পুরনো চালটা ভাতে বাড়ে। কিন্তু দোকানদার হয়তো ভুলে নতুন চাল দিয়ে দিয়েছে। লাউটা ডাল দিয়ে রান্না করবে। আর লাউয়ের চোকলাটা কুচি কুচি করে কেটে নিলেন তার সাথে আগের দিনের ঘরে থাকা একটা আলুও কুচি করে মিশিয়ে নিলেন ভাজি করার জন্য। লাউ তরকারির একটা সুবিধা, একটা ভাজি আর একটা তরকারি অনায়াসে হয়ে যায়। খেয়েও পেট ভরে। আলু পেয়াজের দাম বেশি হওয়ার এসব এখন কম করে দেয়া হয় তরকারিতে।
তাদের দিনগুলো এমন অভাবের ছিলো না। গ্রামের বাড়িতে নদীর পার সংলগ্ন বড় ভিটে বাড়ি ছিলো তাদের। অন্যের জমি বর্গা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই চাল,ডালের ব্যবস্থা হয়ে যেতো। সুফিয়ার চাষ করা শাক-সবজি আর মায়ের পালা হাঁস-মুরগি দিয়ে সুন্দর সচ্ছলভাবে চলেও ছেলেমেয়ের জন্য ভবিষ্যৎ সঞ্চয় করতেন তারা। হঠাৎ বন্যায় তাদের ভিটেবাড়ি ডুবে গেলো। সারাগ্রামেই হাহাকার ছেয়ে গেলো। যাদের বাড়িঘর নদী হতে দূরে ছিলো তারাও নদী ভাঙনের ভয়ে নিজেদের নিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে লাগলো। এখানে পরপোকার করা কারো সাধ্যে নেই।
কে জানতো আজ এমন দিন আসবে! অবশেষে লুৎফর তার পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় এলো। কতোদিন না খেয়ে না দেয়ে ফুটপাতে কাটাতে হয়েছে তার হিসেব নেই। একটা রোজ আয়ের চাকরি খুজে খুজে ক্লান্ত হয়ে রুটি আর কলা খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। স্ত্রীর কানের স্বর্ণের দুলের ন্যায্য মূল্য দেয়নি গ্রামের সুদখোর সোমিত্র। তবু সেই টাকায় ফুটপাতে এতোদিনের খাওয়া খরচ তো চলেছে। তাই সে সোমিত্রের প্রতি কৃতজ্ঞ। অবশেষে এক হোটেল মালিকের উদারতায় তার ৩০০টাকা বেতনে চাকরি হয়ে যায় সাথে ৩০০০টাকা ভাড়ায় থাকার জন্য ছোট্ট একটা ঘর।
মাঝে মায়ের গুরুতরো অসুস্থতার জন্য জরায়ু অপারেশন করতে হয় অনেক টাকা ঋণের কবলে পরে লুৎফর। তখন হোটেল মালিকের সহোযোগিতায় একটা এন.জি.ও থেকে ২০০০০ টাকা ঋণ নিতে হয়। ঋণের ঘানি টানতে হচ্ছে সাথে জীবনের সাথে প্রতিনিয়তো যুদ্ধে টিকতে হচ্ছে। বড্ড ক্লান্ত লাগে লুৎফরের সাথে স্ত্রী সুফিয়াও হাপিয়ে উঠেছে। এমন অভাব কখনও দেখেনি তারা। তবুও নানামূখী হাপিত্তেসেও হিসেব করে টেনেটুনে চলে যাচ্ছে সব। মনে মনে আশংকা কি হবে ভবিষ্যৎ!
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প