বাবা মায়ের ডিভোর্সের লাস্ট ফরমালিটি গুলো আজ সম্পন্ন হলো। কাগজের শেষ সই টা করার পর বাবা মা উভয়েই আমার দিকে তাকালেন। দুজনের চোখেই প্রশান্তির ছাপ। শুধুমাত্র আমার চোখটা ভিজে আছে এই মূহুর্তে।
খুবই ছোট ছোট কারনের জন্য হওয়া ঝামেলার আজ অবসান ঘটলো। দুজনেই আজ মুক্ত এক বিরক্তিকর বন্ধন থেকে। হ্যাঁ! তাদের কাছে একসাথে থাকার মানেটা বিরক্তিছাড়া আর কিছুই না। মাঝখান থেকে আমি আজ একা।বাবা মা উভয়েই আমায় প্রচুর ভালোবাসে,যদিও সেটা কখনো কেউ প্রকাশ করেননি। তবুও আমার এটাই মনে হয়।আমি নিজেকে খুব একটা অভাগী বলিনা, আবার ভাগ্যবতীও বলিনা। আমি এই দুটো শব্দের কোনটারই কাছাকাছি নই। এই শব্দদুটো থেকে আমার দুর দুর পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই।মা বাবা থাকা অবস্থাতেও যেমন সুখ পেয়েছি, আজ তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়াতেও একই সুখ পাচ্ছি।
আমি অনু। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়া অনেকেই ভাগ্য মনে করে। কিন্তু আমি বিষয়টি কিভাবে নিব ভেবে পাইনা। যদিও আমাদের বাড়িটা বড়, কিন্তু ডাইনিং টেবিলের নিচের অংশ,চিলেকোঠা,কাপ বার্ড এর ভেতরটা,এসবই আমার থাকার জায়গা বলা চলে। ছোট বেলাটা কেটেছে এসবের ভেতরে লুকিয়ে। আর যখন বড় হয়ে সবকিছু বুঝতে শুরু করলাম তখন কেটেছে দরজাটা বন্ধ করে কানে হাত চেপে রেখে রুমের এককোনায় বসে থেকে।বাবা মায়ের মুখ উচ্চারিত বলা প্রতিটি শব্দ ছোট বেলায় না বুঝলেও বড় হওয়ার পর শুনলে গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো। তাইতো কানে হাত চেপে বসে থাকতাম ঘরের এককোনে।
এমন কোন দিন যায়নি যে দিনটি আমি চিলেকোঠার এককোনে বসে কাঁদিনি। বাবা মা দুজনে নিজেদের মাঝের রাগ,হিংসা,বিদ্বেষ সবকিছুর মাঝে যে আমায় আস্তে আস্তে বিষিয়ে ফেলছেন তা ওনারা কখনোই ভাবেননি। কলেজে বান্ধবীদের দেখতাম প্যারেন্টস ডে তে সবাই নিজেদের বাবা মাকে একসাথে হাসিমুখে নিয়ে আসত। যা৷ মার ভাগ্যে কখনোই যোটেনি।আমার ইচ্ছে হত বাবা মায়ের হাত ধরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। ওনাদের মুখের হাসির মাঝে নিজের সুখটা খুজে নেয়া। নিজের মনের মাঝে চলা সব অব্যক্ত কথাগুলো ওনাদের সাথে শেয়ার করা।
আমি শেষ কবে বাবা মায়ের সাথে বসে একসাথে খেয়েছি আমার মনে নেই,শেস কবে ওনাদের সাথে গল্প করেছি তাও আমার মনে নেই,শেষ কবে ওনাদের দুজনকে একসাথে হেসে কথা বলতে দেখেছি সেটাও আমার অজানা। একমাত্র মেয়ে হয়েও বাবা মায়ের কাছে একটা জিদ করার সাহস জাগেনি,একটা আবদার করতে পারিনি। আজ দুজনেই হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনেই আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। দুজনেই বলছেন, “আমার সাথে থেকে যাও মামনী” দু হাত জোড় করে ওনাদের উদ্দেশ্য বললাম’
–আমায় আপনারা মাফ করবেন। আমি আপনাদের কারও সাথেই থাকতে পারবোনা। ওনারা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। দুজনেই রাগী গলায় বললেন, “অনু বাড়াবাড়ি না করে আমার সাথে চল ” একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে দিয়ে আমি ওনাদের বললাম,
–আপনাদের সাথে কোন অধিকারে কোন পরিচয়ে যাব আমি? বাবা মায়ের পরিচয়ে?সন্তান হওয়ার অধিকারে?আচ্ছা আপনারাই বলুন, যে পবিত্র একটা বন্ধনের মাধ্যমে আমি পনাদের কোলে এসেছিলাম, আপনাদের সন্তান হিসেবে পরিচয় পেয়েছিলাম, সেই পবিত্র বন্ধনটাই তো আপনারা আজ ছিন্ন করলেন। তাহলে আপনাদের সাথে আমার কোন অধিকার বাকি রিল বলুন তো।আপনাদের রাগ,ঝগড়া, হিংসা, মনমালিন্য সবকিছুর মাঝে একবারের জন্যেও কি আমার চিন্তা করেছেন?
আমি জানি করেননি। তাহলে আজ কেন আমি আপনাদের চিন্তা করবো বলতে পারেন?। আমি তখনও একা ছিলাম এখনও একা আছি। আমি সে সময় যখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি, এখন এবং ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পারবো। আপনাদের কাউকেই আমার প্রয়োজন নেই। আপনারা ভালো থাকুন।
কথাগুলো বলে পাশে থাকা ব্যাগটি নিয়ে বেরিয়ে এলাম কোর্ট থেকে। এখন আমার কি গন্তব্য আমি জানিনা। কিন্তু আজ নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে। খুশি কাজ করছে আজ আমার মাঝে। আমার আগামীর পথ চলাকে শক্তিশালী করতে এই খুশিটুকুই যথেষ্ট।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প