রাতের শেষে

রাতের শেষে

বারান্দা থেকে উঠোনে তাকাতে চমকে গেলাম। হেনা খালার ছোট মেয়ে পারুল বাগানবিলাশের চারা গাছ টা ধরে টানছে। পৃথিবীতে এত খেলা থাকতে গাছ টানাটানির খেলা খেলছে কেন এই মেয়ে? আরেকটু জোরে হলেই নির্ঘাত গাছ টা উঠে যেত মাটি থেকে। বড়দা তিন চারদিন আগে এই গাছ লাগিয়েছে। এই গাছের কিছু হলে দাদা কাউকে আস্ত রাখবে? বাড়ির সবাইকে দাদা হেনস্তা করে ছাড়বে।

কেউই বাদ যাবে না। এমনকি বাড়ির সবচাইতে ভয়ানক মানুষ আমার বাবাও বাদ যাবে না। আমি হালকা গলায় পারুল কে ডাকলাম,
‘এই পারুল এই কি করিস, এইদিকে আয়। গাছটা ছেড়ে দে।’

পারুল আমার কথা শুনলো ঠিকই কিন্তু আমার দিকে একবিন্দুও তাকালো না। এবং সবসময়ের মত দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে গাছ ধরে টানতে লাগলো। এই তো একটা ডালও ভেঙে ফেললো মনে হলো।
আমি দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে পারুল কে ধরতে যাবো, তার আগেই বড়দা পারুলের কাছে একপ্রকার দৌঁড়ে এসে শক্ত করে হাত ধরে ফেললো।

পারুল মোচড় দিতে দিতে খ্যাসখেসে মত শব্দ করে বলতে লাগলো, ‘হাত ছাড়েন, হাত ছাড়েন কইলাম।’

এইটুকুন মেয়ে। বয়স কত হবে? ছয় কি সাত। অথচ তেজ কি। একদম হেনা খালার মত। আমি দাদাকে বললাম,
‘দাদা ওকে ছেড়ে দাও। ছোট মানুষ।’
দাদা পারুলের মুখে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘দূর হ এখান থেকে।’

পারুল একটুও ভয় পেলো বলে মনে হলো না। তার মাঝে দূর হওয়ার কোন সম্ভাবনাও দেখা দিলো না। পা গেড়ে দাদার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো। পারুল কাঁদছে না তারপরও কোথায় থেকে হেনা খালা ছুটে এসে বললো, ‘আপনে পারুল রে লাত্থি মারলেন কেন?’

কি আশ্চর্য! এমন ডাহা মিথ্যা কথা হেনা খালা কিভাবে বলে। আমি হেনা খালাকে বললাম,
‘আপনি সবসময় বেশি বেশি বলেন হেনা খালা। দাদা পারুলকে লাথি মেরেছে কে বললো আপনাকে?’

হেনা খালা তার মেয়েকে আদর করতে করতে বলল,
‘দুইদিন ধরে বড়লোক হয়ে পোদ্দারি করা ঠিক না।’

আর কোন কথা হলো না। পারুলকে সাথে নিয়ে হেনা খালা চলে গেলো। আমি দাদার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম খুব রাগ হয়েছে হেনা খালার কথায়।

আমি চলে আসছি, হঠাৎ দাদা আমাকে অবাক করে দিয়ে বাগানবিলাশের চারাটা এক ঝটকা টানে উঠিয়ে পা দিয়ে ভেঙে ফেললো।

আমার এত মন খারাপ লাগলো। গাছটা দাদা খুব শখ করেই লাগিয়েছিলো। দাদাকে আমি কখনোই পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝে দোতলা এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকে, প্রতিটি জিনিসকেই আমার বড় অচেনা লাগে। একটা ব্যাপার থাকে, যেখানে সবাইকে নিয়ে একটি সংসার হাসি-কান্নার মধ্যদিয়ে চলতে থাকে।
কিন্তু আমাদের পরিবারের লোকজন তেমন নয়। কতবার ভেবে দেখেছি, মনে হয় কয়েক জায়গা থেকে কয়েকজন মানুষ একত্রিত হয়ে একটা সংসার করছে। যেন শুরু থেকেই কারো সাথে আমাদের তেমন পরিচয় ছিলো না।
নাকি পৃথিবী এই নিয়মেই চলে। হাজার পরিচিত মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত অপরিচিতই থেকে যায় কি?

::দুই::
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের এলাকাটাকে মনে হয় মাঝরাত। কেমন চুপচাপ চারপাশ। মাঝে মাঝে তিন রাস্তার মোড় থেকে ওয়ার্কশপের ভারি হাতুরীর শব্দ আর থেকে থেকে ট্রাকের হর্নের শব্দ ভেসে আসে। তাছাড়া বাড়িটা এত নিশ্চুপ হয়ে যায় এ সময়টায়। মনেই হয় না এ বাড়িতে বড়দা, বাবা, মা আর হেনা খালার মত কেউ থাকে।

এমনই এক দুপুর কাটছে আজ। কি ভীষণ নির্জনতা। সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুম। আমি চেয়ার পেতে বসে আছি বারান্দায়। হঠাৎ আমার পিলে চমকে দিয়ে কে যেন গেট ধাক্কা দিলো। সাড়া বাড়ি ঝমঝম করে উঠলো। আমি গেট খোলার আগেই ধাক্কা মেরে গেট খুলে বড় আপা ঢুকলো। হাতে ঢাউস এক স্যুটকেস। সাথে আপার যমজ দুই ছেলে।

আপাকে অনেকদিন পর দেখলাম। তবু তেমন কোন অনুভূতি ভর করলো না আমার ভেতর। কারণ আপার সাথে আমার সম্পর্ক বাবা বাদে বাড়ির অন্য সবার মতই। যেখানে সম্পর্ক আছে। কিন্তু মায়া, আবেগ, ভালোবাসা, টানের বড়ই অভাব।

এগিয়ে গেলাম। সাথে সাথে আপার দুইছেলে আমার দুহাতে ঝুলে পড়লো। কোন টু শব্দ করলো না। যেন সারাপথ ওদের মা শিখিয়ে শিখিয়ে এনেছে, নানুবাড়ি গিয়ে যাকে দেখবি তাকেই তোরা দুইভাই দৌঁড়ে গিয়ে দুহাত ধরবি।

আপা স্যুটকেস বারান্দায় রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
‘কেমন আছো আপা?’
‘ভালো। তোকে দেখতে এলাম মিঠু। কেমন আছিস?’

বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। আমার সন্দেহ সত্যি হলো। সাথে সাথে রিন্টু আর মিন্টু দৌঁড়ে বাবার হাত ধরে ফেললো।
বাবা আপাকে বললেন,
: ‘মিঠুকে দেখতে এলি মানে? মিঠুর কি হয়েছে?’ আপা অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে কাটাতে বলল,
: ‘কেন মিঠুর হাত ভেঙে গেছে না?’

বাবা বললেন,
: ‘সে তো দুমাস আগের কথা। মিঠুর হাত সেরে গেছে কবে। মিথ্যা বলছিস কেন?’

: ‘বাবা আমি কি তোমাদের বাড়িতে বেড়াতেও আসতে পারি না? বিয়ে দিয়ে তোমরা কি আমাকে পর করে দিয়েছো?’

:’বেড়াতে আসতে অবশ্যই পারিস। কিন্তু মিথ্যা বলবি কেন? বেড়াতে আসলে যতদিন খুশি থেকে যা। কোন সমস্যা নাই।’

বাবা রিন্টু আর মিন্টু কে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। আমি আপার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আপা আগের থেকে অনেক চিকন হয়ে গেছে। এত বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়েছে আপার। আমাদের বাড়ি থেকেও আলিশান বাড়িতে থেকে আপার স্বাস্থ্য আরো ভালো হওয়ার কথা। ধনীদের যেসকল সুযোগ সুবিধা থাকে তার সবই আছে ও বাড়িতে। আপা অমন সুযোগ-সুবিধা ফেলে এতবড় স্যুটকেস নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে, এমন কখনো হয়নি। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে। আপার হাত ধরে বললাম,
‘কী হয়েছে আপা? আমাকে বলবে না?’
‘কিছু হয়নি মিঠু। তোর দুলাভাই ব্যবসার কাজে কয়েকমাস বাইরে থাকবে, তাই ভাবলাম তোদের সাথে কিছুদিন থাকি। তোদের সাথে তো এখন আর থাকাই হয় না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কয়েকমাস?’
আপা আমার কাছ থেকে চলে যেতে যেতে বলল, ‘হ্যাঁ,তোর কোন সমস্যা?’

আমার এই শিরিন আপাও অনেক চেনার মাঝে অনেক অচেনা। এই তার মেজাজ ভালো, এই তার মেজাজ খারাপ। বুদ্ধির দিক দিয়ে আপার যোগ্যতা যে শূন্যে, তা আমি ছোটবেলা থেকেই জানি। তাই সব কিছু গা সওয়া হয়ে গেছে। আপার আচার আচরণে তাই আমার তেমন কিছু এসে যায় না।

বাবা শিরিন আপা কে একটা নাম দিয়েছিল অনেক আগে। মিথ্যারানী। আগে মিথ্যারানী বললেই আপা কেঁদেকেটে একাকার করতো। এখনও আপা, আমি আর বড়দা একসাথে হলে বড়দা যেভাবেই হোক আপাকে মিথ্যারানী বলে কাঁদাবেই। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগতো। সেই দিন গুলো আর নেই। দাদা এসবে আর মজা পায় না এখন। দাদার মজার ধরনগুলো আশ্চর্যজনকভাবে বদলে গেছে।

সন্ধ্যার পর বাইরে থেকে একটু ঘোরাফেরা করে বাসায় ফিরছি, দেখলাম তিন রাস্তার মোড়ে চা’য়ের দোকানে দুলাভাই চা খাচ্ছেন। আমি এত অবাক হলাম। দুলাভাই হাসতে হাসতে খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘চলো মিঠু বাসায় ঢোকা যাক।’

ঘটনা পরিষ্কার হলো। দুলাভাইয়ের সাথে ঝগড়াঝাটি করে আপা চলে এসেছে। আপার মিথ্যা বলা ধরা পড়ে গেছে এই কারণেই হয়তো আপা সারাক্ষণ দরজা আটকে বসে থাকলো তার ঘরে।

এমনকি রাতেও দুলাভাইকে আপা তার রুমে ঢুকতে দিলো না। দুলাভাই আমার সাথে ঘুমালেন রাতে।
রাগারাগির কারণ হিসেবে দুলাভাই আমাকে জানালেন আপার নাকি ধারণা দুলাভাই অফিসের পাপিয়া নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করে বসে আছেন। পাপিয়ার নাকি আবার বাচ্চাও হবে। আমি ঘুমানোর আগে দুলাভাইকে বললাম, সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে দুলাভাই, ঘুমান। এমনও হতে পারে মাঝ রাতে আপা আপনাকে নাকি নাকি সুরে ডাকতে আসবে।

আপা রাতে দুলাভাইকে ডাকতে এলো না। সকালে কিছু ঠিক হয়েও গেলো না। বরং আরো ঝামেলা তৈরি হলো। বিরাট এক চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো বাড়িতে। এক পর্যায়ে আপা দুলাভাইকে তুই তোকারি করতে লাগলো। অবশেষে দুলাভাই সকালের নাস্তা খেয়ে আপাকে ছাড়াই বিদায় নিলেন।

দুলাভাইয়ের উপর আপার যে রাগ, তা আপা আমার উপর দিয়ে তুললো। দুপুরে খাবার টেবিলে চুপচাপ খাওয়া হচ্ছিলো। হঠাৎ আপা বললো ,
‘মিঠু আমি তোর কাছে বেশি আপন নাকি তোর দুলাভাই?’

আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। হুট করে এসব কী কথা? বাবা বাড়িতে থাকলে আপাকে থামিয়ে দিতেন। মা আর ভাইয়া কিছু বলল না এ ব্যাপারে। পাশের বেসিনে হেনা খালা মুখ টিপে হাসছেন। আমি আপাকে বললাম,
‘আপা চুপ করে খাও। পরে কথা বলো।’
আপা শুধু শুধু আমার উপর চটে উঠলো, ‘তোর মন অনেক ছোট মিঠু। একদম ছোটলোকের মত। বল কে বেশি আপন?’

আপা কথাগুলো এত স্বাভাবিকভাবে বললো যেন এসব বলতে আপার কোনরকম বাঁধছে না। যেন আমি হেনা খালার মত এ বাড়িতে কাজ করি।
সত্যি সত্যি আমার মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো। এই রঙচঙা বাড়ি, এই দামী দামী খাবারগুলো এমন বিষাদ লাগতে লাগলো আমার। আমি খাওয়া বাদ দিয়ে আপাকে বললাম,
‘তুমি আমার কাছে বেশি আপন আপা।’
‘তাহলে আমার কথা বিশ্বাস না করে তোর দুলাভাইয়ের পক্ষ নিলি কেন?’
‘আমি তো পক্ষ নেইনি। তুমি প্রমাণ ছাড়া শুধু শুধু কেন সন্দেহ করে চলে এসেছো?’
‘চলে এসেছি তাতে তোর এত সমস্যা কোথায়? তোর টাকার বাড়িতে এসেছি? তোর টাকার খাবার খাচ্ছি?’

এরপর আর কোন কথা বলা যায় না। আমি খেতে পারলাম না দুপুরে। আমার রুমে চলে আসলাম। আসলে আমার দোষ কোথায় আমি অনেক ভেবেও খুঁজে বের করতে পারলাম না। অন্তরালের কোন এক গহীন কষ্ট আমাকে বারবার ছেঁয়ে ফেলতে লাগলো।

মা আমার ঘরে খাবার নিয়ে এলো। গলা দিয়ে খাবার নামছে না, তারপরও মাকে খুশি করতে একটু খেয়ে নিলাম। মাকে বললাম,
‘মা, আমার খুব মন খারাপ লাগছে। আমি একটু এ বাড়ি থেকে আড়ালে থাকতে চাই। হাসানদের বাড়িতে যাচ্ছি। আজ রাতে থেকে যাবো। বাবা আসলে বলো।’

মা বরফজমা শীতল কণ্ঠে বলল,
‘গাড়ি নিয়ে যা। গাড়ি বের করতে বলি?’
‘না মা। আমি রিকশা করেই যাবো।’

মা চলে গেলো। আমার মনে হলো মা যদি আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতো, তাহলে কিছুটা ভালো লাগতো আমার। মা আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে ভালোবাসা আমার কাছে খুবই কম মনে হয়। মা কি পারতো না আপাকে থামিয়ে দিতে? পারতো না আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে, ‘মিঠু কোথাও যাওয়ার দরকার নাই।’

::তিন::
বরাবরের মতই হাসানদের বাড়ির সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে আমি হাসানের শোবার ঘরে নির্বিকার বসে রইলাম। হাসান উশখুশ করতে লাগলো। ওর চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে ও আমাকে বলতে চাইছে ‘মিঠু কখন যাবি? এখনও বসে আছিস কেন? চলে যা।’

হাসানদের বাড়ির সবার ধারণা আমরা বিরাট ধনী। হাসানদের বাড়ি-ঘর, খাবার-দাবার, পরিবেশ হয়তো আমাকে সমস্যায় ফেলবে। অথচ তার কিছু না। শান্তিতে থাকার জন্য যে তিনটা জায়গা আমার খুবই প্রিয় তার মধ্যে হাসানদের বাড়ি একটা।
আরো ভালো লাগে তখন, যখন হাসানদের অস্বস্তির মাত্রা কঠিন হতে থাকে, আর আমার স্বাভাবিকতা ততই হাসানদের বাড়ির কোন সদস্যের মত হতে থাকে। একসময় এ বাড়ির সবাই আমাকে খুব সহজভাবে নেয়। হেসে হেসে কথা বলে। হাসানের বাবা জীর্ণ শরীর নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়ে রাজ্যের গল্প শুরু করে। হাসানের বোন ছন্দা- ভাইয়া ভাইয়া করে আমাকে অস্থির করে ফেলে। তখন অনন্তকালের মত এ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করে আমার। মনে হয়, ইশ আমার যদি হাসানের মত এমন অভাবী কোন পরিবারে জন্ম হত!

রান্নাঘরে ঢুকে হাসানের মাকে বললাম, ‘খালা আমি আজ আপনাদের বাসায় রাত থাকবো। প্লিজ অস্থির হবেন না। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি কিছু বাজার করতে চাই। রাতে রান্না করবেন। আমরা সবাই মজা করে খাবো। যদি না করেন তাহলে কিন্তু আমি আপনার পায়ে ধরবো।’

হাসানের মা হেসে ফেললেন। কি প্রচ্ছন্ন হাসি। আমার মা কি কখনো আমার দিকে তাকিয়ে এভাবে হেসেছে?

হাসানকে নিয়ে বাজার করে ফিরে দেখি আমার জন্য বিছানায় নতুন চাদর বিছানো হয়েছে। আলনা গুছিয়ে রেখেছে কেউ। কি সুন্দর ছিমছাম লাগছে হাসানের রুম। ইচ্ছা করছে হাসানকে বলি, ‘হাসান আয় এক মাসের জন্য আমরা রুম বদলাবদলী করি। তুই আমাদের বাড়ি থাকবি, আর আমি তোদের বাড়ি।’

সবচেয়ে অবাক হলাম হাসানের বাবার ঘরে ঢুকে। দেখলাম সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী পরে বিছানায় পা উঠিয়ে আমার বাবা বসে আছেন। আমি বাবাকে দেখেই প্রথমে যে কথাটা বললাম তা হলো, ‘বাবা আমি কিন্তু আজ এখানে থাকবো। নিতে এসে কোন লাভ নেই।’
বাবা এত সুন্দর করে নিশ্চয়তার একটা হাসি দিলো যে আমার ইচ্ছা হলো ছুটে গিয়ে বলি, ‘বাবা তুমি না থাকলে আমি কবেই মরে যেতাম।’

রাতে বাবা আমাদের সাথে অনেক গল্প করে, খেয়ে বিদায় নিলেন। হাসানের বাবাকে কথা দিয়ে গেলেন ছন্দার জন্য ভালো একটা ছেলে দেখে রাখবেন। ছন্দার বিয়ে নিয়ে তিনি যেন কোন টেনশন না করেন।
এমন ব্যবহারের জন্য মনে মনে আমি বাবাকে অজস্র কৃতজ্ঞতা জানালাম।

::চার::
বেশিরভাগ দালানবাড়িগুলো বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হয়। কিন্তু আমাদের বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে একদম স্কুল ঘরের মত। দেখেই বোঝা যায় অপরিকল্পিতভাবে বানানো। তবে বাড়ির ভেতর টা সুন্দর। নিচ তলায় বিশাল বারান্দার সামনে বাগান। চারদিকে ঘেরা। দোতলার পুরোটা ভাড়া দেয়া। ভাড়াটিয়াদের সাথে আমাদের তেমন কথাবার্তা হয় না। কারণ মায়ের কারণে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো না। প্রায় দিনেই শুনি মা উপরে গিয়ে গলা চড়িয়ে বলছে, ‘এত দাপাদাপি করে কেন বাচ্চারা? নিষেধ করেন না? একদিন তো সব ভেঙেচুড়ে মাথায় পড়বে।’
‘চেয়ার টেবিল নিয়ে এত ধাক্কাধাক্কি করেন কেন?’
‘পানির কল শুধু শুধু ছেড়ে রাখেন কেন?’
এইসব হাবিজাবি ধরনের কথা।

সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে কেমন অস্থির অস্থির মনে হয় এবাড়ির সবকিছুতে। অথচ হাসানের ধারণা এটা রাজবাড়ির মত অসাধারণ রূপ-জৌলুস আর সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরা জায়গা। আসলেই কাশবন দূর থেকে ঘন মনে হয়।

হাসান এর আগে আমাদের বাড়িতে কয়েকবার এসেছে। আমি জোর করেই এনেছি। ওর কি এক বিচিত্র কারণে এ বাড়িতে আসতে লজ্জা করে। আসতে চায় না।

আজ একপ্রকার জোরাজুড়ি করেই ওকে নিয়ে আসলাম।
বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই হাসানকে দেখলাম পারুলের সাথে বাগানের এককোণে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম এ বাড়ির সবার কাছ থেকে আড়ালে থাকতেই ও ওই জায়গা টা বেছে নিয়েছে। অথবা পারুলের সাথে কথা বলতেই হয়তো ও বেশি সাচ্ছন্দবোধ করে। অস্বস্তিকর পরিবেশে মানুষ নিজের থেকে নিম্নস্তর অথবা সমপর্যায়ের মানুষগুলোকে খড়কুটো মনে করে। নিজেকে জলে ডোবা অসহায় মনে করে সেটাকেই আগলে রাখতে চায় ।

কালকের পর থেকে আপার সাথে আর কথা হয়নি। আমি কোনদিনও আপার সাথে রাগ করে দুদিনের বেশি থাকতে পারিনি। তাই হাসানকে বাগানেই বসিয়ে রেখে আপার রুমে সামনে চলে এলাম। পর্দা ধরে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে বললাম,
‘আপা আসবো।’ আপা চমকে উঠলো। হয়তো ভেবেছে আমি অনেকদিন আপার উপর অভিমান করে থাকবো। হেসে বললো,
‘আয় মিঠু। অনুমতি নিচ্ছিস কেন? আমি কি তোর পর?’
আমি আপার পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম,
‘বাবুরা কই?’
‘দোতলার বাচ্চাদের সাথে খেলছে।’ প্রসঙ্গে পাল্টে বললাম,
‘আপা হাসান এসেছে। এ বাড়িতে এসে ও খুব অস্বস্তি নিয়ে থাকে। তুমি কি ওর সাথে একটু গল্প করবে? এমনভাবে কথা বলবে, যেন ও ভাবে তুমি ওর খুব আপন।’

আপা উজ্জ্বল চাহনি নিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সুন্দর করে হেসে বললো,
‘যা ডেকে নিয়ে আয় আমার ঘরে।’ তারপরেই হঠাৎ মনে হয়েছে, এমন করে বললো,
‘ওহ মিঠু দাঁড়া একটু। তোর জন্য দুটা গিফট এনেছি। ঝগড়া-ঝাটি করতে করতে দিতে ভুলে গিয়েছি।’

আপা স্যুটকেস খুলে হাতে কাজ করা একটা পাঞ্জাবী আর একটা সেন্টের বোতল ধরিয়ে দিলো আমাকে। আমি অবাক হলাম। আপা এমন কখনো করেনি আমার জন্য।

হাসানকে এনে আপার ঘরে বসিয়ে দিলাম। আপা হাসানের সাথে সত্যি সত্যি অবাক করা ব্যবহার করলো। হাসানের কাঁধে হাত রেখে কথা বললো, যেন কতদিনের চেনা। এক পর্যায়ে ড্রয়ার খুলে পাঁচশ টাকা বের করে খুবই বিনয়ী হয়ে হাসান কে বললো,
‘ভাই এই টাকাটা দিয়ে আমার হয়ে একটা উপহার কিনে নিবে। মনে করো তোমার বড় বোন তোমাকে দিয়েছে। একদম অস্বস্তি বোধ করবে না।’

আপা হাসানকে মুহূর্তের মধ্যে এত স্বাভাবিক করে আনলো যে হাসান হাসিমুখে টাকাটা নিয়ে পকেটে রেখে দিলো।
আমি আপার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ হলাম এবং মনে মনে আপার সারাজীবনের অপরাধগুলো ক্ষমা করে দিলাম।

::পাঁচ::
সময় মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার অনেক পরিবর্তন ঘটায়। কোথাও কোথাও পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে, আবার হয়ত কখনো কখনো কোন কিছুর পরিবর্তনই হয় না।

প্রায় নয় মাস হয়ে গেলো দেখতে দেখতে। আপা ওর বাড়িতে ফিরে গেলো না। এর মাঝে দুলাভাই একদিন এসে আবার হৈচৈ করলেন। আপা কে ভয়ভীতি দেখালেন কেসটেস করবেন। বাচ্চা দুটাকে নিয়ে যাবেন।
আপা খুব স্বাভাবিকভাবে দুলাভাইকে বলে দিলো,
‘বাবুদের তুমি নিয়ে যাও। তোমার চরিত্র ঠিক না হলে আমি ফিরে যাবো না।’

আপাকে শাস্তি দিতেই হবে হয়ত দুলাভাই রিন্টু আর মিন্টু কে নিয়ে চলে গেলেন। আপার মাঝে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ করলাম না। বরং দেখে মনে হলো আপা ঝামেলামুক্ত হয়েছে। এবার আয়েশ করে থাকা যাবে।

আমার বড়ভাই শাহীনের মাঝে বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্যণীয় হলো। ঠিকমত বাড়ি আসে না। কোথায় থাকে কে জানে। বাড়ি যেটুকুন থাকে ততক্ষণ বাবার কাছে টাকা পয়সা চাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে থাকে। লোকমুখে শুনি দাদা নাকি গাঁজা খাওয়া ধরেছে। খারাপ জায়গাতেও নাকি যায়। বাবা বিশ্বাস করে এসব। আমি, মা আর আপা এসব বিশ্বাস করি না।

এরমাঝে একদিন খুব সকালে বাবার সাথে কথা কাটাকাটি করে দাদা কোথায় চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো আর নাকি বাসায় আসবে না। আমরা ঠিক জানি দুপুর হলেই দাদা কোথায় থেকে হাজির হয়ে সোজা খাবার টেবিলে বসে বলবে, ‘খাইতে দাও। ডিম ভাজবা ঝাল করে।’

সন্ধ্যা হয়ে গেলো দাদা আসলো না। অন্যান্যদিন তেমন চিন্তা হয় না। কিন্তু মা খুব অস্থির হয়ে গেলো আজ। আমি নিজেই সন্ধ্যার পর খুঁজতে বের হলাম। পঙ্কজ দা’র কাছে শুনলাম দাদা নাকি স্কুলের পুরাতন বিল্ডিঙে জুয়া খেলছে। কি আশ্চর্য! দাদা কোন খেলাই পছন্দ করে না। আর এ তো জুয়া!

আমি অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে স্কুলের পুরান বিল্ডিঙে ঢুকে দেখি উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা নিয়ে মোমবাতির সামনে দাদা বসে বসে সিগারেট টানছে। কি বিশ্রী গন্ধ তার ধোঁয়াতে। পাশেই চার-পাঁচ জন টাকা নিয়ে তাস খেলতে বসেছে। আমাকে দেখে সবাই খুবই অবাক হলো। আমি নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। দাদাকে বললাম,
‘মা খুব চিন্তা করছে। বাড়ি চলো দাদা।’
‘তুই যা, আমি আসছি।’ বলেই দাদা ভেতরের দিকে কোথায় চলে গেলো।

বাসায় এসে আমি কিছুই বললাম না। রাতে টেবিলে খেতে বসেছি আমি আর আপা। তখন দাদা আসলো। জুয়াতে হেরে গেছে সেই রাগ অথবা তার কীর্তি আমি দেখে ফেলেছি এই রাগেই হোক, দাদা করলো কি কোন কথা না বলে প্রায় দৌঁড়ে এসে এক লাথি দিয়ে আমাকে চেয়ারসহ মেঝেতে ফেলে দিলো।

ভাতের প্লেট শব্দ করে মেঝেতে পরে ভাত ছড়িয়ে গেলো। আমি এত ভয় পেয়ে গেলাম যে কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। আপা ‘শাহীন, শাহীন, খবরদার’ বলে চেঁচাতে লাগলো। আমি উঠে বসতে বসতে বাবা এসে দাদাকে মারতে উদ্ধত হলেন। দু’একটা চড় দিয়েও দিলেন। আমি বাবাকে জাপটে ধরে ‘বাবা ছেড়ে দাও’ বলতে লাগলাম বারবার। নিমিষেই লোক জমে গেলো।
দোতলা থেকে সবাই নিচে নেমে এলেন। কি লজ্জা!

রাতে আমার একটুও ঘুম হলো না।
রাত তিনটার দিকে কে যেন দরজায় টোকা দিতে লাগলো। দরজা খুলে দেখি দাদা। এইমাত্র গোসল করেছে সম্ভবত। দেখতে একদম দেবশিশুর মত লাগছে।

বললাম,
‘কী হয়েছে দাদা?’
দাদা মন খারাপ করা গলায় বললো,
‘মাথা একদম ঠিক ছিলো না মিঠু। আমাকে মাফ করে দে। তুই মাফ না করলে আজ রাতে আমার আর ঘুম হবেনা।’

স্পষ্ট দেখলাম দাদার চোখভর্তি জল। হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলাম দাদাকে।
আমি দাদাকে নিয়ে সেদিন আমার রুমে ঘুমালাম। সারারাত দাদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। শত জনমের ঘুম না হওয়া রোগীর মত বাকি রাতটুকু দাদা পরম নিশ্চিন্তে অঘোরে ঘুমালো। ভোর বেলা দাদা খালি পেটে প্রচণ্ড শব্দ করে বমি করে আমাদের সবাইকে ভয় পাইয়ে দিলো। বড় আপা ভয়ার্ত মুখে কি কারণে জানি বারবার বলতে লাগলো, ‘বিষ খাইছে নাকি? এমন করে কেন?’

দাদা বিরক্ত হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললো, ‘আপা তোমার সমস্যা কী? থামবে?’

::ছয়::
প্রায় রাতেই দাদা এমন বিশ্রী বমি করে ঘর ভাসাতে লাগলো নিয়ম করে। যেন বমি না করলে দাদার জীবনই বৃথা। বাবার ধারণা মদ, গাজা খেয়ে এসেই এমন হচ্ছে। অবিশ্বাস করার মত কিছু না। দাদা ইদানিং এসব নিয়মিত খেয়ে বাসায় ফিরছে। আর বাসায় এসে প্রতিদিন বমি। আমরা সবাই মহা চিন্তায় পরে গেলাম।

জীবনের কিছু ঘটনা যেমন হুটহাট ঘটে যায়, তেমন কিছু সিদ্ধান্তও হুটহাট নিতে হয়। বাবা তেমনই একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। দাদাকে বিয়ে দেবেন। বিয়ে দিলে নাকি সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
কোনরকম আয়োজন ছাড়া দাদাকে না জানিয়ে একদিন সব কিছু ঠিকঠাক। বাবা, আমি আর আপা মিলে একদিন মেয়েকে দেখে এলাম। এত সুন্দর একটা ভাবি পেতে যাচ্ছি যে আমি খুবই খুশি হলাম। আবার মনে হতে লাগলো আমরা এই সহজ সরল মেয়েটার প্রতি কোন অবিচার করছি না তো?

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার বিয়ের কথা শুনে দাদা কোনরকম ঝামেলা করলো না। আমি ভেবেছিলাম এ নিয়ে দাদা পুরো পৃথিবী এক করে ফেলবে। অথচ দাদা খুব সহজ স্বাভাবিকভাবে বাবাকে জানিয়ে দিলো, ‘ওকে ঠিক আছে করবো বিয়ে। ডেট পরার দুই দিন আগে আমাকে জানিও।’

খুব ঘরোয়া আয়োজনে দাদার বিয়ে হয়ে গেলো এক শুক্রবার। বিয়ের পর সুবিধার এক নম্বর বিষয়টা আমাকে ঘিরে হলো।
নতুন ভাবি আমার প্রতি যে ভালোবাসা, আদর, মমতার সম্ভার ছড়িয়ে দিলো তাতে ভাবির প্রতি শ্রদ্ধায় আমি এত নত হয়ে গেলাম। বারবার ভাবতে লাগলাম মেয়েরা কেন এত মমতাময়ী হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে দাদার মাঝেও আমূল পরিবর্তন। দাদা নিয়মিত বাবার ব্যবসা দেখতে দোকানে গিয়ে বসে। আগের মত হাবিজাবি খায় না।
মাঝে একদিন দাদা আমাকে, আপাকে আর ভাবিকে সিনেমা দেখতে নিয়ে গেলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এই তো আমাদের জীবন কত সুন্দর। কত সুখ বেঁচে থাকাতে।

এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে সময়ে-অসময়ে দাদা আবার বমি করে ঘর ভাসাতো। আমরা সবাই যখন দাদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম দাদা তখন ব্যাকুল হয়ে বলতো,
‘বিশ্বাস করো আমি কিছুই খাইনি। আল্লাহর কসম। বিশ্বাস করো আমাকে।’

আমি দাদার দিকে শতভাগ বিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। দাদার প্রতি ভালোবাসা, টানা আর মায়ার যন্ত্রণায় আমার ভেতরটা কেঁদে উঠতো। ইচ্ছা করতো চিৎকার করে বলি, ‘দাদা তোমাকে ভালোবাসি। বড় ভালোবাসি তোমাকে।’

::সাত::
কি মনে করে কে জানে একদিন সকালে আপা স্যুটকেস গুছিয়ে বললো, ‘মিঠু আমার বেড়ানো শেষ । আমি এখন চলে যাবো। তোর দুলাভাই একশটা বিয়ে করলেও আমি ও বাড়িতেই থাকবো। আমি ওকে ছেড়ে দেবো কেন? আমাকে ও চেনে না। আমাকে পেয়েছে কী ওই শুয়োর।’

আপা চলে যাওয়াতে আমার এত কষ্ট হলো যা বলে বোঝাবার নয়। আপা আমাদের ভাই বোনদের সবার বড়, অথচ বুদ্ধিতে এখনও ছোট বাচ্চাদের মত। আপা চলে যাওয়ার পর নামাজে বসে হাত তুলে কতবার সৃষ্টিকর্তাকে বলেছি, আল্লাহ আমার আপাকে বুদ্ধি দাও। ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা দাও।

আপার শূন্যতায় আমি কষ্ট পাচ্ছি ভাবি এটা বুঝতে পারলো। আপার জায়গা পূরন করার শত চেস্টায় তার সময় কাটতে থাকলো।

এর ছয় সাত মাস পর ভাবি আমাদের জানালো তার মা হওয়ার সংবাদ। এই সংবাদে আমাদের বাড়িটা ঝলমল করে উঠলো। একগাদা মিষ্টি কিনে মা দোতলায় বিলাতে গেলো আমাকে নিয়ে। মা এত খুশি হলো যে বাচ্চারা মায়ের সামনে দাপাদাপি করছে অথচ মা কিছুই বললো না। ভাবিকে আমার কেবলই মনে হতে লাগলো একেই বুঝি লোকে বলে -ঘরের লক্ষ্মী।

যারা অন্যের সুখ দেয়ার জন্য পৃথিবীতে আসে, তারা হয়তো সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। একারণেই হয়ত ভাবির সুখ স্থায়ী হলো না। দাদার সম্ভবত খুব বড় একটা অসুখ ধরা পড়লো। এত ঘন ঘন বমির কারণ হিসেবে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে ধরা পড়লো এটা। আমাদের পৃথিবীটা সাময়িক সময়ের জন্য ঝলমলিয়ে আবার মেঘে ঢেকে গেলো।

দাদা হাসপাতালে ভর্তি। দেশে চিকিৎসা হবে না। বিদেশ নিতে হবে। টাকা পয়সার কোন সমস্যা না। তবু আমাদের চিন্তা যদি কিছু হয়ে যায় তখন?

সব কিছু ঠিকঠাক করতে লাগলো বাবা। আবার বাড়ি ভর্তি লোকজন, আত্মীয়-স্বজন। আমার কেমন জানি লাগতে লাগলো এত মানুষজন দেখে। সমস্যা কি এতই গুরুতর যে কারণে সবাই দাদাকে দেখতে আসছে? এত তাড়াতাড়ি কারো জীবনে এতবড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। দাদা বাঁচবে তো?

বিদেশ নেবার আগে দাদাকে বাড়িতে আনা হলো। আমি সারাক্ষণ দাদার পাশে বসে টুকটুক করে গল্প করি । দাদা আমার হাত চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলে, ‘লিভার পঁচে গেছে বুঝলি? কোন টেনশন নিস না। বিদেশের হাসপাতাল গুলো মরা মানুষ তাজা করতে পারে।’

সোমবারদিন রাতে দাদার পাশে বসে আমি, ভাবি আর আপা বারোটা পর্যন্ত অনেক গল্প করলাম। দাদা খুব মজা করলো। অনেকদিন পর আপাকে দাদা মিথ্যারানী বলে ক্ষ্যাপাতে চেস্টা করে বিফল হলো।
‘আপা তুই কত মিথ্যুক ছিলি মনে আছে? একবার রাজীব ভাইকে নিয়ে কত জঘন্য একটা মিথ্যা বলেছিলি। রাজীব ভাই নাকি তোকে…. হা হা হা হা। মিথ্যারানী কাকে বলে।’

সবাই বিদায় নিয়ে যার যার ঘরে চলে গেলাম। কি হয়েছিলো কে জানে, রাতের শেষে যখন চারপাশে ফজরের আযান হচ্ছে তখন খুবই শৃঙ্খলভাবে চুপচাপ আমার বড়দা মারা গেলো।

::আট::
দাদার মৃত্যু শুধু আমাদের কষ্টই দিলো না। আমাকে বিরাট একটা ঝামেলাতেও ফেলে দিলো। দাদার মারা যাবার আরো কয়েকমাস পর সবাই আমাকে অস্বস্তির সাগরে ভাসিয়ে জানালো আমাকে নাকি কনা ভাবিকে বিয়ে করতে হবে। কিছুদিন পর কনা ভাবির বাচ্চা হবে। দাদার স্মৃতি আর কনা ভাবির কম বয়সের কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত। আমি এত আশ্চর্য হলাম যা বলে বোঝাবার বাইরে। ভাবিকে আমি যে রকম শ্রদ্ধার চোখে দেখি তাতে ভাবিকে নিজের বউ হিসেবে দেখার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।

আমি ভাবতে লাগলাম তাদের কথা, যারা আমার মত সমস্যার সম্মুখীন হয়। হয়ত তাদের ভালোবাসার মানুষ আর চরম অস্বস্তির বলিদান দিয়ে বিয়ে করে ফেলতে হয় তাদের ভাবিকে। কিন্তু আমি কোনভাবেই এটা পারবো না।
রাতের পর রাত হয়তো কনা ভাবিকে স্পর্শ করা ছাড়াই আমি পার করে দেবো। সেটা হবে কনা ভাবির একা থাকার চেয়েও বড় কষ্টের ব্যাপার।

আমার পরম নির্ভরতার জায়গা যেখানে তা হলো আমার বাবা। সেই বাবাও আমার প্রতি বিরূপ আচরণ করতে লাগলেন। চাপ প্রয়োগের সম্পূর্ণটুকুই বাবা করতে লাগলেন আমার উপর। মা বারবার বলে আমি নাকি এই পরিবারকে, আমার ভাইকে ভালোবাসি না তাই এমন করছি। আমি কিভাবে বোঝাই দাদাকে আমি কত ভালোবাসি? আমার অস্থিরতা কোন পর্যায়ে চলছে?

ভাবি আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো হয়তো। আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলো। সবাইকে জানিয়ে দিলো ভাবি এভাবেই থাকতে চায়। ভাইয়ার শেষ স্মৃতিকে নিয়েই তার সময় পার হয়ে যাবে।

এতে হীতে বিপরীত হলো। বাবা শেষ সিদ্ধান্ত জানালেন আগামী শুক্রবার বাড়িতে কাজী ডাকিয়ে বিয়ে দিবেন আমাদের। সেই সাথে বাবার সকল সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবেন।

আমি একটা জীবন বাঁচাতে দুটি জীবন নষ্ট করার পক্ষে নই। তাই শেষ প্রতিবাদ হিসেবে বাড়ি থেকে পালিয়ে কিছুদিন অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

শুক্রবার বিয়ে। বুধবার রাতে আমি ঘর ছাড়বো। বুধবারেই আপা হাজির। আপার মন খুব ভার দেখলাম। রাতে আমার ঘরে এসে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে বললো, ‘মিঠু, বাবা নাকি তোর একার নামে সব লিখে দিচ্ছে?’

আপার কণ্ঠ আর চাহনিতে অজস্র হিংসা আর ঘৃণা ঠিকরে বের হচ্ছে। আমার মানসিক অবস্থা আপা বুঝতে পারলো না। বুঝতে পারলো না তার ছোট ভাইয়ের খুব ইচ্ছা করছে মরে যেতে। আমি বললাম,
‘আপা এসবের প্রতি আমার একটুও লোভ নেই। সব তোমাদেরই থাকবে।’

আপার বুদ্ধি আর সংযম ধরে রাখতে না পারার সীমা এক পর্যায়ে ছাড়িয়ে গেলো। আপা বিছানায় পা উঠিয়ে বসে বললো,
‘বাবার ছোটবোন নূরী ফুপুর ছবি দেখেছিস তো। মনে আছে?’
আপা কিসের মধ্যে কি বলছে কে জানে। বললাম,
‘হ্যাঁ ছবি দেখেছি। ওনাকে তো আমি দেখিনি। মারা গেছে তো।’

‘ফুপু মারা যাওয়ার সময় তার একটা ছেলে ছিলো। দু মাস বয়সের। নাম পিনু।’

আমি অবাক হয়ে আপার দিকে তাকালাম।
‘কই কখনো বলোনি তো? উনি কোথায় থাকেন?’

আপা খুবই কাঁপা গলায় বললো,
‘পিনু হচ্ছিস তুই। বাবা তোকে আমাদের কাছে নিয়ে আসে। তাছাড়া তোকে মানুষ করার কেউ ছিলো না।’

আমি আপার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। আজ এতদিন পর আপা এসব বলছে কেন? আমি ফিসফিস করে বললাম,
‘আপা তুমি মিথ্যা বলছো। আমার খুব ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ বলো তুমি মিথ্যা বলছো।’

::নয়::
আজ রাতের আঁধার একটু বেশি কালো। কি ভীষণ অন্ধকার। যেন জমাট বেঁধে আছে। আমার বুকের ভেতর ঠিক এমন এক জমাট অন্ধকারময় কষ্ট। যা নিয়ে আমি খালি হাতে বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আর কখনো না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে। উদ্ভ্রান্তের মত পা পড়ছে ফুটপাথের রাস্তায়।

সত্যি আমি আর ফিরে যাবো না। কোথায় যাবো তাও জানি না। আবার হয়তবা ফিরেও যাবো। এমনকি হতে পারে না যে ভোরবেলা আপা আর বাবা ব্যাকুল হয়ে আমাকে খুঁজে বের করে আমাকে খুশি করতে বলবে, ‘সব মিথ্যা মিঠু। সব মিথ্যা। চল বাড়ি ফিরে চল।’

আমিও হয়ত তাদের কে খুশি করতে কনা ভাবিকে বিয়ে করবো। পরম শ্রদ্ধার একজনের বুকের মাঝে সারারাত মুখ গুঁজে নোংরা সুখ খুঁজবো। পৃথিবী কি তাহলে এমনই?

আমি অনেক কষ্টে আছি। রাত ফুরাবার খেলায় হাঁটছি পথে পথে। রাতের শেষে কি হবে জানি না। হয়তবা রাতের শেষে হারিয় যাবো কোথাও। যেখানে রাতের কোন শেষ নেই।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত