হেমন্তের ঝরা পাতা

হেমন্তের ঝরা পাতা

নিতাই পায়ে পায়ে গিয়ে মাঠটার কোনে গিয়ে একটু চুপ করে দাঁড়ায়।ছেঁড়া কাগজের টুকরো, শালপাতা এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে।সমস্ত পসারী

তাদের মালপত্র বাঁধাছাঁদা করে গাড়িতে তুলে বিদায় নেবার জন্যে রেডি।একে একে সকলেই তাদের গাড়ি ছেড়ে বিদায়ও নেয়।মাঠের মধ্যে শুধু ফাঁকা প্যান্ডেলটা

একবুক নির্জনতা নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে। এক গাড় অন্ধকার ঘিরে রয়েছে বিষন্ন প্যান্ডেলের চারপাশে অথচ দুদিন আগেই এই প্যান্ডেল যিরে কত হইচই

আনন্দ,উত্‍সাহ।কত আলোক মালার সমাহার আজ সে অবহেলীত একা।নিতাই এর বুক থেকে

নেমে আসে ভারী এক নিঃশ্বাস।প্রতিবারি উত্‍সব শেষের এই পরিত্যক্ত মাঠটায় এসে দাঁড়ায় নিতাই কেমন যেন মনখারাপের কান্না ওর বুক চিরে উঠে আসে এর কোন

ব্যাখ্যাই বোকা নিতাই এর কাছে থাকে না।আদপে ওর কাছে ওর নিজের জীবনের

মানেটার ব্যাখ্যাই কি আছে?নিতাই পায়ে পায়ে এসে বসে মাঠটার কোনে।কেমন যেন নিজের জীবনের সাথে মিলপায় এই ফেলে যাওয়া মাড়িয়ে যাওয়া মাঠটার।সবাই

এই মাঠের বুকে আনন্দে মেতে ওঠে আলোর রোসনাই তার জলতরঙ্গ ছড়িয়ে দেয় উত্‍সবে ঘেরা দিনগুলাতে মাঠের প্রতিটা কোনে।যেন এক অপার ঐশ্বর্যময়ী রাণী হয়ে

ওঠে সে।কিন্তু না এগুলো কোনোটাই তার জন্যে নয়।উত্‍সব শেষে সবাই ফিরে যায় তার

নিঃজস্ব জীবনে শুধু একা ফেলে যাওয়া উচ্ছৃষ্ট জিনিস বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে একা মাঠটা।নিতাই এর জীবন কি এর থেকে কিছু আলাদা?মা বাপ কিছু ছিল কি মনে পড়ে

না ওর।জ্ঞান হবার পর থেকে ও জেনে এসেছে ,বুড়ি দিদা এক রাতে

চন্ডীমন্ডপে ছয়মাসের ওকে পায়।বুড়ি দিদা ছেলে বউএর থেকে পরিত্যক্তা হয়ে চন্ডীমন্ডপের দাওয়াতেই আমৃত্যু ঘাঁটি গাড়ে।নিতাই এর মা বাপ যদি বলা যায় বুড়িদিদাই।

বউ,ছেলে নাতি নাতনি কে ছেড়ে এসে নতুন ভাবে স্নেহের ডোরে বাঁধা

পড়বো না ভেবেও আবার বাঁধা পরে অভাগীর মন।গাঁয়ের লোকেরাই বুড়ি দিদার খাওয়া পরার দায়িত্ব নিয়েছিল কিন্তু আবার একজন গোটা ছেলের দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা

তাদের কোথায়?তবু চলে যায় দীদা নাতির দশ টা বছর টেনে টুনে।কিন্তু বুড়ি

দিদার ও সময় শেষ হয় এ পাড়ের হিসাব নিকাশ শেষ করার।দশ বছর বয়সে অনাথ নিতাই

সত্যিই অনাথ হয় এতদিনে।এরপর থেকে নিতাই এর শুরু হয় একাই পথ চলা।প্রথমদিকে ভিক্ষে, চেয়ে চিন্তে লোকের থেকে চলে যেত।পরে সবাই মুখ ঝামটা দিত।”গাঁ

ঘর লোকের হাতে বলি পয়সা কোথায় যে রোজ রোজ ওকে দেব আর থাকলেও দেব কেন?বুড়ি মানুষ খেতে পেত না তাকে না হয় মায়া করে দেওয়া যেত কিন্তু অমন সুস্থ সবল
ছেলে সেতো বাপু খেটেই খেতে পারবে।”-ন্যায্য কথা নিতাই ও বোঝে বেশিদিন চেয়ে চিন্তে চলবে না।তাড়পড় থেকে এর একটু বাজার দোকানটা করে দেওয়া এর ধানের

গোলা একটু বোঝাই করে দেওয়া,এর সাথে দুকোদাল মাটি কুপিয়ে দেওয়া এইরকম ছোট খাট কাজ করে দুবেলার ভাত জোগাড় করে নিতে থাকে হেসে খেলে।এতেই

খুশি নিতাই রাতে শোবার নিশ্চিত জায়গা আর দুবেলা ভাত এর বেশী চাহিদা ওর নেই।এর মাঝে উত্‍সব পালাপার্বনে ওর চাহিদা বাড়ে।বিয়ে বাড়ি পূজা বাড়িতে বিনা

মাইনের নিতাই এর ডাক না পরলেও সে হাজীর।কাজ শেষে ওর খাবার পাওনাটুকু মিটে গেলে আবার ফিরে আসে চন্ডীমন্ডপের নিশ্চিত আশ্রয়টুকুতে অথবা একটু দূর

থেকে দাঁড়িয়ে দেখে অন্দর মহলের আনন্দ।ভরপেট খাবার পরেও ঠোঁঠ দুটো অকারণেই চেঁটে চলে, যেন এক অনাস্বাদীত খাবারের আঘ্রান পায় নিতাই এর চিরকালের বুভুক্ষু মন।কিসের একটা টনটনে ব্যাথায় চোখের কোনটা ভারী হয়ে ওঠে
অশিক্ষিত বুদ্ধি হীন বোকাসোকা নিতাই এর কাছে এর কোন ব্যাখ্যা থাকে না কিসের যে কষ্ট নিজেও বোঝে না কাউকে বোঝাতেও পারে না।একবার বলেছিল চন্ডীমন্ডপে

আড্ডা দিতে আসে যে ছেলেগুলো, তাদের একজনকে-“জানিস মাঝে মাঝে আমার না খুব কান্না পায় কেন বলদিকিন?”

“সেকি বে কবি হলি নাকি?ওরে শোন শোন আমাদের নেতাই কি বলছে?-সেদিন ওদের থামাতে নিতাইকে চ্যালা কাঠ এর সাথে থান ইঁট ও ধরতে হয়েছিল।নিতাই মনে

মনে নিজেকে আচ্ছা করে গাল দিয়েছিল একেই ওদের রোজ সন্ধ্যের কাজ হল নিতাই কে খ্যাপানো তারপরে ও এমন আহাম্মকের মত কাজ যে কেন করলো?

চন্ডীমন্ডপে ছেলেগুলো রোজ আড্ডা মারতে আসে আড্ডার মাঝে নিতাইকে নিয়ে ওরা মজা করে।বোকা নিতাই হল বড়বেলার খেলনা পুতুল ওকে ওরা বোকা বানিয়ে

অট্টহাসিতে ফেটে পরে আর নিতাই তার কালো ছোপ ধরা দাঁত বার করে সেই হাসিতে যোগ দেয়।আবার মেজাজ যেদিন খিঁচড়ে থাকে চ্যালা কাঠ নিয়ে মা বাপ

চোদ্দোগুষ্টী উদ্ধার করে গাল দিতে দিতে চন্ডীমন্ডপ ছাড়া করে।ওরা তখন নিরাপদ দূর থেকে আরো একটু রাগিয়ে মজার ডোজটাকে এক ভলুম বাড়িয়ে দিয়ে তাড়িয়ে

তাড়িয়ে উপভোগ করে।হয়তো তখন পাড়ার কোনো কাকা-জেঠু বা মাসিমা- পিসিমা পাশ দিয়ে যেতে যেতে আদরের ছলে ওদের বকা দেয়-“তোরা না গাল শুনতে ভাল বাসিস।”কিন্তু
মজা নিতে ওরাও যে চায়।আরে বাপু নিতাই হল গ্রামের সম্পত্তী তাই ছেলে পিলে একটু মজা করছে করুক না আর ওর গালের আবার কোন মাথা মুন্ডু আছে ?যে

ছেলেটাকে আজ বাপ মা তুলে গাল দিল কালি হয়তো তার বাড়িতেই এক থালা ভাত নিয়ে আয়েস করে উঠানে বসবে সারা দিন বাগান কোপানোর পর। এটাই নিতাই এইভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রামের চন্ডীমন্ডপ,পুকুর যাট,খেলার
মাঠ ইত্যাদির মত সার্বজনীন হয়ে নিতাই এর কুড়িটা বছর শীত বর্ষা বসন্ত পার করে কেটে যায়।

 

কিরে সব গোছগাছ করে নিয়েছিস?-লোকটা যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিতাই খেয়ালি করেনি।এবার লোকটা পাশে এসে বসে একটা বিড়ি ধরায়।কিছুক্ষণ দুজনেই

চুপ করে থাকে বিড়িটা শেষ করে লোকটাই আবার বলে ওঠে -“শীতকালের বেলা বড় ঝুপ করে পরে যায়।ঐ বিকেল বিকেল রওনা দেব বুঝেছিস।তুই এখানেই চলে

আসবি।”নিতাই কিছু বলে না শুধু মাথাটা হেলায় আনমনে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে।লোকটা আবার উঠে পরে কাজের তদারকিতে লেগে পরে। নিতাই একভাবে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে নাগর
দোলার প্রতিটা স্ক্রূকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলে ছোট ছোট ভাগ করে কি সুন্দর ভাবে একটা একটা করে ভ্যানেতে গুছিয়ে রাখছে লোকজন।নিতাই জানে এবার ওরা যাবে জগদ্ধাত্রীপূজার মেলাতে এবারে ওদের সাথে নিতাই ও যাবে।

নিতাই এর ভাগ্যে বলা যায় সুযোগটা হঠাত্‍ করেই এসে যায়।
এই মাঠেতে মেলাটেলা বসলে নিতাই মাঠটার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় কারো কিছু দরকারে হাতে হাতে কাজ করে দেয় বা এমনিই চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে

থাকে নাগরদোলা, দোকানপাঠ, আলোর রোশনাই.মানুষ, মানুষের আনন্দ।অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নিতাই।এতবার এক জিনিস দেখেও ওর দেখা ফুরায় না।

নিতাইএর সব থেকে ভাল লাগে মানুষ দেখতে।কত মানুষ কত তাদের রকমসকম।নতুন শাড়ি পড়া মেয়েটি বারবার শাড়ির কুঁচি সামলাতে ব্যস্ত বা বাচ্ছা ছেলেটি বাবার

হাত ধরে হাঁ করে বেলুন খেলনার দিকে তাকিয়ে।নিতাইও তাকিয়ে থাকে তবে বাচ্ছাটির বাবা মায়ের দিকে। কি যত্ন করে খাবার পর মা রুমাল দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিচ্ছে

বাচ্ছাটির অথবা গরম ঘুগনী পরম মমতায় আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে।বাবাটি কি স্নহভরে কোলে তুলে নাগর দোলায় বসিয়ে দিল বাচ্ছাটিকে দেখতে দেখতে এক অন্য

জগত্‍এ হারিয়ে যায় নিতাই। যে জগত্‍ তার অজানা নয় অচেনা নয় অথচ অগম্য ধরা ছোঁয়ার অনেক উর্দ্ধে।আবার হয়তো কোন রাগী বাবা যখন মা,মেয়ে সহ পুরো লটবহরকে গম্ভীর মুখে সামলাতে সামলাতে রাস্তা পার
করতে ব্যস্ত বা যুবক ছেলেটি সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঝাড়ি মারায় ব্যস্ত।এখন আবার বড় বড় ফোন হাতে ছেলেমেয়েরা একসাথে মুখচোখ বেঁকিয়ে ফটো তুলতে

ব্যস্ত থাকে।এসবদিকে হ্যাঁ করে চেয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে খিলখিল
করে হেসে ওঠে নিতাই।তখনি হয়ত চেনা দোকান দারের ডাক পরে নিতাই একটু জল এনে দে তো বা চেয়ার গুলো পেতে দেতো তার বিনিময়ে জুটে যায় বিনা পয়সায়

একটা রোল কি একপ্লেট ঘুগনী।অথবা চেনা কেউ পরিবার নিয়ে খেতে বসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিতাই এর জন্যেও একপ্লেট বেশি চাউমিনের অর্ডার দিয়ে দেয়।সেদিন

ঐ লটপল্টনকে রাস্তা পার করার দায়িত্বটা নিতাই নিজের হাতেই নেয়।এবারেও কালীপূজাতে নিতাই নাগর দোলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল চুপ করে তখনি নজর পরে লোকটার নিতাইকে।হাতছানি দিয়ে ডেকে জিজ্ঞাসা করে -“কি নামরে তোর ?”
“নিতাই।”
“কি করিস?”
“যে যা বলে।”
“এখন কাজ আছে?”
“না”
“তাহলে একটা কাজ দেব করবি?পয়সা পাবি।”
এবার খানিকটা আগ্রহনিয়ে নিতাই এর প্রশ্ন-“কি কাজ?”
লোকটা এবার একটা বিড়ি ধরায়।নিতাই এর হাতে দেয় ও নেয় না।নিজের বিড়ি তে একটা টান দেয় আয়েস করে তাড়পড় বলে”-আর বলিস কেন, যে ছেলেটা আমার

কাছে কাজ করে হঠাত্‍ ডেঙ্গী তার। এখন নাগর দোলা ঘোরাবার লোক কোথায় পাই?আমি টাকা নেব না এই কাজে লাগব?এমনিতেই একটা লোক সট ছিল এখন তো এক গাল মাছি।তা তুই করে দেটাকা পাবি।শিখিয়ে দেব সোজা কাজ”
নিতাই এর আর ভাবনা কি?উত্‍সাহে কাজে লেগে পড়ে।টাকা পাবে এটাতো তার কাছে ভাগ্য। নিতাই এর কাজ দেখার পর লোকটা খুশিই হয় তাই তখনি প্রস্তাবটা দেয়-কি রে আমার কাছে কাজে লাগবি?
নিতাই হাতে চাঁদ পায় এমন কাজ ওকে দেবে কে?এক কথায় রাজী ও।

 

গামছাটা আর গেঞ্জীটা গাছের ডাল থেকে পেড়ে এনে পুঁটলিটা বেঁধে নিল নিতাই। চন্ডীমন্ডপটা পাতা পড়ে ভরতি হয়ে গেছে এই বোধায় শেষ বারের জন্যে পাতাগুলো

ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করে দিল।পাশে বসে রামুবাউল একমনে বাঁশী বাজাচ্ছে।কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের পাঁজরটা রামু বাউলের বাঁশী শুনলে।পাশের বট গাছটা

থেকে হাওয়া লেগে পাতায় একটা সরসর আওয়াজ উঠছে।চন্ডীমন্ডপের ঘুলঘুলিতে বাসা করে থাকা পায়রা গুলো একটানা গাল ফুলিয়ে বকবকবকম আওয়াজ করেই

চলেছে।কেমন যেন একটু শীত শীত মত লাগে।রোদের তেজটা পরে এসেছে একটু রোদের দিকে বসে নিতাই।আজ যেন বাঁশির সুর শুনে বড্ড বেশী উদাস উদাস

লাগছে কেন যে বুঝে উঠতে পারছে না ও।আনমনে চোখ বুজে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে রামুবাউল একসময় বাঁশির সুর থামে।নিতাই উঠে এসে রামু বাউলের দিকে সরে

বসে-আমি আজ চলে যাব গো রামু দাদু হাতের বাঁশিটা জামায় যত্ন করে মুছতে গিয়ে হাতটা থেমে যায় বাউলের।প্রশ্ন তার স্নেহ ভরা-“কোথায় রে পাগলা?”

নিতাই বলে তার কাজ পাওয়ার কথা।খুশি হয় রামু বাউল।তাহলে শেষ বারের মত আর একটা রাগ শুনে যা-রামু বাউল আবার নতুন করে বাঁশিতে সুর তোলে।

 

রামু বাউল চলে যাবার পর ও নিতাই একটুক্ষণ হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে বসে থাকে আনমনে চেয়ে থাকে চন্ডীমন্ডপের কোনের দিকে।ঐখানটায় বুড়ি দিদা শুয়ে

থাকত।উঠে দাঁরায় নিতাই। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে জায়গাটায়।বিড়বিড় করে-“আমি চলে যাচ্ছি গো বুড়িদিদা জানিনা কোথায় আছ?বড়

তোমার কথা আজ মনে আসতেছে।মা বাপ কেতো দেখি নাই তবু মনে নাগতেছে যেন নিজের মা বাপের ভিটে ছেড়েই যেতেছি।তুমি আমার জন্যে অনেক করেছো গো দিদা এই গেরামে তুমিই তো মা বাপ আমার…”
“কিরে কি বিড়বিড় করছিস?”-পুরোহিত নিবারণ চক্রবর্তীর ডাকে চমক ভাঙে।কিছু বলে না নিতাই।নিবারণ বাবু একটা রামপ্রোসাদী সুর ভাঁজতে ভাঁজতে মন্দিরের তালা

খুলে ঘরে ঢুকে এটা ওটা দরকারি কাজ সারতে থাকে।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে নিতাই।চোখ যায় জবা আর শিউলি গাছটার দিকে।উঠে গিয়ে গাছদুটোর পাশে একটু

দাঁড়ায়।জবা গাছটা বুড়ি দিদার বসানো আর শিউলিটা ওর হাতের।তা নয় নয় করে পনেরো বছর তো হবেই।কত বড় হয়ে গেছে এত দিন যেন চোখেই পরে নি নিতাই এর।একটু ঝুঁকে গাছ দুটোয় পরম মমতায় হাত বুলায়।-“আসিরে ভাল
থাকিস।” টুপটুপ করে কয়েকটা শিউলি ঝড়ে পরে মাটিতে।
মন্দিরের লাগোয়া ঘাটের মাথায় গিয়ে একটু চুপ করে দাঁড়ায় নিতাই।জলটা হাওয়ায় তির তির করে কাঁপছে।বড় ভাল জল এই পুকুরের।স্নান করলে দেহমন যেন জুড়িয়ে

যায় নিতাই এর। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা নিতাই এর স্নান করার জায়গা এই পুকুর।পাশে হাতেটানা কল আছে কিন্তু ওতে ওর পোষায় না।ওরি বা একার কেন কত জনি যে সকাল

থেকে দুপুর পর্যন্ত স্নান করতে আসে।আগে তো আরো লোক আসতো এখন ঘরে ঘরে বাথরুম।নিতাই কোনো দিন বাথরুম দেখেনি। দেখবেই বা ও কোথায়।? তবে নতুন সাঁতার শিখতে আসা ছোট ছোট ছেলেগুলো এখনো সাঁতরে ঘাটের এপাড়
ওপাড় করে সারা দুপুর ধরে।আর জল এনে ছিটকে দেয় নিতাইকে দেখতে পেলে।আর যারা
এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি নতুন পরিবর্তনে নিজেদের,তারা এখনো হুস হুস করে পাঁচটা ডুব গেলে যায় এই পুকুরে।পাশের পাড়ার প্রভাস খুড়ো তো একদিন নিতাই কে বলেই ফেলল-
“যাই বলিস বাপু ওসব বাথরুম টাথরুমে এখনকার ছেলেমেয়ে দেরি অভ্যাস আমাদের কালে কি ছিল নাকি?পুকুরে না নাইলে নাওয়া হয়েছে বলে যেন মনে হয় না।ছেলে,বউমা,নাতনী আমায় খিটখিট করেই চলে ওরা যা বলে বলুক এ পুকুরে কি আমি
আজ থেকে চান করি রে সেই ঠাকুর দার হাত ধরে”..নিতাই কিছু বলেনি শুধু মনে মনে ভাবছিল -ছিল না তো অনেক কিচ্ছুই ওর এই কুড়ি বছরে কত কিছু যে বদলে

যেতে দেখল-হাতে হাতে এল সকলের মোবাইল,মাটির রাস্তা বদলে পাকা পিচ হল,মেয়েরা এস-কুটি চাপতে শিখল ছেলেদের মত প্যান্ট নায়িকাদের মত জামা পড়তে

লাগল ।কিন্তু নিতাই সেসব কিছু নাবলে করে দেখতে থাকে গনেষ জ্যাঠা কেমন করে কানে আঙুল পুরে হুস হুস করে ডুব দিচ্ছে। ও কত বার চেষ্টা করে তবু পারেনা।

এই যাটে বসে কত গল্পই যে নিতাই শুনে এসেছে ছোট-বেলা থেকে।যে কথা কাউকে বলার থাকে না সে কথা একমাত্র শোনার লোক নিতাই। এটাই অভ্যাস। কাল থেকে

আর বিন্ধু জেঠীর শোনানো হবে না বউমার টিভি দেখার বাতিকের কথা বা সরমা দিদার পাশের বাড়ির জিন্স পরা ধিঙ্গী মেয়েটার কথা।

মেয়েটার কথা ভাবতেই নিতাই এর মনে পড়ে গেল সেই গেলবারে ওদের গ্রামে বেড়াতে আসা বেঁটে মত ফরসা গোলগাল পুতুলের মত ছোট্ট খাট্ট মেয়েটার কথা।
দত্ত পাড়ার পূজা ওকে রিনি বলে ডাকছিল।
“একটু সরে বসবেন?”সেই প্রথম এক রিনরিনে কন্ঠস্বরে আপনি সম্বোধন টা শুনেছিল
নিতাই।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে খানিকক্ষণ বুঝে নিতে সময় লেগেছিল ওর ওকেই কি বলল?তারপর আর দুবার মেয়েটাকে দেখেছে নিতাই।কেমন যেন ভীতুভীতু।পূজার

সাথে এসে ধূপ বাতি জ্বেলে দিয়ে যেত।ঐ দুদিন হ্যাঁ করে চেয়েছিল নিতাই রিনির দিকে।তারপর থেকে নিতাই অপেক্ষা করে থাকত কবে আসবে আবার মেয়েটা।তবে

আর দেখেনি নিতাই।সপ্তাহ পেরিয়ে মাস.মাস থেকে বছর গড়িয়ে গেছে তবু সন্ধ্যা বেলার আরতির মাঝে নিতাই এর চোখ খুঁজে ফেরে ফরসা গোলগাল ছোটখাট এক মেয়েকে।মনে মনে ভাবে নিতাই আর কখনো এলেও সে, আমার আর দেখা হবে না..

 

হাঁটু গেড়ে পুকুরের বাঁধানো ঘাটে একটু বসে নিতাই। উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে পথের উপর।ধীরে ধীরে হেমন্তের বিকেল ঘাঁটি গাড়ে। সূর্য-টা তালগাছের আড়ালে এক

পা এক পা করে হামা-গুঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে।কেমন জেনো মন খারাপ করা হেমন্তের বিকেল ছেয়ে থাকে গ্রাম জুড়ে।বড় তাড়াতাড়ি আদুরে বিকেল তার পাঠ চুকিয়ে

সন্ধ্যার বুকে মুখ লুকায়।একটু পরেই সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে উঠবে গ্রামের প্রতি ঘরে।একসময় কার্ত্তীক মাস-জুড়ে মেয়ে-রা করত কুলকুলতীর ব্রত ।আজও হয় তবে

আধুনীকতার মোড়কে কমে গেছে তার ব্যপ্তী।তবু কোন কোন গ্রাম্য বালিকা এখনো সারা বিকেল জুড়ে ফুল জোগাড় করে সাজিয়ে দেয় তুলসী্মঞ্চ,জ্বেলে দেয় প্রদীপ।

মন্ত্র পরে-কুলকুলতি কুলেরবাতী..সন্ধ্যাবেলায় ঘন্টার শব্দ বেজে ওঠে মন্দিরে।প্রতিটা ঘর থেকে ভেসে আসে শাঁখের শব্দ।এসব কিচ্ছুই তো নিতাই এর নয় তবু কেন যে

এগুলিই আজ ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় মন ভার হয়ে ওঠে তার!কি বা ওর আছে কেবা ওর আছে তবু যেন আপনজনের বিচ্ছেদবেদনায় মনের উপর ভারী পাথর চাপে নিতাই এর।
বিকেল প্রায় গড়িয়ে আসে।মাঠের কাজ শেষে নিতাই এর গ্রামতুতো রামু জেঠু,অলক জেঠু,প্রভাস কাকা আরো সকলে ফিরতে থাকে সকলকেই নিতাই শেষ বিদায়

জানায়।সকলেই বাড়ি ফেরার তাড়ার মাঝে থম়্কে দাঁড়ায়।ছেলেটা যে ছিল ।সকলের এক অভ্যাস।আত্মীয় নয় প্রতিবেশী নয় তবু ছিল।কোন কাজি হয়তো কম হবে না তবু…

 

নিতাই উঠে দাঁড়ায়।চন্ডীমন্ডপের কোন থেকে তুলেনেয় পুঁটলি-টা।নিবারণ চক্রবর্তী হাতের কাজ মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরে।থম়্কে দাঁড়ান নিতাই এর ডাকে-আমি চলে যাচ্ছি ঠাকুর মশাই।
চলে যাচ্ছিস?কোথায়?-বিস্ময়ের প্রশ্ন ঠাকুরমশাই-এর।
“ঐ মেলায় যে নাগরদোলা এয়েছিল ওরা কাজে নেবে ওদের সাথে।”
ক্ষণিকের নীরাবতা নেমে আসে দুজনের মাঝে।আবার মন্দিরের ঘরের চাবী খোলেন নিবারণ বাবু।চারটে কলা আর একটু মিষ্টি এনে হাতে দেন নিতাই এর।মনটা কেমন

ভার হয়ে ওঠে।চিরকাল দূরছাই তো করেছেন তবু কেমন যেন এক বিচ্ছেদ ব্যথা ভার হয়ে চেপে বসে মন জুড়ে।-হাত কপালে উঠে আসে নিতাই এর মঙ্গল কামনায় “মাগো ভাল করো মা মঙ্গল করো ছেলেটার।”

পুঁটলিটা নিয়ে পথে নেমে আসে নিতাই।আর একবার পেছনের ফেলে আসা গ্রামটার দিকে তাকায় ।
“কিরে কোথায় যাচ্ছিস?”-নিতাই ভ্যানে উঠে বসতে গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটার ডাকে।কিন্তু চুপ করে থাকে।এই ছেলেটাই তাকে বড্ড খেপায়।যদি ও কাজ পেয়েছে শুনেও খেপায়?নিতাই বলে না লোকটাই বলে-“আমাদের সাথে যাচ্ছে আমার কাছে কাজ করবে।”
মোবাইলটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে আঙুল-গুলো থমকে যায় ছেলেটার।ফোনটা বন্ধ করে পকেটে পুড়ে বলে-“তুই চলে যাচ্ছিস?কাজ পেয়েছিস?”নিতাই শুধু অস্ফুটে হ্যাঁ বলে।ছেলেটা কাঁধ-টা চাপ়্ড়ে দেয় নিতাই এর-“বাঃ গুরু খুব ভালো।”তারপর পকেট
থেকে কুড়িটাকার নোটটা বার করে ধরিয়ে দেয় নিতাই এর হাতে।-“মিষ্টি খাস পাগলা।”অবাক হয় নিতাই, চমকে তাকায় সে ,কথাটা বলার সময় কেঁপে গেল যেন ছেলেটার কন্ঠস্বর।
নিতাই ভ্যানে উঠে বসে।ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকে।নিতাই বলে-“ভাল থেক তোমরা।”
“”তুই ও শালা ভাল থাকিস আর আসিস মাঝে মাঝে।ভুলে যাসনা যেন নেতাইরাম।দেখেছিস চোখটা বড্ড কড়কড় করে কিযে হয়েছে আজকাল” -কথাগুলো বলে একটু ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটা।
নিতাই এর ভ্যানটা ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলে। নিতাই এর চির-চেনা মাঠটা ছোট্ট গ্রামটা,নিতাই এর শত্রু ছেলেটার অবয়ব একসময় পথের বাঁকে হারিয়ে যায়।

নিতাইএর কাছে কোনো ব্যাখ্যা থাকে না হঠাত়্‍ করেই কেন যে দু-ফোঁটা চোখের জল অকারণেই ঝরে পরে ছেঁড়া পুঁটলিতে।

এক আকাশ হেমন্তের ঝকঝকে তারা ভরা রাতের আকাশের দিকে নির্নিমেষ ভাবে তাকিয়ে কুয়াশার চাদর মেখে শুয়ে থাকে একলা মাঠটা।কিছু জোনাকি শুধু জ্বলে আর নেভে।ঝপ করে হেমন্তের কুয়াশার চাদর মাখা সন্ধ্যা নামে ছোট্ট গ্রামটাকে

ঘিরে।মন্দিরে বেজে ওঠে ঘন্টা ধ্বনী।”নিতাই কাঁসর-টা নিয়ে যা রে”-বলতে গিয়েও থেমে যায় নিবারণ চক্রবর্তী।পনেরো বছরের দীর্ঘ অভ্যাস যে।ছেলেগুলো আড্ডা মারে

চন্ডীমন্ডপের দাওয়ায়।তবু কেন যে আড্ডার তালটুকু কেটে যাচ্ছে আজ ওরা বোঝে না।সকলে একসময় চুপ করে ভাগ করে বিড়িতে টান মারে। সেইসময় হঠাত করেই কয়েক-জোড়া চোখ থম়্কে দাঁড়ায় চন্ডীমন্ডপের শূন্য কোনে,যেখানে প্রায় কুড়ি বছরের ছেঁড়া পুঁটলি টা আজ অদৃশ্য।

……………………………………………………..(সমাপ্ত)……………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত