-মা ভাত দাও তো তাড়াতাড়ি, জরুরী দেখা করতে বলেছেন মাহফুজ ভাই।
-রোজই তো এই ধরণের কথা শুনে আসছি। কোন কূল কিনারা তো হয় না।
আমি মাথা নিচু করে বললাম: এইবার একটা ব্যবস্থা করে দিবেন বলেছেন। জলদি দাও।
আজকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে ভাত চাইতে লজ্জা লাগে। বড় ছেলে ফ্যামেলীর, বাবা নেই, পড়াশোনা শেষ হয়েছে প্রায় ছয় মাস। ছোট একটা ভাই আর বোন আছে। পিঠাপিঠি রোকন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আর রেহনুমা ওরফে রেনু ক্লাস সিক্সে। আমি রাহী। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা। অবশ্য সবার বুঝতে পারার কথা না, যারা আমার মত অবস্থায় আছেন তারা বুঝবেন শুধু হয়ত।
কি করব বলেন, গত ছয়বছর ধরে সংসার চালাতে টিউশনি করিয়েছি একদিনে পাঁচ থেকে ছয়টা কখনো আরো বেশী। এই ঘর থেকে ওই ঘরে, শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে। রাস্তায় জ্যাম বেশী থাকলে পায়ে হেঁটে হেঁটে। সংসার সামলাতে গিয়ে রেজাল্টের অবস্থা তেরটা। ভদ্রসমাজে বলার মত না। কি করব বলেন! নিজের পরীক্ষা থেকে কখনো কখনো ছাত্রদের পরীক্ষাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রের মা কে বোঝানো যেত না, আমার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। তবুও মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকার বড় প্রয়োজন তাই, না করতে পারতাম না।
যেদিন এক্সিডেন্টে হাত ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিল একজন বলে বসল, আল্লাহ্ রাহী! আমার বাচ্চাটার কি হবে! দেড়মাস পর সেকেন্ড টার্ম!
আমি রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম, ইচ্ছে হল গরম গরম কিছু কথা শুনিয়ে দেই। আমার মত মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা থাকতে নেই তাই ফোন কেটে, পরের দিন হাসিহাসি মুখ করে ভাঙা হাতখানা গলায় ঝুলিয়ে ছাত্রের বাড়িতে হাজির হয়ে গেলাম। ছাত্রের মায়ের আচরণ দেখে মনে হল এ যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
পড়িয়ে বের হওয়ার সময় প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল, বের হওয়ার সময় ছাত্র জিজ্ঞেস করল ছাতা লাগবে নাকি?
আমি মাথা নাড়িয়ে হনহন করে বের হয়ে গেলাম।
মাঝেমধ্যে নিজেকে সিনেমায় অভিনয় করা হিরো মনে হলেও, হিরোদের হাত কেটে ফেলতে হয়না, আমারটা কব্জির একটু উপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছিল, গ্যাংগ্রিন।
বাবা তো মারা যাবেনই, যাওয়ারই কথা। কারো বাবা তো চিরকাল থাকেনা। কিন্তু পুরো সংসার এভাবে এলোমেলো ফেলে চলে যাওয়ার কারণে আমার প্রায়ই খুব রাগ হয় বাবার উপর।
২
ছয়-সাত মাস পর আবার শুরু করি নতুন ছাত্র পড়ানো।
তবে আজকাল বিব্রত লাগে বাসায় গিয়ে ছাত্র পড়াতে, হাত নেই এই বিষয়টা সম্ভবত ঠিক হজম হয়না অভিবাবকদের, তাই কোচিং সেন্টার ছাড়া অন্য কোথাও ক্লাস নেইনা। অদিতির মা অনেক করে অনুরোধ করায় শুধু ওর ছোটবোনকে পড়াই এই পনের-বিশ দিন ধরে।
কোচিং এ আমাকে হাত কাটা স্যার হিসেবেই চেনে সবাই। বাম হাতে লিখলে চিনবেই তো।
সকাল সকাল কোন কাজকর্ম ছাড়া এভাবে বের হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরঘুর করতে কার ভালো লাগে?
অধিকাংশ সময় বন্ধুদের মেসে গিয়ে বসে থাকি, তাদের বিস্কিটের টিন নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। বিস্কিট না পেলেও চিড়ামুড়ি তো থাকেই!
বন্ধুরা সবাই আমার এক বছর আগে বের হয়ে কোথাও না কোথাও জয়েন করেছে।
শুধু আমারই কোন ভবিষ্যৎ নেই, কখন ছাত্র পড়ানো শুরু হবে শুধু সেই চিন্তা করে সময় পার করি, হেঁটে হেঁটে কোচিং সেন্টারে যাই, সময় কাটে, টাকাও বাঁচে।
ও! আজ সকালে যে জরুরী কাজ আছে বলে তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছিলাম, বুঝতেই পারছেন সেটা মিথ্যা ছিল। ভার্সিটির বড় ভাই, পরিচিত মানুষজন আমার ফোন দেখলে মোবাইল সাইলেন্ট করে দেয়। বলুনতো কার সাধ্য আছে একটা পঙ্গুকে চাকরী দেবে?
এদিক থেকে অদিতির মা অনেক ভাল, সপ্তাহে চারদিন বিকালে যখন অদিতির ছোটবোন স্নেহাকে পড়াতে যাই, উনি কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভাত বেড়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলে, আমার সম্মান রক্ষার জন্য বলেন, কি খেয়েছো বাবা সারাদিন বাইরে ঠিক আছে? আগে ভাত খাও তারপর পড়ালেখা করিও।
অথচ সারাদিন আমি দুকাপ চা আর পাঁচ টাকার বন ছাড়া কিছুই খাইনি সেটা তিনি ভালো করেই জানেন।
আহা! এত কথা বলার ভিড়ে ভুলেই গিয়েছিলাম, অদিতি আমার ক্লাসমেট। হাত কাটার আগে ওর সাথে আমার একটু আধটু প্রেম ছিল। ভালবাসতাম আমি অদিতিকে। একসাথে আসতাম ভার্সিটি থেকে, কত স্বপ্ন দেখতাম আমি পড়াশোনা শেষ করেই একটা চাকরী শুরু করব, অদিতিকে বিয়ে করে শুরু করব সংসার।
এগুলো আসলে গল্পে হয়।
বাস্তবে অনার্স ফাইনাল দেয়ার আগেই অদিতির বিয়ে হয়ে গেল। স্বামী কি করে?
কে জানে? আমি জানতে চাইনি কখনো।
বিয়ের প্রস্তাব এসেছে শুনে আমিই সংশয়ে পড়ে গেলাম, কোন মুখে অনুনয় করে বলি, অদিতি ঠিকানা বদলে ফেলো না, আমায় একা ফেলে।
তাই এক প্রকার পালিয়ে গিয়েছিলাম ওর জীবন থেকে।
অদিতি সত্যি সত্যি বিয়ে করে চলে গেল অন্য নগরে।
আন্টি স্নেহাকে পড়ানোর অনুরোধ করা মাত্রই রাজী হয়ে গেলাম। অন্তত হাত নেই এই জন্য বিব্রত হয়ে থাকতে হবে না।
ইন্টারে পড়া মেয়েগুলো ভয়ানক রকম নাজুক থাকে, যেন অপেক্ষা করে প্রেমে পড়ার।
স্নেহার কথাবার্তা আজকাল সুবিধার মনে হয় না, গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ধমক দিলে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদে, চোখের কাজল ভিজিয়ে সারা গাল ভাসিয়ে ফেলে।
ইচ্ছা করে কষে এক চড় লাগাই। একটা টিউশনি চলে যাওয়া মানে পাঁচ হাজার টাকা চলে যাওয়া, সাথে চমৎকার তরকারি দিয়ে দুপুরের ভাত সেটাও মাটি হবে।
আজ পড়ানো শুরু করা মাত্র, স্নেহা ছটফট করে বলল, আজ পড়ব না ভাইয়া!
-কেন?
-ওমা! আপু এসেছে তিনটার ট্রেনে। আজ শুধু গল্প করে ছুটি।
আমি ধমক লাগিয়ে পড়ানো শুরু করলাম। মনের গহীনে একটা অনুভুতি দুরুদুরু করছে, আপনারা ভাবিছেন আমি হয়ত ভাবছি, আসবে তো অদিতি একটু দেখা করতে?
হা হা! নাহ। আমি আমার উচ্চতা ভালোই আন্দাজ করতে পারি। বরং আমার ভয় হচ্ছে, অদিতি জানার পর টিউশনটা চলে যাবে নাকি আবার।
তবে একটা ক্ষীণ আশা আছে!
আমাকে যেহেতু আন্টি অনুরোধ করেছে স্নেহাকে পড়াতে, এখানে অদিতির ইনফ্লুয়েন্স না থেকে পারেই না। আবার মনে হল, নাহ! আমি তো অনেক আগে থেকেই পড়াই সেটা আন্টি জানে, নিজের ছোট মেয়ের জন্য বিশ্বস্ত টিচার হিসেবে চেনাজানা আমি ছাড়া আর কে আছে? তাই আন্টি নিজ থেকেই বলেছেন।
তবুও একটু পর্দা নড়ে উঠলে আমি চমকে উঠি! এই বুঝি এল ও! আহা! আসলেই তো পারে। একবার দেখতাম শুধু।
প্রায় দেড়ঘন্টা হয়ে গেল, আমার যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
আসে না কেন? আসে না কেন!
অদিতি আসেনি। হাতে একটা হলুদ খাম নিয়ে বিব্রত মুখে আন্টি দাঁড়িয়ে আছে।
৩
হনহন করে হেঁটে চলেছি আমি, আকাশ মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি আসবে না।
চলে আসার সময় স্নেহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল।
জানতে চেয়েছিল: আপনি আর আমাকে পড়াতে আসবেন না?
উত্তর দেইনি।
মা বলেছিল, ফেরার সময় এক হালি ডিম নিয়ে যেতে। রেনু ডিম ছাড়া ভাত খায়না।
পকেটে আছেই এগারো টাকা।
আচ্ছা! সংসারটা কি নেশা? নাকি বেঁচে থাকার অজুহাত।
আমি না থাকলে সংসারের কি বেশী ক্ষতি হয়ে যাবে? রেনুর ডিম নাহয় রোকন কিনে আনবে!
কিছুদিন কান্নাকাটি করে মা ও ভুলে যাবে!
ব্যর্থ ছেলের জন্য কি মায়ের আফসোস হবে?
আজো মা বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস করবে, কিছু হল কিনা? কি জবাব দেব?!
আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও একই প্রশ্ন করে, দেখা হলেই জানতে চায়, কোথায় আছি এখন?
ইচ্ছে হয় মুখ খারাপ করে কিছু কথা শুনিয়ে দেই, শালা টিটকারি কর না সমবেদনা দাও, এসব আমি বুঝিনা?
কিন্তু আমার এখন সময় খারাপ। বাবা প্রায়ই বলতেন, খারাপ সময়ে চুপ করে সব হজম করে যেতে হয়। একদিন সময় আসবে।
আসবে তো?
আচ্ছা! আমি কি স্বার্থপরের মত চিন্তা করছি? শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবছি?
ভাবলেইবা ক্ষতি কি!
সংসার চলবে সংসারের নিয়মে। আমাকে ছাড়া হয়ত বা আরো ভালো চলবে।
এত ভাবলে কিছু করা যাবে না, সীদ্ধান্ত একবার যখন নিয়েছি, পিছু ফিরে আসার কোন মানে হয় না।
আপনাদের মনে হয়ত প্রশ্ন আসতেই পারে, আমার কেমন লাগছে এখন?
কিছুই লাগছে না, শুধু বুকটা ভার হয়ে আছে। মরার আগে একটু কাঁদলে হয়ত ভাল লাগত।
আমার কারো কথাই তেমন একটা মনে পড়ছে না, অদিতি, মা, ভাই, বোন, কারো কথাই না।
শুধু বাবার উপর খুব অভিমান হচ্ছে।
সাদামাটা মোবাইলের রিংটোনের শব্দ কানে আসছিল শেষ মুহুর্তে।
কে ফোন করেছিল?
………………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………………..