‘কিরে মৌ? কী হয়েছে তোর, এখানে একা দাঁড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস কেন? ‘
শরিফকে দেখে মৌ যেন আশার আলো দেখতে পেলো, ওর ছোট্ট পৃথিবীতে শরিফ এক ম্যাজিশিয়ান যে সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে চোখের পলকে। জলভরা
চোখ দুটো তুলে বলল ‘সবাই কী মজা করে নৌকো বানিয়ে খেলছে। আমি তো নৌকো বানাতে পারি না।’
‘ওহ এই কথা, আয় তো তুই আমার সাথে, দেখি কয়টা নৌকো লাগবে তোর।’ ওকে হাত ধরে হির হির করে টেনে নিয়ে যায় শরিফ।
চার দিন টানা বৃষ্টিতে স্কুলের মাঠে পানি জমে গেছে। টিফিন টাইমে সেই পানিতে কাগজের নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে সব ছেলে মেয়েরা। তাদের চোখে মুখে
নাবিকের আনন্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো শরিফের পাশে দাঁড়িয়ে মৌ ও নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। চোখে শুকিয়ে যাওয়া জলের ভেজা দাগ আর মুখ ভর্তি
হাসি। প্রথম নৌকো ভাসার পর খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে মৌ, শরিফের বেশ গর্ব হোল। কেন যেন, মৌকে দেখে শুনে রাখার এক অলিখিত দায়িত্ব নিয়েছে সে। তারা
দুজন ক্লাস টু তে পড়ে।
সময়ের রথে চড়ে সবার অগোচরে কখন যেন কৈশোরে পা দিয়েছে মৌ আর শরিফ। সদ্য প্রস্ফুটিত যৌবনের কুড়ি নিয়ে অন্য সব ছেলেদের সামনে অন্য রকম
লাগলেও শরিফের সাথে মৌ এখনো একেবারেই সহজ। মাঝে মাঝে বাড়িতে মার কাছে পোশাক নিয়ে বকা খেলে, রাস্তায় ছেলেরা বিরক্ত করলে সেই গল্প ও শরিফকেই
করে। হাল্কা মোচের রেখার তলে শরিফ মুচকি হাসে। ছেলে বন্ধুদের সাথে প্রথম সিগারেট টেনে এসে মৌকেও জোর করতে থাকে একবার টানার জন্য।
চলছিল বেশ ভালোই। সেদিন পর্যন্ত, যেদিন ওদের বন্ধু সাজ্জাদ এসে মৌকে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল ‘কীরে তুই নাকি শরিফের বউ?’ সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে ছড়া
কাটতে লাগলো ‘শরিফের বউ, নাম তার মৌ।’ রাগে ফেটে পড়ে মৌ জানতে চাইল ‘কী বলছিস এসব বাজে কথা? কে বলেছে তোকে? আমরা কতো ভালো বন্ধু।’
ভেংচি কেটে সাজ্জাদ বলে ‘ তোর বর শরিফই বলেছে। বিকেলে খেলার মাঠে গর্ব করে বলছিল আমার বউটা কী সুন্দর না?’ দেখেছিস?’
চোখ ফেটে জল আসে। সেই থেকে শরিফের সাথে কথা বন্ধ। মা জানলে আস্ত খুন করবে।
অনেক চেষ্টা করেও মৌ এর মান ভাঙ্গাতে পারছে না শরিফ। এদিকে স্কুলের যেদিকেই যায় মৌ সেই একই ছড়া শোনে ‘ শরিফের বউ, নাম তার মৌ।’….. ..স্কুলে আসাটাই
ওর জন্য কঠিন হয়ে গেছে।
শীতের এক সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলে মৌ অবাক। কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে শরিফ দাঁড়িয়ে আছে, হি হি করে কাঁপছে, ঠোঁট দুটো কেমন নীলচে হয়ে গেছে।
‘মৌ সেই ফজরের আজানের সময় থেকে দাঁড়িয়ে আছি এখানে, তুই কী আসলেই আর আমার সাথে কথা বলবি না?’ ওকে দেখে মৌর খুব মায়া লাগে, হটাত করে কেন
যেন অন্য রকম ভালো ও লাগে। এই অনুভূতিটার সাথে সে ঠিক পরিচিত নয়।
‘তুই আর স্কুলে আমার সাথে মিশবি না, তবে বাসায় আসতে পারিস মাঝে মাঝে।’
শরিফ এটুকুতেই মহা খুশি। ওর মা নেই। বাবা স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন, ছেলেমেয়েদের খোঁজ খবর তিনি তেমন একটা রাখেন না। সেই অন্ধকার থাকতে বাসা থেকে
বেরিয়েছে, কেউ হয়তো তার খোঁজ করে নি ঠিকই, কিন্তু ঠাণ্ডায় অনেক কষ্ট হয়েছে, সে কষ্টটা সার্থক। ইচ্ছে করছে ছুটে যেয়ে মৌকে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু একটু
এগিয়েও থেমে গেলো সে। কে জানে, আবার নতুন কোন ঝামেলা হয়।
গড়িয়ে গড়িয়ে স্কুলের সীমানা পার হলেও কলেজের সীমানা ডিঙ্গাতে পারলো না শরিফ। পারবেই বা কীভাবে? স্কুলের পর মৌ আর সে দুজন দুই কলেজে। মৌ খুব
সিরিয়াস বলেই স্কুলে ওর ধমক ধামক খেয়ে তবু পরীক্ষার আগে একটু আধটু পড়তে বসা হত। এখন তো আর বকা দেওয়ার কেউ নেই, তাছাড়া এখন তার কতো কাজ।
ইদানীং আবার ঝোঁক চেপেছে গান বাজনার। নিজের বাসায় এক দণ্ড মন বসে না তার। বাসার পরিবেশ আর সে নিজে যেন দুই মেরু।
মৌর সঙ্গে ওর যোগাযোগটা কমলেও বন্ধুত্বটা আছে ঠিক আগের মতোই। ওই যায় মৌদের বাসায় বেশি, নিজের বাসায় মৌকে আসতে বলতে কেন যেন বাধও বাধও
লাগে তার। সে টের পায়, ওর বাসায় মৌকে একদম মানায় না। এই প্লাস্টার খসা দেওয়াল, দু রুমের বদ্ধ ভ্যাপসা ঘর, চাদর ছাড়া চৌকি, নোংরা বাথরুম সব কিছুই যেন
দাঁত বের করে হাসে। সব চেয়ে ভয় লাগে মৌ যদি বাথরুমে যেতে চায়, অনেকটা আতঙ্কে থাকে সে। মৌ কিন্তু একদম সহজ সরল, যেন এগুলো তার চোখেই পড়ে না।
শরিফের আরেকটা বড় ভয়, সেই সেবারের কথা বন্ধ করার পর থেকে মৌ যদি সত্যি সত্যি তার মনের কথাটা জেনে যায়। না এখনো, সময় আসে নি। গানের ব্যান্ডটা
দাঁড়িয়ে যাক, একটা কিছু নিয়ে তো ওর সামনে ওর যোগ্য হয়ে দাঁড়াতে হবে। মৌ ‘না’ করলে ওর সমস্ত পৃথিবী যে চুরমার হয়ে যাবে। তাছাড়া, ও ঠিক মতো বুঝতে পারে
না মৌ ওকে বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবে কিনা। সেবার বৃষ্টিতে তাড়াহুড়া করে রিকশা থেকে নামতে যেয়ে পা পিছলে যখন পড়ে যাচ্ছিল মৌ, তখন দুহাতে বুকের মাঝে
আগলে ধরেছিল শরিফ। বুকের মাঝে ধরা মৌয়ের চোখদুটোতে খুব কাছে থেকে ও খুঁজছিল ভালোবাসার চিনহ, কিন্তু মৌকে কিছুটা অপ্রস্তুত ছাড়া আর কিছু মনে হয়
নি। কী ভীষণ ইচ্ছা করছিল ওর বৃষ্টি ভেজা কোমল ঠোঁট দুটোতে চুমু খেতে, শরিফ পারে নি কিছুই।
সবাইকে তাক লাগিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিবিএ তে চান্স পেয়ে গেলো মৌ। একে ভালো ছাত্রী, দেখতে মিষ্টি আর ভীষণ চটপটে। ছেলেদের সাথে ছোটবেলা থেকে
পড়ালেখা করেছে, ওর আচার আচরণে কোন জড়তা নেই। এমন মেয়ের চার পাশে বন্ধু জুটতে সময় লাগে না। পড়ালেখার চাপ আর নতুন বন্ধু সব মিলিয়ে শরিফকে
আজকাল একদম সময় দেওয়া হয় না। আর ও দিন দিন এমন বাউনডুলে হয়ে যাচ্ছে। গান, গান করে পাগল হয়ে যাবে ছেলেটা। কিন্তু যতই দেখা শোনা কম হোক না
কেন, মৌর এখনো পৃথিবীতে একমাত্র ভরসার জায়গা শরিফ।
নতুন সব বন্ধুদের মাঝে আসাদ একদম আলাদা। শুধু সুদর্শন, ভালো ছাত্র বলে নয়, ওর ব্যাক্তিত্ত অন্য রকম। বাবার টয়োটা চালিয়ে ভার্সিটি আসে মাঝে মাঝে, কেমন
যেন সিনেমার হিরো মনে হয়। আসাদের নাকি আমেরিকার সিটিজেনশিপ হয়ে যাবে শিঘ্রি। মৌর কেন যেন মনে হয় আসাদ ওকে পছন্দ করে। মুখে বলে নি যদিও।
প্রজেক্টের কাজে ওদের বাড়িতে যেয়ে ওদের পুরো পরিবারটাকেই ভীষণ ভালো লেগে গেলো মৌর, ওদের সাজানো ছিম ছাম বাড়ি, ওর মায়ের মার্জিত মিষ্টি ব্যাবহার সব
কিছু। কয়েক দিন ধরেই কাজ চলছিল, এ কদিনে ওরা দুজন দুজনকে আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। ছেলেটার উপর নির্ভর করা যায় চোখ বুজে, ভীষণ
দায়িত্ববান। মনের অজান্তেই কী প্রেমে পড়ে গেলো মৌ? নাহলে এতো ঘটা করে সাজা কেন? একদিন তো আরেকটু হলে শাড়িই পড়ে ফেলত। পারফিউম,
হাল্কামেকআপ কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
সেদিন রাত হয়ে গেলো অনেক, এর মধ্যে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ।
‘চল মৌ তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’
মৌ ভেবেছে গাড়িতে, তাই আর কথা বাড়ায় নি। কিন্তু সিঁড়িতে নামতে নামতে আসাদ জানালো ‘গাড়ি নষ্ট’। অথচ গ্যারেজে তো নীল গাড়িটা চুপ চাপ দিব্যি দাঁড়িয়ে
আছে।
কিছু করার নেই। রিকশায় উঠে হুড তুলতে হল, সেই সাথে পর্দা। মৌয়ের সকালে লাগানো পারফিউমের মিষ্টি সুবাস আর আসাদের আফটার শেভের মাদকতাময়
পুরুষালি গন্ধ মিলে মিশে সেই পরদা ঘেরা ছোট্ট পরিসরে এক অপাথিব ভালো লাগা তৈরি করলো যেন। মৌর মন বলছে আজ কিছু হবে।
রিকশায় খুব বেশি কথা হোল না, প্রজেক্ট নিয়ে টুক টাক কাজের কথা, ……… শুধু বাতাসে থমকে ছিল এক রাশ ভালো লাগা।
রিকশা থেকে নামার আগ মুহূর্তে আসাদ আলতো করে ওর হাত দুটো তুলে নেয় নিজের হাতে ‘মৌ তোমাকে যে আমার ভীষণ ভালো লাগে, তুমি কী সেকথা জানো?’ মৌ
ভালোলাগার আবেশে বিবশ হয়ে যাচ্ছিল, কিছু বলতে পারে নি মুখে। তবে ওর দৃষ্টি বলেছিল ‘আমার ও ভালো লাগে তোমাকে, অনেক ।’ অনেক অনেক ভালোলাগা নিয়ে
বাড়ি ফিরে এসেছিল মৌ। সারারাত বৃষ্টির গান শুনেছে, এক ফোঁটাও ঘুম আসে নি।
পরদিন সকালে বৃষ্টিটা একটু ধরতেই এক দৌড়ে শরিফের বাড়ি। সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে শরিফ, গালে বাসি দাড়ি। এতো সকালে পাগলিটাকে দেখে অবাক, সেই
সাথে খুশিও। ওকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে হড়বড় করে গতকাল রাতের ঘটনা বলতে থাকে মৌ, ওর চোখে মুখে হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলছে। আর শরিফের
ভেতরে হচ্ছে এক বিরাট ভূমিকম্প, ধ্বসে পড়ছে এতো দিনের সব স্বপ্ন এক এক করে। মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে না বলা ভালো লাগা, গভীর প্রেমের উত্তাল ঢেউ এ ও
নিজেই তলিয়ে যাচ্ছে।
সেদিনের পর থেকে শরিফের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। এক মৌ ছাড়া কেউ তাকে খোঁজেও নি। সে রয়ে গেছে কেবল মৌর স্মৃতির অতলে।
হাইওয়ে দিয়ে ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে গাড়ি চলছে। মুশল বৃষ্টি ওয়াইপার মানছে না। দুহাত সামনের কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি চালাচ্ছে আসাদ। মাথার পেছনে
চুল পাতলা হয়ে গেছে, কপালের দুপাশে রূপোলী ঝিলিক, কিন্তু এখনো বেশ সুপুরুষ। দুহাত দূরত্বের মানুষটিকে অন্ধকারেই ভালো করে দেখল মৌ। এই মানুষটি এখন
কতো দূরের। শরিফ হারিয়ে যাওয়ার পর আসাদ ওকে আগলে রেখেছিল। সম্পর্কটা বিয়েতে যেয়ে গড়িয়েছে। মৌ কী সুখী হয়েছিল? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না। কিন্তু বৃষ্টি
আর এখন ভালো লাগে না তার। বৃষ্টি হলেই মনে পড়ে যায়, কাগজের নৌকো, এক সদ্য যুবকের দু বাহুর মাঝে বিহ্বল দৃষ্টি, মনে পড়ে যায় চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার
আগের সেই দিনটিতে শরিফের ভেঙ্গে চুড়ে যাওয়া অসহায় চোখ। আসাদের দিনে দিনে গড়ে তোলা উদাসীনতার পাহাড়ে ওই স্মৃতিগুলোই তার এখন বেঁচে থাকার
একমাত্র সম্বল। পুরনো দামি গহনার মতো সযত্নে তুলে রাখে মনের সিন্দুকে, মাঝে মাঝে বের করে ঝাড় পোঁছ করে আনমনে, ওদের উজ্জ্বলতা কমে না কখনোই।