রাহাতের সাথে আমার বন্ধুত্বটা সেই ক্লাস সিক্স থেকে। একই কালারের ব্যাগ, ঘড়ি পরে স্কুলে আসা। টিফিন ভাগাভাগি করে খাওয়া। রীতিমতো আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে সবাই হিংসা করতো। আবার বাবা ছিলো হাইস্কুলের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু রাহাতের বাবা ছিলো বড় ব্যবসায়ী। উচ্চবিত্ত পরিবার ওদের। তারপরও আমি ছিলাম ওর বেস্টফ্রেন্ড। প্রায়ই ওদের বাসায় যেতাম। বিশাল আলিশান বাড়ি। প্রথম দিকে ওদের বাড়ি গেলে একটু আন ইজি ফিল হতো।
রাহাতও নিয়মিত আমাদের বাসায় আসতো। একসময় ও যেন আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে গেল।
গতবছরের কথা আমরা তখন ইন্টারে নতুন ভর্তি হয়েছি। দেশে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছে। তাতে সামিল হলো আমার বাবা। হসপিটালে ভর্তি, অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট বিশ হাজারের নিচে চলে এসেছে। জরুরি রক্ত দেওয়া লাগবে। কিন্তু সমস্যা হলো রক্তের গ্রুপ ও’ নেগেটিভ। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকের গ্রুপে পোস্ট দিলাম কিন্তু ম্যানেজ হলো না। মনে পড়লো রাহাতের তো রক্তের গ্রুপ ও’ নেগেটিভ। সরাসরি চলে গেলাম ওদের বাসায়।
– কিরে কিছু না বলে হটাৎ অসময়ে বাসায় চলে এলি যে। তোর বাবার এখন কি অবস্থা?
_ বাবার অবস্থা বেশি ভালো না। রক্তের প্লাটিলেট অনেক নিচে নেমে এসেছে। জরুরী রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
– খোঁজ নিয়েছিস সব জায়গা? রক্তের গ্রুপ কি?
_ ও নেগেটিভ। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। তোরও তো ও নেগেটিভ। এজন্য সরাসরি তোর কাছে চলে এলাম।
– কিন্তু দোস্ত আমি তো রক্ত দিতে খুব ভয় পায়। এজন্য কখনো দেওয়া হয়নি। আর সকাল থেকে খুব শরীর খারাপ লাগছে। রক্ত দেওয়ার কথা শুনে ওর মুখটা কেমন জানি শুকিয়ে গেল। পাশের রুম থেকে আন্টি হয়তো আমাদের কথা শুনছিলো। এসে বললো,
– দেখো বাবা রাহাত তো খুব ছোট। ও কিভাবে রক্ত দিবে?
_ আন্টি আমাদের রক্ত দেওয়ার মতো বয়স হয়ে গেছে। আমিও তো চার মাস পর পর রক্ত দিই। রক্ত দিলে কোন অসুবিধা হয় না।
– ওর তো শরীর খারাপ। এমনিতেই ও সিরিঞ্জ দেখলেও ভয় পায়। রক্ত দিতে গিয়ে তখন নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে। তুমি একটু অন্য জায়গা খোঁজ নাও পেয়ে যাবে। সেদিন হতাশ হয়ে মন খারাপ করে ওদের বাসা থেকে ফিরে এলাম। কোথাও আর রক্ত পাওয়া গেল না। সন্ধ্যায় বাবা মারা গেল। রাহাত এসেছিলো আমাদের বাড়ি। কিন্তু হয়তো লজ্জায় আমাকে সান্ত্বনা দিতে কাছে আসেনি। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও বাদ যায়নি। আমাদের পরিবারের সবাই করোনা আক্রান্ত হলো। জীবন যুদ্ধে হার মেনে মা চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গেলাম।
রাহাতের সাথে আমার অনেক দিন যোগাযোগ হয়না। আমি সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ও আমার সাথে মিশতে সংকোচ বোধ করে। ফেইসবুকে পোস্ট দেখে বুঝলাম ওর আম্মুর করোনা পজেটিভ। আইসিইউতে রয়েছে। রাহাতকে ফোন করে হসপিটালে উপস্থিত হলাম। অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। ডাক্তার বললো দ্রুত প্লাজমা থেরাপি দিলে হয়তো রোগীকে বাঁচানো যাবে। কিন্তু প্লাজমা নিতে হবে তো কোন করোনা যুদ্ধে জয়ী হওয়া মানুষ থেকে। কারণ তার রক্তে ভাইরাস প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরী হয়েছে। রাহাতের চোখে চিন্তার ভাঁজ লক্ষ করলাম। এমন কাউকে এখন সে পাবে কোথায়।
_ তোর মায়ের রক্তের গ্রুপ কি?
– বি পজেটিভ দোস্ত।
_ আমারও তো বি পজেটিভ।
ডাক্তারকে ডেকে বললাম আমি প্লাজমা ডোনেট করবো। আপনি দ্রুত ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করুন। রাহাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ও একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছলছল চোখের নিচে জল চিকচিক করছে।
রক্ত দেওয়ার পর রাহাত এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
– তুই আজ আমাকে এতো বিপদে পাশে এসে দাড়ালি অথচ সেদিন আমি তোকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিস দোস্ত।
আমি হেসে বললাম তোর আর দোষ কোথায়, মৃত্যু তো তারই হাতে যিনি জীবন দিয়েছেন। তোর আম্মুর জ্ঞান ফিরলে আমার সালাম দিস। এটা বলে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলাম। আমার খুব আনন্দ লাগছে। খুশিতে চোখ দিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। প্রতিশোধ নিয়েছি এজন্যই হয়তো আমার মন এতো খুশি। এ প্রতিশোধ ভালবাসার। মনে মনে জসিমউদ্দিনের কবিতা আবৃত্তি করলাম, “আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা,আমি বাঁধি তার ঘর, আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। “
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প