ফ্রিজে পানি রাখার নাম করে, ছেলেটি সকাল সন্ধ্যা আমাদের ঘরে আসা যাওয়া করতেন। আমি ওঘর থেকে আওয়াজ পেতাম। রমজান মাসের শুরুতেই, দোতলার ফ্ল্যাটে ভাড়া উঠেছেন নতুন। তার অহেতুক আসা যাওয়ার কারণ অবশ্য আমি বুঝেছিলাম, তবে মাথায় নেইনি। ছোট বোন আর আমি, রোজকার নিয়মে বিকেল বেলায় ছাদে যেতাম। তাই ঐ সময় টাতে ভাড়াটিয়া কোনো ছেলে মানুষ ছাদে যেতেন না। বাবার কড়া নিষেধ!
একদিন ছাদে গিয়ে দেখি, ছেলেটি এক কোণায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছেন। আমায় দেখে যেন খানিকটা হতভম্ব খেয়ে গেলেন। তড়িঘড়ি করে সিগারেট নিভিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন- ‘মিস, আমি দুঃখিত। এ সময়ে আপনি ছাদে আসবেন আমার জানা ছিলো না! আহারে বেচারা! সত্যি ই তো। বিকেল ছাড়া তো অন্য সময়ে কাউকে ছাদে আসতে নিষেধ করা হয় নি। আমি তাকে দেখলাম না ভালো করে। তবে কোথায় যেন একটা টান রয়ে গেছে। সেই সুতোর প্যাচ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। আমি কিছুতেই তা খুলতে পারলাম না। কলেজ শেষে বাসায় ফেরার পথে, নিলয়ের সঙ্গে দেখা। প্রথম বারের মতো মুখোমুখি আমরা দুজন। আমার ভয়ে হাত পা সমানে কাঁপতে লাগলো। কেউ দেখে ফেলার আগেই আমি চলে আসতে চাইলাম সেখান থেকে।
পেছন থেকে নিলয় ডেকে বললো- আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেয়ো না তন্নি। আমি বুঝি, তুমি আমার থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারো না। কি বলে ছেলে টা? তার মতো করে যে মনে মনে আমিও তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। বুঝে ফেললো নাতো? নিলয় এখন ঘনঘন ছাদে যায়, কারণে অকারণে বারান্দায় ঘুরঘুর করে। জানি আমাকে দেখার জন্যেই! তবে বাবার চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই। আমাদের চিরকুটে প্রেম শুরু হলো। এরি মধ্যে নিলয়ের ছোট বোন, নাইমার সঙ্গে আমার খুব ভাব জমে গেলো। আমার কলেজের জুনিয়র সে। নিলয়ের মা প্রায় সময়েই আমার মায়ের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে উঠতেন। আন্টিকে ডাকার নাম করে নিলয় ও চলে আসতো। আমিও চলে যেতাম নাইমার সঙ্গে আড্ডা দিতে। সুযোগ পেলেই নিলয় আমার কাছে ভিড়তে চায়। মশা মারার নাম করে হাত ছুঁতে চায়! এভাবেই কাটছিলো দিনগুলো।
আমারো কলেজ লাইফ শেষ। আমি চলে গেলাম কুমিল্লায়, ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার জন্যে। ক্লাস, ক্যাম্পাস, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমি মেতে রইলাম এক অন্য জগতে। ছুটিতে ঢাকায় আসি, নিলয় কে আর আগের মতো পাওয়া হয়না। আমাদের দূরত্ব বাড়তে লাগলো। তাই জন্যেই কি লোকে বলেন?- চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়ে যায়! এরি মধ্যে নিলয় রা আমাদের বাসা ছেড়ে দিয়েছেন, নতুন কোথায় উঠেছে জানায় ও নি আমাকে। আমি জোর করিনি। সম্পর্ক টা এখন আর তেমন নেই যে! আমি নিলয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। নিলয় চাইলো না। মুখের উপর বলে দিলো- ‘কি হবে দেখা করে? অযথা মায়ার জালে আটকে রেখে আর কি লাভ!
তুমি আমার হবেনা কখনও। আমি নিয়তি মেনে নিয়েছি। বাবা তার কলিগের ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলেন। পরিবার কে বুঝাতে পারিনি, মধ্যবিত্ত ঘরের ঐ বেকার ছেলেটি ই আমাকে সুখী করার ক্ষমতা রাখে! আমি শেষ বারের মতো নিলয় এর সাথে দেখা করতে চাইলাম। ফোন করে বললাম- ‘খানিকটা পথ হাঁটবে আমার সাথে? ঐ পিচঢালা রাস্তায়! এক কাপ চায়ে নাহয় ভাগ করে নিবো একদিন, দুজনার না বলা কথাগুলো! দুই কদম দূরে দাড়িয়ে থেকেই, অনর্গল বলছিলো কথাগুলো- সম্পর্কের শুরুতে মন টা এমন অবুঝ থাকে কেন গো? আকাশ পাতালের ফারাক বুঝিনা। আমার ভেতরে দাগ কাটছিলো নিলয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা প্রতিটি অক্ষর।
আমি বললাম- নাহয় সারাজীবন একি পথে হেঁটে যাওয়া হলো না আমাদের। তাই বলে কি বন্ধুত্বের মায়াজালে থাকতে পারি না? প্রাক্তন কেবল প্রাক্তন ই থেকে যায়। প্রাক্তন কখনও ভালো বন্ধু হতে পারে না। বড়জোর তাকে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায়! তিনটি বাক্য শেষ করেই সটান হাঁটা দিলো নিলয়। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কি সুন্দর নিয়তির টানে ফিরে আসি আমরা, দূরে সরে যাই বাস্তবতার কঠিন নিয়মে!
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প