হাবিবুর রহমান সাহেব প্রায় আধাঘন্টা যাবত বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাসের কোন নামগন্ধ নাই। তার পা টনটন করছে।
কতক্ষন আর একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। একটা চেয়ার হলেও খানিকক্ষন বসে জিরিয়ে নেয়া যেত।
আচ্ছা তিনি যদি কাউন্টারে নিজের পরিচয় দেন তবে কি তাকে একটা চেয়ার দিবে না? দিবে না মানে? অবশ্যই দিবে।
কাউন্টারে যে ছেলেটা টিকিট বিক্রি করছে এবং যার চেহারার সাথে মোশাররফ করিমের খানিকটা মিল আছে,
সে হয়ত বাপ বাপ করে নিজের চেয়ারটাই ছেড়ে দিবে। শুধু এখানেই হয়ত শেষ হবে না- পাশের দোকান থেকে হয়ত চা-ও এনে দেবে।
যদিও এখন হাবিব সাহেব চা খেতে পারবেন না। তার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। খালি পেটে চা খেলে পেটের ভেতর গুমগুম আওয়াজ হয়।
আজকে অফিসে যেতে দেরী হয়ে যাওয়ায় নাস্তা করা হয় নি।
হঠাৎ পেছনের যাত্রীর ধাক্কা খেয়ে হাবিব সাহেবের চমক ভাঙ্গে। বাস এসে গেছে। বাসের দিকে তাকাতেই হাবিব সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল।
বাসভর্তি মানুষ। এই স্টপেজটাতে কখনো বাস খালি আসে না। অলরেডি বাসের ভেতর দু’একজন ঝুলছে।
হাবীব সাহেব মুখ ভোঁতা করে বাসের দিকে এগুলেন। মানুষজনের হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে। এখন দাঁড়ানোর জন্য ভালো একটা জায়গা পেলে হয়।
ছোটখাট একটা যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত হাবিব সাহেব একহাতে কোনরকমে স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চারিদিকে মানুষ। নড়াচড়ার উপায় নেই।
তবুও তিনি একটু নড়ে আরেকটু ভালোভাবে দাঁড়াতে চাইলেন।
–‘ভাই নইড়েন নাতো। যেম্নে আছেন অম্নে থাকেন।’
পাশের গুন্ডামার্কা লোকটার কথা শুনে তিনি নড়ার শক্তি বা সাহস কোনটাই পেলেন না আর- সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলেন।
আচ্ছা তিনি কি নিজের পরিচয়টা দেবেন? পরিচয় পেলে মানুষজন নিশ্চয়ই তাকে খানিকটা খাতির করবে। তার গায়ের উপর থেকে সরে যাবে।
যে ছেলেটা অনেকক্ষন ধরে পায়ে পাড়া দিয়ে আছে- সেও লজ্জায় পা সরিয়ে নিবে নিশ্চয়ই।
আর কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সিট থেকে উঠে জায়গা ছেড়ে দেবে। জানালার কাছে জায়গা পেলে ভালো হয়। জানালার কাছে বসাটা তার পছন্দের।
তিনি জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকবেন। আর মানুষজন তার দিকে অন্যরকম করে তাকাবে। তবে হাবীব সাহেবও এত বোকা না।
তিনি কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বাইরের দিকে চেয়ে থাকবেন।
–‘উফফফ’
পায়ে আরেকজনের পাড়া খেয়ে হাবীব সাহেব বাস্তবে ফিরে আসলেন। ব্যথায় তার মুখ কুঁচকে গেছে।
কিছু একটা বলি বলি করেও তিনি সামলে নিলেন। কারন পাড়া দেয়া পায়ের মালিক গুন্ডামার্কা লোকটা।
তার ঝাড়ুর মত গোঁফ দেখে হাবীব সাহেব আর কিছু বললেন না। পা-টা খানিক সরিয়ে নিলেন।
–‘ভাড়া দেন।’
কন্ট্রাকটর ছোকরাটা কানের কাছে চিৎকার করে উঠল। অনেককষ্টে তিনি একটা চড় মারার ইচ্ছেটাকে চাপা দিলেন।
অবশ্য ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। এই ভীড়ে হাত ঘোরানো যাবে না। তিনি অনেক কষ্টে মানিব্যাগ হাতড়ে ভাড়া দিলেন।
ছোকরার বয়স কম। অল্পবয়সী কন্ট্রাকটরগুলা বেয়াদব হয়।
–‘কই যাবেন?’
–‘মালীবাগ’
–‘বিশ টাকা ভাড়া। আরো পাঁচ টাকা দেন।’
হাবীব সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। কতবড় বেয়াদপ।
–‘পনের টাকা করেই যাওয়া-আসা করি।’
–‘আরো পাঁচ টাকা দেন’
–‘নিলে নে, না নিলে ভাগ’
–‘আপনার টাকা আপনে রাখেন। ভাড়া লাগবো না।’
হাবীব সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। মাঝারি সাইজের একটা চড় লাগিয়ে দিলেন।
এজন্য অবশ্য তাকে বেশ পরিশ্রম করতে হল। অনেকখানি সরে গিয়ে ঘুরে কাজটা করতে হল।
বাস জ্যামে দাঁড়িয়ে আছে। হাবীব সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। আজো আধাঘন্টা দেরি হয়ে গেছে। প্রতিদিন বসের ঝাড়ি খেতে ভাল্লাগেনা।
আচ্ছা বস কি জানেন তিনি কে? জানেন না হয়ত। জানলে নিশ্চয়ই এভাবে ঝাড়ি দিত না। হয়ত মাঝে মাঝে রুমে ডেকে নিয়ে গল্প করতেন।
দেশ নিয়ে দু’একটা ভারী ভারী কথাও হত। দুজনের সামনে থাকত দুইকাপ চা।
ধোঁয়াওঠা কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হত জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে।- ভাবতে ভাবতেই হাবীব সাহেব ফোন বের করলেন।
মানুষের ভীড় অনেকটা হালকা হয়ে গেছে।
ফেসবুকে ঢুকতেই হাবীব সাহেবের মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল। অনেকগুলো নটিফিকেশন আর ইনবক্স জমে আছে।
এগুলো আয়েশ করে দেখতে হবে। ফেসবুকে চোখ বুলিয়ে বুঝলেন আজকে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সবাই অনেককিছু লিখছে।
ভারী ভারী কথায় হোমপেইজ ভরা। হাবীব সাহেব জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। তাকে এমন কিছু লিখতে হবে যেটা একটু অন্যরকম।
অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না। তিনি একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি। তিনি ‘কা কা’ লিখলেও হাজারখানেক লাইক পড়বে।
শেয়ার হবে কয়েশকবার। স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টের বন্যা বয়ে যাবে। দুই-একজন অতিআবেগী মানুষ হয়ত আবেগে কেঁদেও ফেলতে পারে।
অতীতে এরকম হয়েছে বেশকয়েকবার। তার ঈদ মোবারকের স্ট্যাটাসে কমেন্ট এসেছে ‘ভাই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না’।
এসবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে তিনি শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কঠিন কিছু কথা ভাবতে চেষ্টা করছেন। কয়েকটা লাইন এসেছে।
ভাবতে ভাবতে তার নিজেরই চোখে পানি চলে আসে আসে- অবস্থা। আজকে নিশ্চিত ফেইসবুকে কান্নার রোল নেমে যাবে।
হাবীব সাহেব ভুরু কুঁচকে ভাবছেন। ফিনিশিংটা আসি আসি আসছে না।
ঐ কনট্রাকটরটাকে চড় মারার পর থেকেই হাতটা টনটন করছে। মনযোগ ধরে রাখা যাচ্ছেনা।