বিষ

বিষ
আব্বা প্রায় প্রতিরাতে মদ খেয়ে বাসায় এসে আম্মাকে মারতেন। খুব মারতেন।যে রাতে মদ খেয়ে খারাপ মেয়েগুলোর বাসায় পড়ে থাকতেন সে রাতে আম্মা মারের হাত থেকে বেঁচে যেতেন।আমার “সাত চড়ে রা ” না করা আম্মা মার খেয়ে নিঃশব্দে কাঁদতেন। প্রায় মনে হত আম্মা চায় আব্বা ওই বাজে মেয়েগুলোর বাড়িতেই পড়ে থাক। আমিও তাই চাইতাম। দাদীও চাইতো। আমি আর দাদী পাশের রুমে থাকতাম। দাদী অন্ধ ছিল। সারাদিন সারারাত হামুন দিস্তায় খটখট শব্দ তুলে পান সুপারি ছেচতো। ওই শব্দে আমার না ঘুম আসতো, না পড়ায় মন বসতো। বিচ্ছিরি কান তালা লাগানো একঘেয়ে খটখট টংটং শব্দ। দাদীকে বকা দিলে বলতো এই শব্দে কষ্ট কমে রে, কষ্ট কমে। প্রতিবার হামান দিস্তায় একটা করে ছেচা দেই আর দুনিয়ায় যারা যারা কষ্ট দিছে মনে মনে তার মাথায় বাড়ি দেই। আমার দাদাজান অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন।
তিনি আমার বাবার মত চারিত্রিক সমস্যাপ্রবণ ছিলেন না কিন্তু খুব রাগী আর সন্দেহপ্রবণ ছিলেন। বাবার মতন তিনিও দাদীকে মেরে মেরে ফেলে রাখতেন। অতিরিক্ত মাথায় আঘাত পাওয়ার কারনে দাদী অন্ধ হয়ে গেছিলেন। দাদি অন্ধ হওয়ার কিছুদিন পর আমার বদরাগী দাদা একদিন শেষ রাত্রে মুখে রক্ত উঠে মারা গেলেন। শুনেছিলাম তিনি আরেকটা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছিলেন । অন্ধ বৌ নিয়ে কি আর সংসার করা যায়। আমি অবশ্য তখন ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে। যাই হোক দাদা মারা যাবার আট বছর পর্যন্ত জমিজমা সব দাদির দখলেই ছিল। অন্ধ হলেও করিম চাচা যিনি কিনা আমাদের জমি দেখাশোনা করতেন তার বদৌলতে দাদী ঠিকঠাক সব চালিয়ে নিচ্ছিলেন।
আব্বার হাতে কিছুই ছিলনা তাই আব্বাও অতটা উশৃঙ্খল হয়ে উঠেনি তখন । সেবার দাদির খুব অসুখ হলো, মরমর অবস্থা। তাই দাদী সব কিছুই বুঝিয়ে দিলেন আব্বাকে।অশান্তি তখনই শুরু হল। আব্বা জমি বেচতে লাগলেন আর উড়াতে লাগলেন। আমার বয়স তখন পনেরো ছুঁইছুঁই। সেই কিশোরী বয়সের একটা মেয়ের মনে তখন পারিবারিক অশান্তির কালো মেঘ। আম্মাকে যখন আব্বা মারতেন দুই এক বার আমি আম্মাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম। আব্বা আমাকে মেরেও একসা করে রেখেছিলেন। দুদিন জ্বরে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি।আব্বা আর দাদাজান আমাকে পছন্দ করতেন না আমি মেয়ে বলে। আমি ছাত্রী খুব ভালো ছিলাম। হয়তো সারাক্ষণ পারিবারিক অশান্তি এড়ানোর জন্য বইয়ে মুখ গুজে থাকতাম। আর চাইতাম খুব ভালো রেজাল্ট করে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। যেদিন নিজের পায়ে দাড়াব আম্মা আর দাদীকে নিয়ে যাব।
আমাদের বাড়ির পিছনটা জংলা গোছের। প্রচুর গাছ সেথায় আছে নাম না জানা প্রচুর লতাপাতার ঝোপঝাড় । আছে দাদাজানের কবর। কিন্তু দাদী কোনদিন দাদাজানের কবর জেয়ারত করতেন না। আমার অবাক লাগতো। দাদী প্রতি বুধবার আমাকে নিয়ে সেই জংলাতে গিয়ে কি জানি কি লতাপাতা জোগাড় করতেন। চোখে দেখতেন না বলে আমার সাহায্য তার লাগতই আর গন্ধ শুকেই বলে দিতেন কোনটা কোন লতাপাতা। আমিও দাদীর সাথে সেগুলো চিনতে শিখেছিলাম। দাদী ওসব লতাপাতা দিয়ে টোটকা বানাতেন। ওষুধ বানাতেন। ওসব খেয়েই নাকি সুস্থ থাকতেন। সম্পত্তি হাতে পাওয়ার পর আব্বা তিন বছর শুধু জমি বেচলেন আর টাকাই ওড়ালেন। ইদানীং আব্বা বাড়িতে আসেন না। আমারও পরীক্ষা শেষ তখন।
খুব শখ বড় কোন মেডিক্যাল বা ভার্সিটিতে পড়ব। দাদী বলেছেন দাদীর একশ ভরি গয়না বিক্রি করে আমাকে দিয়ে দেবেন যেন পড়াশোনার ক্ষেত্রে অসুবিধা না হয়। সেদিন বিকেলে আব্বা হঠাৎ বাড়ি এলেন। একদম স্বাভাবিক অবস্থায়। আব্বাকে দেখে আমার কলিজা কেঁপে উঠলো। আব্বা এসেই দাদীর ঘরে ঢুকে কিকি জানি বলে আবার চলে গেলেন। দাদী সেই ঘোর সন্ধ্যায় করিম চাচাকে ডেকে নিয়ে আসলেন। কি কি জানি কথাবার্তা হলো। রাতে ঘুমানোর আগে জানলাম সংসারে ছেলে সন্তান নাই বলে আব্বা আবারও বিয়ে করবেন তাই দাদীর একশ ভরি গয়না আর দাদীর কাছে থাকা বাকি ত্রিশ বিঘা জমি আর ভিটামাটির দলিল তার চাই। করিম চাচা জানিয়েছেন আব্বা সব জমি বিক্রি করে ফুর্তি করে উড়িয়েছেন তার হাতে আর টাকা নাই জমিও নাই। পরের দিন আব্বা আবারও এলেন।
দাদী খুব শান্ত মাথায় জানিয়ে দিলেন আর সপ্তাহ খানেক পর দাদাজানের মৃত্যুবার্ষিকী। দাদাজানের মৃত্যু বার্ষিকীর পরের দিন জমির দলিল আর গয়না দিয়ে দেবেন।দাদীর এহেন সিদ্ধান্তে আমার স্বপ্নগুলো গুঁড়িয়ে গেল যেন। আমি সারারাত কাঁদলাম আর দাদী সেই হামুন দিস্তায় সারারাত দ্বিগুণ শব্দে পান সুপারি ছেচতে লাগলেন।দু তিনদিন এভাবেই চলে গেল। আমার এখনও মনে আছে দিনটি ছিল রবিবার। দাদী খুব ভোরে আমাকে সংগে নিয়ে বাড়ির পেছনের সেই জংলা জায়গায় গেলেন।অথচ দাদী বুধবার ছাড়া ওই জায়গায় কখনও যাননা। আজ কেন জানি গেলেন! অনেক খুজে বেশ কয়েকটা লতাপাতা জোগাড় করলেন। আমাকে পই পই করে চেনালেন সব। আসার সময় এই প্রথম দাদি দাদাজানের কবর জিয়ারত করলেন আর খুব কাঁদলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। তারপরের দিন দাদাজানের মৃত্যুবার্ষিকী। আমি জানি মৃত্যুবার্ষিকীর পরেরদিন আব্বা সব বুঝে নেবেন, নতুন বিয়ে করবেন।
সেদিন সারাদিন দাদী ঘর থেকে বেরুলেন না, দুপুরে খেলেনও না। সারাদিন হামুন দিস্তায় টং টং শব্দ করে গেলেন। আম্মা সারাদিন কান্নাকাটি করলেন আর আমি বাড়ির পুকুরঘাটে বিষন্ন হয়ে বসে রইলাম।সেদিন সন্ধ্যায় আব্বার সাথে দাদির হালকা বচসা হল। দাদী চাইছিলেন একশ ভরি গয়না আমার লেখাপড়ার খরচের জন্য আর ভিটেমাটি মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে রেখে দেয়ার জন্য। কিন্তু আব্বা শাসালেন ভালয় ভালয় সব কিছু না দিলে কিভাবে আদায় করতে হয় তা আব্বার জানা আছে। দাদি হেরে গেলেন। আব্বাকে জানালেন পরেরদিন দাদি সব দিয়ে দেবেন। আব্বা হাসিমুখে রাজ্যজয় ভংগীতে দাদীর হাতে বানানো পান খেয়ে ঘরে এসে রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন। ভোর রাতে দাদার মৃত্যুদিনেই আমার আব্বা ঠিক দাদার মতই নাকে মুখে রক্ত তুলে মারা গেলেন।
শেষাংশ : আব্বা মারা যাওয়ার পর দাদী তিনবছর বেঁচেছিলেন। প্রতিদিন আব্বা আর দাদাজানের কবরে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করতেন। আমি আমেরিকাতে থাকি এখন।অনেক নামকরা সাইন্টিস্ট আমি।আমার অনেক নামডাক । আমার আম্মাও আমার সাথে থাকেন। দাদীর রেখে যাওয়া একশ ভরি গয়না আর বাকি সম্পত্তি বেচে আমি আমার পড়াশোনা কমপ্লিট করেছিলাম। ও হ্যা, এর মাঝে দেশে গিয়ে আমি দাদীর সেই লতাপাতাগুলো সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেছি। নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশালে সেটা মারাত্মক বিষ তৈরি হয়।
মানুষকে খাওয়ানো মাত্রই মানুষ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় এবং ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়। কিন্তু কোন পোস্টমার্টেম রিপোর্টে এটা আসেনা। তাই এত্ত নিখুঁত “খুন ” ধরা পড়েনা।আমার দাদীর নাম ছিল আলেয়া বানু। আমার মেয়েটার নামও “আলেয়া “।যিনি আমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এতটা নির্দয় হয়েছিলেন তাকে তো আমি সারাজীবন ভালোবেসে জীবিত রাখতে চাই আমার চোখের সামনে। তাইনা। আপনারা কি বলেন?
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত