দীর্ঘদিন ধরে অনুবাদের কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন ঈশানী রায়চৌধুরী। ইংরেজি থেকে বাংলায় তিনি কর্তৃক ভাষান্তরিত কাহিনির সংখ্যা বড় কম নয়। তার সঙ্গে রয়েছে নিজের লেখালিখিও।
এই বাড়িটায় আমরা থাকি। আমরা মানে আমি, সমীরণ আর অঞ্জন। আমার নাম স্বাতী। সমীরণ আমার বর। আমাদের বিয়ের বয়স বছর তিনেক। এখনও আমাদের কোনও ছেলেমেয়ে হয়নি। অঞ্জন সমীরণের বন্ধু। ওর বিয়ে থা হয়নি যদিও, নিত্যিনতুন বান্ধবীর অভাব নেই! আর বিদেশ-বিভূঁইয়ে এ সব নিয়ে তেমন মাথাও ঘামায় না কেউ।
ওঃ, বলাই তো হয়নি। আমরা এডিনবরায় থাকি। সমীরণ আর অঞ্জন, দু-জনেই ডাক্তার। সমীরণ সার্জেন আর অঞ্জন গায়নোকলোজিস্ট। সেই এক স্কুল, এক মেডিক্যাল কলেজ। তারপর দু-চার বছর দু-জনেই এদিক সেদিক ঘুরে আবার এখানে একসঙ্গে।
অঞ্জন আলাদা বাড়ি নিতেই পারত, কিন্তু আমরাই জোর করেছিলাম। একা মানুষ, আলাদা থাকার হ্যাপা তো কম নয় ! আমিও এখানে এসে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছি। আমারও বায়োফিজিক্সে পি এইচ ডি করা ছিল, তাই হাসপাতালেই একটা রিসার্চ প্রজেক্টে দিব্যি চাকরি জুটে গেছে। বাচ্চাকাচ্চা নেই, তিনজনেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ঘরের কাজও মিলেমিশে ঠিক হয়ে যায়। আর সমীরণ, অঞ্জন দুজনেই ভালো রান্না করে। তাই রান্নাটাও আমরা তিনজন মিলেই ভাগাভাগি করে সারি।
এ বাড়িটা বেশ। শোবার ঘর তিনটে। আমাদের দুটোতেই কাজ চলে যায়, তিন নম্বরটা গেস্টদের জন্য সাজিয়ে রাখা। বড় লিভিংরুম, ডাইনিং রুম, কিচেন, প্যান্ট্রি ছাড়াও খুব মিষ্টি একটা ব্রেকফাস্ট রুম আছে, কিচেনের লাগোয়া। তার সিলিঙটা কাচের। সকালবেলা নরম রোদ্দুর আসে যখন, প্রচুর পাখি ডাকে, চারদিক ঘন সবুজ …মনে হয় জঙ্গলের মধ্যে আছি। এই ঘর থেকে একটা মস্ত কাচের দরজা খুলে পেছনের ডেকে যাওয়া যায়। আমরা অনেক সময় ওখানে বসে ছুটিছাটা থাকলে বিকেলে চা খাই। বেসমেন্টটা আমার বেশ পছন্দের। ওখানে একটা বড় স্টাডি আছে, যে যখন ইচ্ছে নিরিবিলিতে কাজ করতে পারি। আর একটা বিশাল ঘর জুড়ে আছে আমাদের তিনজনের অজস্র বাংলা ইংরিজি বই আর হোম থিয়েটার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো আরাম করে বসার জায়গাও। আমি ওটার নাম দিয়েছি ‘আড্ডাঘর’। ওরা দু-জন বলে ‘ঠেক’।
ছায়ামানবী
আমাদের বাড়িটা একটু উঁচু জমিতে। অবিশ্যি এডিনবরার রাস্তাঘাট সর্বত্রই উঁচুনিচু। আমার ভীষণ পছন্দের হল, এ বাড়ির চারপাশে সাদা পিকেট ফেন্স। আমাদের বাড়িটাও ধবধবে সাদা। জানলা দরজাগুলো ওক কাঠের। সদর দরজায় আবার একটা বড় পেতলের ঘণ্টা লাগানো। সামনে পেছনে বাগানও আছে। সামনের দিকটায় ফুলগাছ। পেছনে একটা মস্ত আপেল গাছ, একটা নাসপাতি গাছ। খুব ফল হয় দুটোতেই। আমি গত বছর অনেক টম্যাটো আর গাজর ফলিয়েছিলাম। একটা বুড়ো সিলভার বার্চ আর একটা যুবক জুনিপারও আছে। একজন মালী আছে, জন। সপ্তাহে একদিন এসে বাগানের পরিচর্যা করে। আমি এবার দেশ থেকে লঙ্কা, দোপাটির বীজ এনে লাগিয়েছি। দেখি, হয় কী না ! জন বলছিল এবার ও বেল পেপার্স লাগাবে। লাল -সবুজ-হলুদ। শুনেই অঞ্জন বলল, “ব্যাকইয়ার্ডে ট্রাফিক সিগন্যাল।”
অঞ্জন কেন কে জানে, কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি নয়। অনেকবার খুঁচিয়েছি, ব্যর্থ প্রেম কি না, জানতে। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। এত অদ্ভুত ! এদিকে মেয়েদের সঙ্গে ভাব করার বিরাম নেই। আজ লুসি, কাল লিজা , পরশু বিয়াঙ্কা। যদি বলি, “ফুলে ফুলে মধু না খেয়ে এবার ঘর বাঁধো” , অমনি বলে, “ মিষ্টি খেতে ভালবাসলেই কি গরু পুষতে হবে, না কি মিষ্টির দোকানের মালিকানা চাই ?”
সেদিন শুনি কোন একটা স্প্যানিশ মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে মেয়ের দিদিমা না কি আবার তুকতাক, তন্ত্রমন্ত্র জানতেন ! এই মেয়েটা অ্যানথ্রপলজির ছাত্রী। দু- বছরের জন্য এডিনবরায় এসেছে। কোন সুপারমার্কেটে শুনলাম আলাপ হয়েছে। বুঝি না বাপু ! সুপারমার্কেটে আলাপ হল, একদিন কফি খেতে গেল, পরের দিন ডিনার ডেট আর ও মা, তার পরের দিনই সন্ধের পরে দু-জন দু-জনের গায়ে লেপটে থেকে সটান আমার আর সমীরণের নাকের সামনে দিয়ে ড্যাংড্যাং করে বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ! না না, মিথ্যে বলব না, তার আগে আমাদের “হাই”, “হ্যালো”, “সো নাইস টু মীট য়ু” করে গেছে। অঞ্জনের আগের গার্লফ্রেন্ডগুলো অন্তত দিন পনেরো সবুর করত ! মেয়েটার নামটাও ভারী অদ্ভুত ! কঞ্চিতা। দেখতেও অমন কঞ্চিপানা , হিলহিলে। কালো চুল, কালো চোখের মণি। কেমন একটা চকরাবকরা আলখাল্লার মতো জামা আর হাওয়াই চপ্পল পরে চলে এল আমাদের বাড়িতে ! এমনিতে কিছু নয়, আমার কেমন অকারণেই ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটায় শিরশির করে উঠল। মনে হচ্ছিল, আমার সমস্ত শরীরটা কাচের, ও যেন ভেতরের সবটুকু দেখতে পাচ্ছে।
আরও ছোট গল্প পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
(২)
জানতাম! আমি জানতাম, একদিন না একদিন ঠিক একটা কেলেঙ্কারি হবে। আশ্চর্য বেআক্কেলে ছেলে তো অঞ্জন! নিজে ডাক্তার, একটু হুঁশ থাকবে না? কঞ্চিতার সঙ্গে মাত্রাছাড়া মাখামাখি শুরু করেছিল। যেমন দ্যাবা, তেমন দেবী! সেদিন শুনি, ফোনে খুব কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আড়ি পাতা আমার স্বভাব নয়, তবে অত জোরে জোরে কথা বললে কানে তো দু-চার কথা আসবেই! কঞ্চিতা না কি প্রেগন্যান্ট! আর সে বাচ্চার বাবা না কি অঞ্জন। একটু অবাকই হয়েছিলাম। এমন অপরিণামদর্শী আচরণ করে কী করে এরা? নাঃ, অঞ্জন যে কালপ্রিট, এ নিয়ে আমার সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই কারণ অঞ্জন নিজেই সে কথা মেনে নিয়েছিল ফোনে। যা বুঝলাম, কঞ্চিতা চাইছে বিয়ে করতে। বাচ্চাটা পিতৃপরিচয় পাক, সে তো সব মায়েরাই চায়। এদিকে অঞ্জন রাজি নয়। সে বলেই যাচ্ছে, কঞ্চিতা সবে কনসীভ করেছে যখন, কোনও রিস্ক তো নেই; টারমিনেশন করে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়! আরে বাবা, অত সহজ ? কঞ্চিতা রোমান ক্যাথলিক। ওরা গর্ভপাতের ঘোর বিরোধী। আমি মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলাম। বেশ হয়েছে ! ঠ্যালার নাম বাবাজী ! শুধু ফুর্তি করব, কিন্তু দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলব, এটাই বা কেমন কথা!
আমি অবশ্য এ নিয়ে কিছুই বলিনি অঞ্জনকে। কচি খোকা তো আর নয় ! সমীরণকেও নাক গলাতে বারণ করে দিয়েছিলাম। তা অঞ্জন দেখি পরের দিন রাত্তিরে ডিনার টেবিলে বসে নিজেই কথাটা তুলল। আমাদের কাছে মরাল সাপোর্টের আশা করেছিল হয়ত ! সমীরণ দেখলাম তেমন গা পাতল না। আমিও কথা বাড়াইনি। আমাদের কাছে এ সব নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই জেনে অঞ্জনও থেমে গেল। তবে নরমে গরমে যেমন কথাবার্তা চলার আঁচ পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল কিছু একটা সিদ্ধান্ত ওরা নেবে শিগগিরই।
কোথা দিয়ে কী বোঝাপড়া হল, জানি না। তবে অঞ্জনের কাছ থেকে জানতে পারলাম, কঞ্চিতা না কি টারমিনেশনে রাজি হয়েছে। অঞ্জনই সব ব্যবস্থা করে চুকিয়েবুকিয়ে এল সে সব। আমি তো ভেবেছিলাম, সম্পর্ক ভেঙে গেল এবার। তাজ্জব ব্যাপার ! মেয়েটা অঞ্জনের সঙ্গেই লেগে রইল। অঞ্জনও বোধহয় মনে মনে খানিক অপরাধবোধে ভুগছিল, ও-ও দেখলাম মেয়েটার সঙ্গে স্টেডি রিলেশন মেনে নিয়েছে। মেয়েটা ওকে এই ঘটনার পরে আর বিয়ে করার কথা বলেনি , তাই অঞ্জন মনের ফুর্তিতেই আছে।
কঞ্চিতা আসে, যায়। মাঝেমধ্যে একটানা দু-চার দিন থেকেও যায়। আমাদের সঙ্গে, বিশেষ করে আমার সঙ্গে খানিক গল্পগুজবও হয়। আর সোম থেকে শুক্র তো আমরা কেউই সারাদিন থাকিও না। শনি-রবি কঞ্চিতাও থাকে যখন, টুকটাক রান্নাবান্না করে, ঘর গোছায়। ওর পরিবারের গল্প করে। শুধু আমি একদিন ওর দিদিমার কথা তুলেছিলাম, অল্প হেসে এড়িয়ে গেল।
ছায়ামানবী
আমাদের এ বাড়িতে একটা পিয়ানো আছে। আমরা কিনিনি, আগে থেকেই ছিল। বাড়িওয়ালী বুড়ির মায়ের সম্পত্তি। বুড়ি নিয়ে যায়নি। কিন্তু আমাদের পইপই করে বলেছে, যত্নে রাখতে। ইচ্ছে করলে না কি বাজাতে পারি। নিয়ম করে বছরে একবার একটা খুনখুনে বুড়োকে পাঠিয়ে দেয় পিয়ানো টিউন করতে।
ছায়ামানবী
মার্গট, মানে আমাদের বাড়িওয়ালী তো বলেই খালাস ! বাজাবে কে ? সমীরণ বে-সুর, অঞ্জন ইন্টারেস্টেড নয়, আমার বিদ্যে ওই বাঁ হাতে হারমোনিয়ামের বেলো টেপা পর্যন্ত। আমিই তবু অবরেসবরে এক হাতে পিয়ানোর সাদা-কালো রীড টিপে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজাই। এখন কঞ্চিতা আসার পরে পিয়ানোটার তবু গতি হয়েছে। দিব্যি বাজায় মেয়েটা। বিশেষ করে পুরোনো ইংরিজি গান আর স্প্যানিশ লোকগীতি। শুধু …বুঝি না… সব সময়েই বাজাতে বসে যখন, শুরুতে আর শেষে একটা অদ্ভুত ঘুমপাড়ানি সুর বাজায় …কেমন ঝিমঝিমে , আচ্ছন্ন করা।
ছায়ামানবী
(৩ )
কলকাতা থেকে কেউ আসছে শুনলেই এত আনন্দ হয় আমার ! অঞ্জনের দিদি আসছে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে। ওর জামাইবাবু কী একটা কাজে একমাসের জন্য লন্ডন আসছেন, সঙ্গে বৌ আর ছেলেমেয়েরা আছে এবার। জামাইবাবু আসতে পারবেন না , বড্ড কাজের চাপ। ওর দিদি পাঁচদিনের জন্য আমাদের এখানে ঘুরে যাবে। আমিও চিনি সংযুক্তাদিকে। ফোনে কথা বলেছি, ফেসটাইমে ভিডিও কলে দেখেছি। সমীরণ তো সেই কোন যুগ থেকেই চেনে ! অঞ্জনের থেকে মাত্র দু-বছরের বড়। তার মানে আমার চেয়ে বছর চারেকের সিনিয়র। ভারী মিষ্টি আর হাসিখুশি। যমজ ছেলেমেয়ের মা। কাজু আর পেস্তা। ওদের বয়স এই সবে তিন বছর পুরল। অঞ্জনের খুব পেয়ারের ভাগ্নে-ভাগ্নী। একদিন ভিডিও কল হলে এক সপ্তাহ ধরে ওদের গল্প চলে আমাদের বাড়িতে, কার্টসি অঞ্জন। আমার অবশ্য দারুণ লাগে ! বাচ্চাদুটো এমন আদরকাড়া!
ছায়ামানবী
একটাই সমস্যা। আমাদের এই মুহূর্তে যা কাজের চাপ, কেউই আমরা ছুটি নিতে পারব না। সুতরাং পাঁচ দিনে একটা উইকএন্ড বাদ দিলে তিনদিন ওদের সারাদিন একাই থাকতে হবে বাড়িতে। ছি ছি, এত খারাপ লাগছিল আমার! যদি সংযুক্তাদি বারেবারেই বলছে ওটা কোনও ব্যাপারই নয়, কিন্তু তাতে তো আর আমাদের খারাপ লাগাটা মিলিয়ে যায় না!
ছায়ামানবী
কপাল ভালো বলতে হবে। কঞ্চিতা শুনেই বলল তিনটে দিন ও ছুটি নেবে। অঞ্জনের দিদিকে ও তো চেনে, মানে অনেক গল্প শুনে শুনে চিনেই নিয়েছে আর ছোট ছেলেপুলে সামলাতে ও না কি এক্সপার্ট ! আমি ঠিক করলাম যতটা পারি রান্নাবান্না করে ফ্রিজে রেখে দেব।
সত্যি কিন্তু ভেল্কি দেখাল বটে কঞ্চিতা! সংযুক্তাদিরা বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র কাজু আর পেস্তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল। কাজু-পেস্তা ভাঙাভাঙা ইংরিজি বলে, কঞ্চিতা খিলখিল করে হাসে, ওদের মতো করে ও-ও থেমে থেমে টুকরোটাকরা ইংরিজি বাক্য বলে। কাজু আর পেস্তার তাতে কমিউনিকেট করার সুবিধে হচ্ছে। এমনকী দ্বিতীয় রাত থেকেই তো এমন বায়না করতে শুরু করেছে ভাইবোন, যে কঞ্চিতা ওদের নিয়ে গেস্টরুমে শুচ্ছে, আমি আর সংযুক্তাদি আমাদের ঘরে শুচ্ছি আর অঞ্জন আর সমীরণ অঞ্জনের ঘরে। আমাদের তো খুব মজাই হচ্ছে, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিচ্ছি। অঞ্জন বলছে সমীরণ না কি বেজায় নাক ডাকে। বেশ হয়েছে ! এতদিন আমি বলতাম, সমীরণ তেড়ে ঝগড়া করত। অঞ্জন মোবাইলে রেকর্ড করে শুনিয়েও দিয়েছে সকলকে।
ছায়ামানবী
কাজু আর পেস্তা সারাক্ষণ আঁকড়ে আছে কঞ্চিতাকে। অদ্ভুত কেমিস্ট্রি ওদের মধ্যে ! কেউ কাউকে চিনতই না, আর এখন এমন, যেন সাতজন্মের চেনা ! আমাদের ব্যাকইয়ার্ডের পরেই বেড়ার ওপারে অনেকটা ঘাসজমি, তাতে বড় বড় ঘন সবুজ পাতাওয়ালা ফুলবিহীন ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া উঁচু গাছ। ডালগুলো এক এক জায়গায় এমনভাবে এগিয়ে বেরিয়ে এসেছে জমির সমান্তরালে, যে খুব হাল্কা ওজনের মানুষ উঠে বসলেও হয়ত ভাঙবে না। আমি দু-একবার তো দলছুট হরিণও দেখেছি। পাখি, কাঠবিড়ালি, বুনো খরগোশ তো হামেশাই দেখা যায়। কাজু পেস্তাকে নিয়ে বেড়ার দিকের ছোট গেট খুলে কঞ্চিতা ওই মাঠে ঘুরেও এসেছে। তবে এমনিতে আমরা গেটে তালা দিয়ে রাখি। মাঠের ওপারে ঘন জঙ্গল। তবে বুনো জন্তুজানোয়ার নেই। আমাদের এদিকে চোর -ছ্যাঁচড়ের উৎপাতও নেই। আমাদের তো ভালোই লাগে একটু এমন নিরিবিলিতে থাকতে।
ছায়ামানবী
এমন মজা লাগে! কঞ্চিতা পিয়ানোতে বসলেই বাচ্চাদুটো ওই ঘুমপাড়ানি গানের সুর বাজাতে বলে। তার সঙ্গে দু-জন আবার অল্প অল্প দোলে।
এর মধ্যে উইকএন্ড পড়েছিল। আমরা সকলে শনিবার লক লোমণ্ড ঘুরে এলাম, আর রোববার লক নেস। কাজু আর পেস্তা জলের নিচে ‘নেস’ নামের জলদানবকে দেখার জন্য হাঁকপাঁক করছিল। অঞ্জন আর সমীরণ পারেও বটে ! যত আজগুবি গালগল্প বলে বাচ্চাদের মাথা খাওয়া ! আমি বরং বোঝাচ্ছিলাম, ও সব নেস টেস আসলে গল্পকথা। কঞ্চিতা কিন্তু সমীরণ আর অঞ্জনের দলে। ও বলল, যা রটে, তার কিছু তো সত্যি বটে!
মাঝে মাত্র একটা দিন আর। মঙ্গলবার চলে যাবে সংযুক্তাদিরা। ফাঁকা হয়ে যাবে বাড়িটা। আবার আমাদের রোজের রুটিন শুরু হয়ে যাবে ঠিক আগের মতো। কঞ্চিতাও বলে রেখেছে, কিছুদিন ও না কি আসবে না। কী সব প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে। ব্যস্ত থাকবে তাই।
ছায়ামানবী
(৪)
সোমবার। এমন একটা সোমবার যে আমার জীবনে, আমাদের কারও জীবনেই কখনও আসতে পারে, ভাবিনি। আমি হাফ ডে ছুটি নিয়েছিলাম। সমীরণ আর অঞ্জন, দু-জনই বলেছিল ওদের ফিরতে রাত হবে। লাঞ্চের আগেই ফিরেছিলাম আমি। বাচ্চারা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঘরে। আমরা খেতে বসেছিলাম। সংযুক্তাদি একবার সুপারমার্কেট যেতে চাইল। আমারও টুকিটাকি কেনাকাটা ছিল। কঞ্চিতা বলল বাচ্চারা যখন ঘুমোচ্ছে, ওদের ডেকে কাজ নেই। ও ঠিক ঘুম থেকে উঠলে ওদের সামলে রাখবে। আমরা যেন সব কাজ মিটিয়ে ফিরি।
আমরা বেরোলাম দুটো আন্দাজ। বেশিক্ষণ লাগাইনি। পাঁচটার মধ্যেই ফিরেছিলাম। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে রাতের রান্না কী হবে, তাই ভাবছি আর সংযুক্তাদি ঘরে গেছে শপিং ব্যাগ নিয়ে। আচমকা শুনি চিৎকার। সংযুক্তাদি রান্নাঘরে দৌড়ে এসে আমাকে বলল,
–কাজু আর পেস্তা কোথায় ?
ছায়ামানবী
আমি বললাম,
— দ্যাখো গে যাও, কঞ্চিতার সঙ্গে ঘরেই আছে। তিনজনই ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত।
ছায়ামানবী
সংযুক্তাদি প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলল,
— না তো ! ঘরেও নেই, বাড়িতেও নেই। কঞ্চিতাও নেই!
— আরে, ঘাবড়াচ্ছ কেন ? ঘুম থেকে উঠে বায়না করেছিল হয়ত। তাই ব্যাকইয়ার্ডে খেলতে নিয়ে গেছে।
–কোথাও নেই, ব্যাকইয়ার্ডেও নেই।
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম এ কথা শুনে। গেল কোথায় মেয়েটা ? ওই ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ? সঙ্গে তো গাড়িও নেই যে দূরে কোথাও নিয়ে যাবে। হাতের কাজ ফেলে রেখে সংযুক্তাদিকে বললাম,
–তুমি যা নার্ভাস হয়ে গেছ, হয়ত ওদের দেখতেই পাওনি ! তোমার নাকের ডগাতেই ব্যাকইয়ার্ডে লুকোচুরি খেলছে দুষ্টু দুটো। চল, আমিও যাই। দু-জনে গেলে ঠিক খুঁজে পাব।
সংযুক্তাদিকে স্তোক দিচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মনের ভেতরে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল একটা। খবর দেব কি সমীরণ আর অঞ্জনকে ? না কি নিজেরাই খুঁজেপেতে দেখব?
আমরা বাড়ির ভেতরটা আগে খুঁজলাম তন্নতন্ন করে। কোথাও কেউ নেই। সামনের বাগানও ফাঁকা। ব্যাকইয়ার্ড একেবারে চুপচাপ। আমরা কীসের টানে কে জানে এগিয়ে গেলাম পেছনের বেড়ার দিকে। গেটটা আলতো করে ভেজিয়ে রাখা। তালাটা ঝুলছে আলগা হয়ে। কঞ্চিতা ওদের নিয়ে কি মাঠে গেল এই রোদ্দুর-ফুরিয়ে আসা বিকেলে ? একটা দুটো পাখি ডাকছে, অল্প অল্প ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, চারদিকে ঝুপসি সবুজ গাছেরা ডাক দিচ্ছে, “আয়, আয় …”। আমার কেমন ভয় করছিল, পা দুটো আঠার মতো লেগে আছে সবুজ ঘাসের আস্তরণের ওপরে। সংযুক্তাদি এক মাঠ সবুজ শূন্যতার মাঝে ফ্রেমে আঁটা ছবি যেন।
আমাদের নাগালের বেশ খানিকটা বাইরে, যেখানে মাঠ মিশেছে জঙ্গলে, সেখানে পেছন ফিরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে একটি মেয়ে। তার পরনে অদ্ভুত রংচঙে লম্বা স্কার্ট আর সাদা ফুলস্লীভ ব্লাউজ। মাথায় জিপসিদের মতো রঙিন রুমাল বাঁধা। শরীরের গড়ন জানান দিচ্ছে ও কঞ্চিতা। কিন্তু ওকে এই পোশাকে আগে দেখিনি আমি। ওর হাতে ওগুলো কী ? আমি যা দেখছি, সংযুক্তাদিও কি তাই দেখছে? আমি দেখতে পাচ্ছি, এই এতদূর থেকেও কেমন করে কে জানে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , ওর আঙুলের সঙ্গে দুটো সুতো বাঁধা। সুতোর মাথায় একজোড়া পুতুল। বড়জোর এক বিঘত মাপের। একটা ছেলে পুতুল আর একটা মেয়ে পুতুল। তাদের পরনে যে জামাকাপড়, সেগুলো আমাদের ভীষণ চেনা ! কিন্তু এ জামাকাপড়গুলো অবিকল এক হলে একেবারেই খুদে খুদে, ওই পুতুলের মাপেই। আঙুলের জোড়া সুতোর কারিকুরিতে পুতুল দুটো লাফাচ্ছে, নাচছে, শূন্যে উঠে গিয়ে গাছের ডালে বসে দুলছে। একমনে পুতুলনাচ দেখাচ্ছে কঞ্চিতা। ও নিজেই দেখাচ্ছে, নিজেই দেখছে। না কি ও জানে যে আমরাও দর্শক? আমার শরীর হিম, সংযুক্তাদির চোখমুখ মরা মাছের মতো ফ্যাকাশে, আমাদের গলা দিয়ে একটু শব্দ বেরোচ্ছে না। আমরা চিনতে পেরে গেছি ছ’ ইঞ্চি মাপের পুতুল দুটোকে। এই এতখানি দূর থেকেও।
চারদিকে একটু একটু করে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আমরা সম্মোহিতের মতো সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। শব্দ নেই কোনও, আবার শব্দ সামান্য আছে কি ? অনেক দূর থেকে মনে হচ্ছে কানে আসছে অস্পষ্ট একটা সুর…চেনা চেনা … চিনি তো ! ওই ঘুমপাড়ানি গানের।
কঞ্চিতা উঠে দাঁড়াল। ও কি জানে আমাদের উপস্থিতির কথা? না কি ওই টেনে নিয়ে এসেছে এখানে আমাদের? এতক্ষণে খেয়াল করলাম ওর পাশে একটা অদ্ভুত সুন্দর পুঁতির ব্যাগ রাখা। পুতুল দুটোকে মনে হল বুকে জড়িয়ে চুমু খেল। তারপর রেখে দিল ব্যাগে। একবারও পেছন ফিরে দেখল না। আবছা অন্ধকার সারা গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিয়ে সটান হেঁটে ঢুকে গেল ঘন জঙ্গলের মধ্যে। একেবারে একা একা, শুধু দুটো খুদে পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে।
(৫)
কাজু আর পেস্তাকে খুঁজে পাইনি আমরা। কঞ্চিতাও নিখোঁজ ছিল। থানা পুলিশ করেও কোনও সুরাহা হয়নি। আমরা যা দেখেছিলাম, বিশ্বাসই করেনি কেউ ! অসংলগ্ন প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। সংযুক্তাদি ভাঙাচোরা মানুষ এখন। বিয়েটাও ভেঙে গেছে, কারণ স্ত্রীর ‘গ্রস নেগ্লিজেন্স’ -ই না কি এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, এমনটাই বলেছিলেন অঞ্জনের জামাইবাবু। অঞ্জন আর এখন আমাদের সঙ্গে থাকে না। ও অন্য চাকরি নিয়ে আমস্টারডামে। আমরা ওই বাড়িটা কিনে নিয়েছি। রোজ নিয়ম করে সন্ধের মুখেমুখে আমি একবার করে মাঠের মাঝখানটিতে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়াই। কঞ্চিতার জন্য, কাজু আর পেস্তার জন্য। দেখতে পাই না। ফিরে আসতে আসতে রোজ নিজের মনেই ফিসফিস করে বলি, “অঞ্জনকে ক্ষমা করে দিও কঞ্চিতা !” আর চুপিচুপি একটা করে চুমো খাই…না, কাজু-পেস্তাকে নয়… কঞ্চিতার অজাত শিশুসন্তানটির কপালে।