ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের কর্মী অরিজিৎ গুহ কলেজ জীবন থেকে লেখালিখি শুরু করেছেন। একটি ছোট সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন তিনি। সেখান থেকেই বেরিয়েছে তাঁর একমাত্র বই। আজ অরিজিতের গল্প।
উত্তর কলকাতার এক এঁদো গলির মুখে কর্পোরেশনের ঝকঝকে স্ট্রিট লাইটের আলোতে গলিটা আলোয় ঝলমলে হয়ে রয়েছে। গলির একেবারে শেষ প্রান্তে গলিটা বাঁক নিয়েছে আরেক তস্য গলির মুখে। আলো সেই অব্দি পৌঁছায় না।তস্য গলিতে বাড়ি বলতে একটাই। পুরনো দিনের একতলা একটা বাড়ি। সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা নিজে থাকে না, একজন ভাড়াটেকে ভাড়া দিয়ে রেখেছে, কিন্তু সেই ভাড়াটে ভদ্রলোক যে কে তা কেউ জানে না।কোনো ভোটার এখানে থাকে না বলেই হয়ত কর্পোরেশনের দৃষ্টি সেই তস্য গলি অব্দি পৌঁছায়নি।
বিকেলের দিকে একবার ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনো ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে মাঝেমাঝে। গুমোট ভাবটা এখনো বাতাসে রয়েছে। রাস্তা কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে।
বড় রাস্তার মুখে একজন লোক এসে দাঁড়াল।লোকজন কেউ বিশেষ নেই। এদিক ওদিক চেয়ে রাস্তা পার হয়ে কর্পোরেশনের লাইট পোষ্টের নিচে এসে হাতের ছাতাটা সামলে একটা বিড়ি ধরাল। ছাতার জন্য লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা।
বিড়ি ধরিয়ে স্খলিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল গলির শেষ প্রান্তের দিকে। তারপর গলির প্রান্ত থেকে বাঁ দিকে ঘুরে ছোট গলিটার ভেতর ঢুকে একতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়াল। বিড়িটা হাত থেকে ফেলে পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বের করল।একটা একটা করে চাবি হাতের আন্দাজে টিপে টিপে দেখে ঠিক চাবিটা দিয়ে বাড়ির তালাটায় ঢুকিয়ে ঘোরাতেই খুট করে একটা শব্দ করে তালাটা খুলে গেল। বাড়িতে ঢুকে আন্দাজে লাইটের সুইচটা টিপতেই একটা টিমটিমে বালব জ্বলে উঠল। ঘরের ভেতরে দেখা গেল শুধু একটা টেবিল আর একটা চেয়ার রয়েছে। আর টেবিলের ওপর একতাড়া কাগজ পড়ে রয়েছে। চেয়ারটা টেনে লোকটা টেবিলে বসে কাগজের তাড়াগুলো থেকে একটা সাদা কাগজ নিয়ে বুকপকেট থেকে পেনটা বের করে লিখতে শুরু করল।
টেবিলের ওপর কাগজ আর ফাইলের সমুদ্র থেকে চোখ তুলে তাকাল রাজর্ষি সেন।তাঁর কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ভদ্রলোক।
‘স্যার, আসতে পারি?’
ভদ্রলোক আরেকবার কেবিনে ঢোকার অনুমতি চাওয়ায় রাজর্ষি বলল,
‘হুমম, আসুন। কী দরকার বলুন?’
মোটামুটি মাঝারি সাইজের ‘দূরদৃষ্টি’র অফিস ঘরটার একদম শেষে কাচ ঢাকা দূরদৃষ্টি’র সম্পাদকের কেবিন। সেই কেবিনের দরজা দিয়ে সম্পাদকের অনুমতি পেয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল অরিন্দম,
‘আমার নাম স্যার অরিন্দম। শান্তনু আপনাকে আমার ব্যাপারে বলেছিল।’
‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ।আপনি শান্তনুর বন্ধু। আসুন আসুন। বসুন। কী নেবেন? চা না কফি?’
‘না না, কিছু লাগবে না। শুধু এক গ্লাস জল। থ্যাঙ্কস।’
‘তারপর বলুন, আমার কাছে কী দরকারে?’ ইন্টারকমে হাউজ কিপিংকে একটা জল বলে রাজর্ষি অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘শান্তনু শুধু বলেছিল আপনি নাকি আমার সাথে দেখা করতে চান। কী দরকার কিছু বলেনি।’
‘আসলে স্যার…’
‘আহা, স্যারটা থাকুক না। রাজর্ষি বলেই ডাকুন নাহয়।’ জীবন যেরকম
‘আচ্ছা বেশ।আসলে রাজর্ষি, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। মানে আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, তবে আমার কাছে এখনো অব্দি খুব অবিশ্বাস্য ঠেকছে।’
কেবিনের দরজায় একটা খটখট করে শব্দ হল, তারপর হাউজ কিপিং এর একটা ছেলে ঢুকে ‘স্যার জল’ বলে একটা টি কোস্টারের ওপর জলের গ্লাসটা রেখে বেরিয়ে গেল। অরিন্দম ছেলেটার চলে যাওয়ার পর আবার বলতে শুরু করল।
‘আমি গত দশ বছর ধরে আপনাদের ম্যাগাজিনের গ্রাহক।সাহিত্যের আমি অবশ্য কিছু বুঝি না, কিন্তু আপনাদের পত্রিকার ফিচারগুলো পড়তে বেশ ভাল লাগে।এই কারণেই আপনাদের পত্রিকাটা কিনি।ইদানিং আবার গল্পগুলো পড়তেও বেশ লাগছে।বাজারে আপনার পত্রিকার বেশ নামডাক রয়েছে।’
ঢকঢক করে গ্লাসের জলটা শেষ করে গ্লাসটা কোস্টারের ওপর রেখে আবার বলতে শুরু করল অরিন্দম। জীবন যেরকম
‘রিসেন্ট আপনাদের যে ধারাবাহিকটা বেরোচ্ছে “জীবন যেরকম” সেটার প্রথম পর্বটা পড়েই চমকে উঠেছিলাম আমি’।
‘ও, কালপুরুষের লেখাটা?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ কালপুরুষ। ঠিক তাই। ছদ্মনামেই লিখছেন মনে হয়, তাই না? কারণ কালপুরুষ কারও নাম তো শুনিনি কখনো।’
‘ছদ্মনামই বটে।ওনাকে অনেকবার ওঁর আসল নাম জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কিন্তু কখনই বলেননি। অদ্ভুত লোক। আজ অব্দি কোনোদিন সামনাসামনি দেখলামই না। লেখেন মোটামুটি, কয়েকটা গল্পও বেরিয়েছিল আমাদের পত্রিকায়, কিন্তু অনেকদিন ধরেই ওনার ইচ্ছে ছিল একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার। আমাদের বলেছিলেন দুর্দান্ত একটা উপন্যাসের নাকি প্লট আছে ওনার কাছে। তা আমরাও ওনার কথায় আশ্বস্ত হয়ে ধারাবাহিক লেখার সুযোগ দিই।বলেছিলেন যে নিরাশ করবেন না।এখনো অব্দি তো মোটামুটি চলছে দেখছি।’
‘আমার সমস্যাটা ঠিক ওনাকে নিয়েই।’ জীবন যেরকম
অবাক হয়ে অরিন্দমের দিকে তাকাল রাজর্ষি। ‘ওনাকে নিয়ে সমস্যা? কি সমস্যা? কি করেছেন উনি?’
‘উনি কিছু করেন নি বলেই তো সমস্যা। অথচ যদি কিছু করতেন তাহলে সমস্যা হতনা।’
‘কিসব হেয়ালি মার্কা কথা বলছেন বলুন তো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।আর তাতে আমিই বা কীভাবে সাহায্য করব?’ স্পষ্টতই রাজর্ষির গলায় কিছুটা উষ্মা। জীবন যেরকম
‘আহা রেগে যাবেন না।আমি তাহলে ব্যাপারটা খুলেই বলি। শুনুন তাহলে। আপনাকে তো আগেই বলেছি সাহিত্য ফাহিত্য আমি ঠিক বুঝি না।আপনাদের পত্রিকাটা নিই ফিচারগুলোর জন্য। এবার কালপুরুষের ধারাবাহিক উপন্যাসের বিজ্ঞাপন আপনাদের পত্রিকায় দেখেই আমি উৎসাহিত হয়ে পড়ি বিশেষ করে কালপুরুষ নামটার জন্য। একটা অদ্ভুত নাম। আমার কাছে খুব রহস্যময় লেগেছিল নামটা। এরপর প্রথম পর্বটা পড়েই চমকে উঠেছিলাম।
আমার ছোটবেলার অনেক কিছু সেই পর্বটার মধ্যে পেয়েছিলাম।মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছে। শুধু চরিত্রের নামগুলোই আলাদা, আর সব এক। প্রথমে ভেবেছিলাম, তা হতেই পারে, অনেকের লেখার সাথেই শুনেছি অনেকে নিজেদের রিলেট করতে পারে।এটাও সেরকম ব্যাপার ভেবেই আমি অতটা আর ভাবিনি কিছু। কিন্তু গল্প যত এগোতে লাগল, ততই যেন আমার নিজের জীবনের দিকগুলো ফুটে উঠতে লাগল। এত খুঁটিনাটি আমার নিজেরও মনে ছিলনা, কিন্তু কালপুরুষ যেন সেগুলোকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছে।
জীবন যেরকম
একদিকে অবশ্য আমার বেশ মজাই লাগছে, কিন্তু আরেকদিকে আমার ভয় হতে শুরু করেছে। আমার জীবনের এত খুঁটিনাটি ইনি জানলেন কি করে! আমাকে আড়াল থেকে কি লক্ষ্য করছে কেউ যে আমার ছোটবেলাটাও জানে! আমি আমার অফিস কলিগ বন্ধু শান্তনুকে ব্যাপারটা জানাই। শুনে ও-ও খুব আশ্চর্য হয়ে যায়।ওই আপনার ব্যাপারে আমাকে জানায়। ও বলেছিল কাগজের সম্পাদক ওর পরিচিত। সম্পাদকের সাথে দেখা করে আমার ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে।’
বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর অরিন্দম চুপ করল। রাজর্ষি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তার মানে সায়ন্তন বলে যে সেন্ট্রাল ক্যারেকটারটা আছে সেটা আপনার জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে? অদ্ভুত তো!’
‘হ্যাঁ, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। যে শুনবে সেই বলবে এই কথা।’
‘তা আমি কী করতে পারি এক্ষেত্রে বলুন তো! জীবন যেরকম’
‘আপনি আমাকে কালপুরুষের ঠিকানাটা দিন। আমি তার সাথে দেখা করতে চাই।’
‘দেখুন, লেখকের ঠিকানা কোনো পাঠককে লেখকের বিনা অনুমতিতে দেওয়া নিষেধ।আমরা কখনই তা করি না। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার নিজেরও একটা আগ্রহ জন্মেছে কী হচ্ছে সেই ব্যাপারে। ঠিকানা আপনাকে দিচ্ছি, কিন্তু যদি ওনার সাথে দেখা হয়, দয়া করে আমার কাছ থেকে যে ঠিকানা পেয়েছেন সেটা জানাবেন না।
যদিও ওনার সাথে আমার নিজেরও আলাপ নেই, লেখার সূত্রেই যা পরিচয়। আমাদের পত্রিকায় বেশ কয়েকটা ছোট গল্প পাঠানোর পর পাঠকের আগ্রহে আমরা ওনাকে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার অনুরোধ জানাই। তাতে উনি রাজি হয়ে যান। আমাদের পত্রিকার বাকি লেখক যারা তাদের সাথে আমরা মেইল মারফত যোগাযোগ করি, কিন্তু ওনার সমস্ত লেখাই আসে ডাক মারফত বাই পোষ্টে এবং আমরাও ওনার সাথে পোষ্ট মারফতই চিঠি পাঠিয়ে কথাবার্তা চালাই। ওনার কোনো ফোন নাম্বার পর্যন্ত আমদের কাছে নেই।’
একটা প্যাড বের করে খসখস করে ঠিকানাটা লিখে অরিন্দমের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে আবার বলে উঠল রাজর্ষি, ‘প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম হয়ত পুরনো দিনের মানুষ, মোবাইল ফোন বা ল্যান্ড ফোন কিছুই ব্যবহার করেন না। মেল তো দূরের কথা।কিন্তু এখন দেখছি বেশ ইন্টারেস্টিং চরিত্র এই কালপুরুষ ভদ্রলোক। ঠিক আছে, আপনি গিয়ে দেখা করুন, তারপর আমাকে অবশ্যই জানাবেন কী কথা হল।’
‘দূরদৃষ্টি’র অফিস থেকে বেরোতেই শান্তনুর ফোন এলো অরিন্দমের মোবাইলে। কানে ধরে হ্যালো বলতেই শান্তনুর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘কি রে অ্যাড্রেস পেলি লোকটার’?
‘হ্যাঁ রে পেয়েছি।এখনই যেতাম হয়ত, কিন্তু অফিসে কয়েকটা কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে। ওগুলো আজকের মধ্যে কমপ্লিট না করতে পারলে মুশকিল হয়ে যাবে।’
‘ঠিক আছে, এক কাজ কর, তুই অফিসেই চলে আয়। ছুটির পর আমরা একসাথেই নাহয় যাব।অ্যাড্রেসটা কোথাকার?’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে মানিকতলার দিকে। কিন্তু রাস্তাটা ঠিক চিনতে পারছি না।কোনো গলি ফলি হবে মনে হয়।’
‘চিনতে পারছিস না ও ঠিক চিনে নেওয়া যাবে। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিতে পারবে।তুই তাড়াতাড়ি অফিসে ঢোক।’
ফোনটা রেখে একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখিয়ে থামাতে চাইল অরিন্দম। ট্যাক্সিটা কোনো গা না করে অরিন্দমকে উপেক্ষা করে চলে গেল। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ট্যাক্সিওয়ালার উদ্দেশে একটা গালাগালি ছুড়ে ফোন বের করে উবের খুলল। ডেস্টিনেশন সেটা করতে দেখাল তিন মিনিটে আসছে। নিশ্চিন্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরাল।দুপুরের প্যাচপ্যাচে গরমে আর বাসে উঠতে ইচ্ছে করছিল না আসলে। কিন্তু এখন কলকাতায় মিটার ট্যাক্সি পাওয়া মানে লটারি পাওয়া।আর সুযোগ বুঝে ওলা উবের ওয়ালারাও ঝোপ বুঝে কোপ মারছে সার্জ প্রাইস করে।
অফিসে ফিরে কাজে ডুবে গেল অরিন্দম। কখন যে বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল বুঝতেও পারল না। হুঁশ ফিরল ওর কিউবিকলে শান্তনুর নক করার পর। ‘কি রে, যাবি না ওখানে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো, হয়ে গেছে। চল বেরোই।’জীবন যেরকম
বড় রাস্তার মুখে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে একজনকে রাজর্ষির ঠিকানা লেখা চিরকুটটা এগিয়ে দিতে সেই ভদ্রলোক মাথা নেড়ে চলে গেলেন। জানে না ঠিকানাটা কোথাকার।প্রায় তিন চারজনকে জিজ্ঞাসা করার পর একজন ঠিকঠাক ভাবে বলতে পারল কোনদিকে যেতে হবে। জীবন যেরকম
ল্যাম্পপোস্টটার কাছে এসে এরপর আর খুঁজে পেল না রাস্তা। অথচ এদিকে লোকজনও সেরকম নেই যে জিজ্ঞাসা করা যায়। অথচ ঠিকানার বাই লেনটা তো মিলছে না। এদিকেই আরেকটা রাস্তা থাকা উচিত ঠিকানা অনুযায়ী। শেষে শান্তনুই বলে উঠল, ‘চল তো এগিয়ে দেখি শেষে আর কোনো গলি আছে কিনা।’
গলিটার একদম শেষ মাথায় এসে দুজনে দেখল বাঁ দিকে আরেকটা ছোট গলি বেরিয়ে গেছে। সেটা দিয়ে ঢুকতে একটা পুরনো দিনের একতলা বাড়ি চোখে পড়ল।বাড়িটায় তালা লাগানো আর চারিদিক পুরো ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে রয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলো ওরা দুজন।
বড় রাস্তার মুখে একটা চায়ের দোকানে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে চা ওয়ালার সাথে গল্প শুরু করল শান্তনু। কথায় কথায় জানা গেল ওই বাড়িতে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে কেউ দেখেনি। অবশ্য জায়গাটা অন্ধকার অন্ধকার বলে লোকজন যায়ই না ওদিকটায়। তবে কেউ কেউ দেখেছে মাঝেমাঝে নাকি আলো জ্বলে, আবার কিছুক্ষণ পর নিভেও যায়। কে যে কখন ঢোকে, কে কখন বেরোয়, সেসব কিছুই কেউ জানেনা।
দূরদৃষ্টির নতুন সংখ্যার পর্বটা পড়তে পড়তে মুখ চোখ শক্ত হয়ে উঠছিল অরিন্দমের। ঘেন্নায় একবার নাক কুঁচকে হাতের থেকে বইটা সরিয়ে ফেলল। ছুঁড়ে ফেলা দেওয়ার মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। হাতটা নামিয়ে আবার পড়তে শুরু করল।স্ত্রী তিয়াষ অনেকক্ষণ আগে চা দিয়ে গেছে। চা-টা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে রয়েছে টেবিলের ওপর। কোনো মনোযোগই নেই অরিন্দমের চায়ের দিকে।
স্ত্রী তিয়াষ রান্নাঘর থেকে একবার ডাইনিং রুমে এলো। ‘কি গো, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে জল হয়ে গেল।খাচ্ছ না কেন? ও আচ্ছা বুঝেছি।কালপুরুষ আবার মনে হয় কোনো চমক দিয়েছেন! কি লিখেছে? এবার তোমার জীবনের কোন অংশ নিয়ে লিখল?’
হাত থেকে বইটা তিয়াষের দিকে ছুঁড়ে দিল অরিন্দম।তিয়াষ ‘জীবন যেরকম’ উপন্যাসের পর্বটা পড়তে শুরু করল।একজায়গায় এসে থমকে গেল।আরেকবার পড়ল ওই জায়গাটা। তিয়াষেরও চোখ মুখ লাল হয়ে গেল রাগে।
‘কিসব লিখেছে ছাইপাঁশ। গল্প বিক্রি করার জন্য যা খুশি লিখলেই হয়ে যায় নাকি!’
‘শান্তনুর সাথে কতদিন ধরে তোমার সম্পর্ক তিয়াষ?’ হিমশীতল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল অরিন্দম।
‘অরিন্দম, বাড়াবাড়ির লিমিট আছে।কিসব বলছ তুমি জানো?’
‘আমি ঠিকই বলছি।আজ অব্দি একটাও জিনিস কালপুরুষ ভুল লেখেন নি।এমনকি যেটা কারো জানার কথা নয়, কলেজ লাইফে আমি লিটিল ম্যাগাজিনে লিখতাম, সেটা পর্যন্ত উনি তুলে ধরেছেন।একমাত্র আমি ছাড়া আমার জীবনে এখন আর যারা যারা আছে তাদের কারো পক্ষে এই কথা জানা সম্ভব নয়।আমার অজান্তে তুমি শান্তনুর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছ তিয়াষ!’
‘তুমি তুমি একটা রাস্কেল…’ রাগে মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না তিয়াষের।’তুমি একটা কো-ইন্সিডেন্সকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করছ?’
‘কোনো কো-ইন্সিডেন্স নয় তিয়াষ।আই অ্যাম ড্যাম শিওর।যতই আমাকে গালাগালি দিয়ে লোকাতে চাও, ইউ হ্যাভ বিন এক্সপোজড, ইউ হ্যাভ বিন এক্সপোজড ব্লাডি স্লাট।’
‘অরিন্দম!!!’ ঠাস করে একটা গালে চড় মারল তিয়াষ।
হাতের পেনটা ছুঁড়ে ফেলে পকেট থেকে আরেকটা পেন বের করল লোকটা।কালি ফুরিয়ে গেছে। বালবের মিটমিটে আলোতে আবার লিখতে শুরু করল।
‘অফিস কলিগ বন্ধুর সাথে স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক আবিষ্কার করার পর দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হল। স্ত্রী জোরে একটা চড় মারতেই সায়ন্তন প্যারানয়েড স্কিজোফ্রনিক রোগির মত ক্ষেপে উঠল। দু হাত দিয়ে জোরে স্ত্রীর গলাটা চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পর স্ত্রীর এলিয়ে পড়ে যাওয়া দেহটা মাটিতে ফেলে একবার হাতটা স্ত্রীর নাকের কাছে নিয়ে এসে নিঃশ্বাস অনুভব করার চেষ্টা করল। মারা গেছে নিশ্চিত হতেই মুখে একটা পাশবিক হাসি ফুটে উঠল ওর।’
ঠিক সেই সময়ে পকেটের ফোনটা আবার বেজে উঠল। সাইলেন্ট করে কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। শান্তনুর ফোন। এই নিয়ে আঠারোটা মিসড কল। ফোনটা আর ধরবে না একসময়ের ব্যর্থ সাহিত্যিক অরিন্দম।এরপর ঘটনাক্রম যে ভাবে এগোবে, সেভাবেই লিখবে ও। উপন্যাসে নাটকীয় মোড় আনতে না পারলে উপন্যাস জমেনা। এরপরই শুরু হবে নাটকীয়তার পালা। সবাই এরপর অরিন্দমকে খুঁজতে শুরু করবে স্ত্রীকে হত্যা করার জন্য।