আড়াই বছরের কাছাকাছি হতে চললো ফাস্ট ফুড শপ Delicacies’ এর। Southern Avenue তে একটা গলির ভেতরে কিছুটা এগোলেই এই শপটা অবস্থিত। ভালো একটা এলাকায় দোকান, রোজগার মন্দ হয় না। ভেজ এবং নন ভেজ, দুই রকম খাবার পাওয়া যায় এখানে, এবং যথেষ্ঠ সুস্বাদু মান এর খাবার। খুব যে বড়ো মাপের শপ, তা নয়। তাও ভেতরে কুড়ি বাইশ জনদের বসার জন্য টেবিল চেয়ার সাজানো রয়েছে। তাছাড়া রান্না করার জন্য আলাদা একটা ঘর আছে, পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা করে শৌচাগার। খুব পরিষ্কার আর পরিছন্ন শপ। দোকানের মালিক, ক্যাশিয়র এবং সুপারভাইজার, মানে পৌলুমিদি প্রবেশ গেটের পাশেই একটা ডেস্ক এর পেছনে বসে থাকে। গল্পের প্রধান চরিত্র অভিনব সেনগুপ্ত, প্রতি সপ্তাহে শুধু শনিবার ও রবিবার গুলো, রান্না করার অধিকাংশ কাজ করে দেয়। আরো একজন কর্মচারী আছে রান্না করার জন্য।
সাথে রয়েছে কাস্টমারদের খাবার পরিবেশন করে দেওয়ার জন্য দুজন লোক। অভিনব সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন আবার চাকরি ও করে। রান্না করে লোকেদের সুস্বাদু খাবার খাওয়ানো অভিনব এর খুব পছন্দের কাজ। এই কারনে সে কুকিং ক্লাসেসও নিয়েছে। দারুন খাবার রান্নার গুন আছে অভিনব এর। অনেক দিনের পুরনো ইচ্ছা ওর, একটা ফাস্ট ফুড শপ খুলে লোকেদের রান্না করে খাওয়ানোর। অভিনব’ এর বত্রিশ বছর বয়শ হলো এই বছরের জুলাই মাসে। লম্বায় ছয় ফুটের থেকে সামান্য কম, দেখতে ভালো, খেটে খাওয়া মানুষ, এখনও অবিবাহিত। বাড়ি যাদবপুরে, একলাই থাকে। বাবা এবং মা দুজনেই গত হয়েছেন বেশ অনেক বছর হলো। পাড়াতে বন্ধুবান্ধব দের নিয়ে জীবন, সাথে রান্না করার শখ। লোকেরা ওকে একজন সাধারন, একটু লাজুক প্রকৃতির লোক আর সাধারন জীবনযাপন করা মানুষ বলেই চেনে।
এক বছরের ওপর হয়ে গেলো, অভিনব এখনও সেই মেয়েটাকে দেখতে থাকে, যে শপের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটেই থাকে। মাসে এক দুবার করে ওদের দোকানে আসে, রবিবারে সাধানরত, নিজের বন্ধুদের সাথে খাওয়াদাওয়া করতে, আড্ডা মারতে। তাদের আড্ডার কথাবার্তা শুনে অভিনব বুঝতে পেরেছিল যে মেয়েটির নাম তনুশ্রী, কোনো এক কোম্পানি তে চাকরি করে, আর তার ও এখনও বিয়ে হয়নি। অভিনব প্রতিবার ওদের জন্য খুব মন দিয়ে, খুশি মনে খাবার বানিয়ে দেয়। তনুশ্রী কে সুন্দর দেখতে, বয়স তিরিশের কাছাকাছি, চেহারা সামান্য একটু ভারী হলেও মোটা বলা যায় না। অভিনব এর খুব ইচ্ছা করে তনুশ্রীর সাথে কথা বলতে, বন্ধুত্ব করতে, আর সব ঠিক থাকলে হয়তো বিয়ের প্রস্তাব ও দিতে। বাবা মা গত হওয়ার পর অভিনব জীবনে আট বছরের বেশি একলা কাটিয়েছে। কখনো কোনো প্রেমিকা ও ছিল না। বন্ধুবান্ধব থাকলেও, তাদের ও তো বিয়ে হয়ে গেছে, তাদের ও নিজস্ব সংসার আছে। আর কতদিন এই ভাবে একলা থাকা যায়? পাড়ার বন্ধুরা, অফিসের সহকর্মীরা, সবাই বলে ওকে , ‘ ভাই, এবার একজন সঙ্গিনী নিয়ে আয়। একলা আর কদিন থাকবি?’
সঙ্গিনী হিসেবে এই মুহূর্তে তনুশ্রী কে পছন্দ হয়েছে অভিনব এর। কিন্তু সেই কথা কখনো বলার সাহস পাইনি ওকে। দশজনের সাথে ঝামেলা হলেও ভয় পাবে না ছেলে, কিন্তু মনের কথা মেয়েটিকে বলার সাহস পাচ্ছে না। পৌলুমিদি ওর ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল একদিন। ঠিক কথা বার করে নেয় অভিনব এর থেকে। হালকা করে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘ এই বয়সে এসে এখনও ঘাবরে যাস মনের কথা বলতে? গরু কোথাকার। তুই নিজে বলবি নাকি আমি যাবো ওকে তোর কথা বলতে?’ শুনে অভিনব আরো ঘাবরে গেলো, ‘ না না দিদি, কি বলছো! আমি বলবো একদিন।’ পৌলুমিদি জিজ্ঞেস করলো , ‘ সেই শুভ আর বিশ্ব জয় করার দিন কবে সেটাও শুনি?’ অভিনব জবাব দিলো, ‘ পরের রবিবার যদি ও আসে আমি চেষ্টা করবো।’ কথাটা শুনে পৌলুমিদি বলেছিল, ‘ চেষ্টা না, তুই বলবি। মেয়ের জবাব যদি না হয়, তাহলে তাই হবে। অত ভয় পেলে চলবে না।’
আজ সেই রবিবার। অভিনব এর নিজের মনের কথা বলার দিন। তনুশ্রী শপে নিজের বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতেও এসেছে।
সন্ধ্যে সাড়ে আটটা, তনুশ্রী এবং বন্ধুরা উঠে পরলো বাড়ি যাওয়ার জন্য। খাবারের বিল চুকিয়ে দোকানের গেট খুলে যখন ওরা বেরোচ্ছে, পৌলুমিদি চোখের ইশারা তে অভিনব কে বোঝালো এখুনি গিয়ে ওকে বলতে। ইতস্তত বোধ করলেও, অভিনব এগোলো দোকানের বাইরে। রাস্তা এখনও পার করেনি তনুশ্রী বাড়ি যাওয়ার জন্য। সুযোগ টা নিয়ে অভিনব ডাকলো, ‘ এক্স স্কিউজ মি মিস্ তনুশ্রী।’ তনুশ্রী সহ সব বন্ধুরাও পেছনে তাকালো। ‘ হ্যাঁ, বলুন,’ তনুশ্রী বললো। অভিনব এর হার্ট বিট যেনো তড়াক করে বেড়ে গেলো। ‘ আসলে – ইয়ে – সরি টু ডিস্টার্ব, আপনারা সাথে দুটো মিনিট কথা বলতে পারি প্লিজ, প্রাইভেট?’ কথাটা শেষ হতেই অভিনব এর হার্ট বিট এর গতি একটু নরমাল হলো। কিন্তু যেই দেখলো তনুশ্রী নিজের ভুরু হালকা কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, গতি আবার বেড়ে গেলো। বন্ধুদের এগিয়ে যেতে বললো তনুশ্রী, তারপর অভিনব কে বললো, ‘ বলুন কি বলবেন দুটো মিনিটে ?’ অভিনব ছোট করে একটা ঢোক গিলে বললো, ‘ ইয়ে – আমার নাম অভিনব সেনগুপ্ত। এই শপেই হয় তো আপনি আমাকে কুকিং করতে দেখেছেন।’ তনুশ্রী বললো, ‘ হ্যাঁ দেখেছি, তাতে কি?’ অভিনব ততলে জবাব দিলো, ‘ না- না, টা – তাতে কিছু না।
আসলে আমার ইচ্ছা আছে, আপনার সাথে বন্ধুত্ব করার, আলাপ বাড়ানোর, অবশ্যই যদি আপনার অনুমতি থাকে তবেই।’ কথা শেষ হতেই তনুশ্রী জিজ্ঞেস করলো, ‘ তার সাথে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব ও দেবেন?’ প্রশ্নটা শুনে অভিনব বেশ চমকে গেলো। নিজেকে সামলে বললো ,’ সেটা তো পরের কথা। আগে নিজেদের চিনতে জানতে পারলে –‘ কথা শেষ হওয়ার আগেই তনুশ্রী বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ আপনার কি মাথা খারাপ? আপনি কাজ করেন এখানে জাস্ট এস এ কুক, আর আমি একটা কোম্পানিতে ম্যানেজার পোস্টে কাজ করি। আমি করবো আপনার সাথে বন্ধুত্ব, আর তারপর আবার বিয়ের প্রস্তাব ও দিতে পারেন? কেনো, আমাকে দেখে কি পাগল মনে হচ্ছে? প্লিজ আমাকে আর কখনো ডিস্টার্ব করবেন না, নইলে পাড়ার লোকদের ডাকতে বাধ্য হবো।’ এতো কথা শুনিয়ে রাস্তা পার করে এগিয়ে গেলো তনুশ্রী। ভেতর থেকে পৌলুমি দি সব শুনতে পেয়েছিল। বাইরে এসে তনুশ্রী কে ডাকতেই যাচ্ছিল, অভিনব ওকে আটকে দিল, ‘ না দিদি, ডেকো না। ও আমাকে উত্তর হিসেবে না বলতেই পারে। সেখানে আমরা কেউ কিছু বলতে পারি না।’ পৌলুমিদি রেগে বললো, ‘ জবাবে কেউ না বলতেই পারে, সেটা খুব স্বাভাবিক। তাই বলে এরকম অপমানজনক কথাবার্তা শোনানোর কোনো অধিকার ওর নেই। তুই নিজের আসল পরিচয় দিলি না কেনো? তখন দেখতাম অত বড়ো বড়ো কথা কি করে বলতো।’ অভিনব মাথা নিচু করে বললো, ‘ ছাড়ো না দিদি, কথা বাড়ালে আরো কথা বাড়বে। যা হয় কোনো কারনেই হয়।’ এই বলে মাথা নিচু করেই অভিনব দোকানের ভেতরে চলে গেলো।
চার মাস কেটে গেছে এই ঘটনার পর। অভিনব আর কখনো তনুশ্রীর দিকে তাকাইনি বা ডিস্টার্ব ও করেনি। তনুশ্রী নিজের বন্ধুদের সাথে মাঝেমাঝে রবিবারগুলো আসে, অভিনব এর হাতের রান্না খেয়ে দোকান থেকে চলে যায়। আজ, আরেক রবিবার সন্ধেবেলায়, তনুশ্রী যখন নিজেদের খাবার বিলের টাকা পৌলুমিদি কে দিচ্ছিল, সে দেখতে পেলো অভিনব দোকানের বাইরে একজন মেয়ের সাথে হাত মেলাচ্ছে, যেটাকে আমরা হ্যান্ডশেক বলে থাকি। মেয়ে টা কে তনুশ্রী এই দোকানের ভেতরে কয়েকবার দেখেছে, সেও খেতে আসে এখানে। তনুশ্রীর সন্দেহ হলো, এই লোকটা আবার নিশ্চই একজন লেডি কাস্টমারকে প্রোপোজ করছে, যেমন ওকে করেছিল চার মাস আগে। কিন্তু এখন তো দেখছি দুজনে হ্যান্ডশেক করছে। তার মানে মেয়ে টা রাজি হয়ে গেলো এক কুকের সাথে বন্ধুত্ব করতে? থাকতে না পেরে সোজা পৌলুমি দি কে বললো, ‘ আপনি এই শপের কিনা মালকিন ? আপনার চোখের সামনে আপনার দোকানের এক এম্প্লয়ী মাঝে মধ্যেই মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করে, তাও আপনার লেডি কাস্টমারদের সাথে। কয়েক মাস আগে আমার সাথেও বন্ধুত্ব করতে এসেছিল।
এসব কি দেখেও আপনি না দেখার ভান করেন? আপনি ওই লোকটা কে কিছু বলেন না নাকি? ওকে চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছেন না কেনো?’ সব শুনে পৌলুমি দি শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আপনি ওই অভিনব এর কথা বলছেন?’ তনুশ্রী উত্তর দিল, ‘ ইয়েস।’ পৌলুমি দি বললো , ‘ বোঝাই যাচ্ছে আপনি ওকে এখনও চিনতে পারেননি। তবে ওকে আমি চাকরি থেকে কি করে বের করি বলুন তো? অভিনব তো এখানে চাকরি করে না।’ কথাটা শুনে একটু অবাক হলো তনুশ্রী, ‘ বুঝলাম না। তার মানে?’ পৌলুমি দি জবাব দিলো, ‘ অভিনব সেনগুপ্ত এই শপের আসল মালিক। এই শপের পেছনে সবচেয়ে বেশি টাকার বিনিয়োগ আর পরিশ্রম এই অভিনব এর। রান্না করতে খুব ভালবাসে, শুধু শনিবার আর রবিবার কুকিং করে। আর করেও দারুন। আপনি নিজেই তো খেয়েছেন। বাকি দিনগুলো সেক্টর ফাইভ এ একটা IT কোম্পানিতে চাকরি করে এস সিনিওর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। অভিনব ইস এ MBA কাম MCA এডিউকেটদ প্রফেশনাল।’ তনুশ্রীর এখন পুরো অবাক, জিজ্ঞেস করলো, ‘ কিন্তু সবাই তো জানে আপনি এই শপ চালান?’ পৌলুমি দি বললো, ‘ আমি অভিনব এর বিজনেস পার্টনার।
আমার ও কিছু টাকার বিনিয়োগ আছে, তবে সেটা ওর থেকে অনেকটাই কম। আরেকটা নতুন ব্র্যাঞ্চ ও খুলতে চলেছে এই শপের, সেক্টর ফাইভ এ,’ একটু থেমে আবার বললো, ‘ মিস্ তনুশ্রী, সেদিন ওই ভাবে আপনি ওকে অতগুলো কথা শোনালেন কেনো জানি না। হয়তো আপনার অহংকার। মানুষের ওপরের খোলস টাই দেখেন আপনি, ভেতরের লোকটা কে দেখবেন না একবার? আমি থাকি অভিনব এর বাড়ির পাশেই। ওকে ওর ছোটবেলা থেকে দেখছি। খুব সাধারন আর ভালো ছেলে। নিজের দিদির মতো ভালবাসে আমাকে। বাবা মা দের হারিয়েছে, একলা থেকেছে এতগুলো বছর।
নিজের ক্ষমতায় খেটে এতো দূর অবধি এসেছে। তাছাড়া এখন অভিনব নিজে মেয়েটার কাছে যাইনি। মেয়েটা নিজে এসে আমাকে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তারপর আলাপ করতে অভিনব কে শপের বাইরে ডাকে। মেয়েটা র নাম জস্প্রীত। অভিনব কে এই শপেই দেখে পছন্দ হয় ওর। জস্প্রীত হয় তো এখনও অভিনব এর ব্যাপারে এতো সব জানে না, যা আপনি এখন আমার থেকে জানলেন। তবুও ও তো এত বিচার করলো না যেমন আপনি করেছিলেন। এরপর যদি দুজনেই নিজেদের পাকা পছন্দ করে, তাহলে হয় তো বিয়ে করতে পারে।’ এর মধ্যে অভিনব ভেতরে ক্যাশ টেবিল এর পাশে এসে দাড়িয়েছে। তনুশ্রী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অভিনব সেদিকে মন না দিয়ে বললো, ‘ দিদি, আমি জস্প্রীত এর জন্য একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিয়ে আসছি।’ এই বলে অভিনব দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো। তনুশ্রী তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অভিনব এর দিকে।