গভীর রাত। উত্তর মিস্ত্রি পাড়ায় সুনসান নীরবতা। শুধু পুরনো আমলের পাঁচিল ঘেরা বাড়িটা থেকে ভেসে আসছে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। কান পাতলে শোনা যায়, অকথ্য ভাষায় কে যেন সমানে গালিগালাজ করে চলেছে।
“রক্ত খাবো, রক্ত!”
“কুত্তার বাচ্চা, বান্ধন খোল। নাইলে সব কয়টারে পুইতা ফেলবো। হাহাহা!”
“বেইশ্যা মাগী, তুই আবার আমার জন্য খাবার নিয়া আসছিস? তোর হাতের রান্না করা খাবারে আমি পেশাব করি। আয়! আয়! হাতের নাগালে আয়! ভয় পাইছ না, আয়!”
“খা*কির পোলা রুস্তম খাঁ’য় গেলো কই? নিজের মাইয়ার সামনে আসে না কেন? লইজ্জা করে? ভাড়াইট্যা মাগীগো সামনে লুঙ্গির গিঁট খুলার সময় হারামীর লইজ্জা করে না?”
অন্তুর ওভারের শেষ বলে রাজীব ছক্কা পেটালো। বলটা উড়ে গিয়ে কোথায় পড়লো, ওরা নিজেরাও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলো না। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
যে বল দিয়ে খেলা হচ্ছিলো, সেটা অন্তুর। অনেক কষ্টে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা। ওরা টেনিস বলের গায়ে টেপ জড়িয়ে ক্রিকেট খেলে।
অন্তু বল খোঁজার আশায় দৌড়ে রাস্তায় এলো। বলটা ঠিক কোনদিকে গিয়ে পড়েছে, বুঝতে পারছে না। লম্বামত একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখলে হয়।
“আংকেল! আংকেল! আপনি কি..”
কোনো বল উড়ে যেতে দেখেছি কিনা?
“হ্যাঁ! কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করার আগেই আপনি কিভাবে বুঝে ফেললেন?”
বলটা উড়ে খাঁ বাড়ির পাঁচিলের ভেতর গিয়ে পড়েছে। তোমার এটা নিশ্চয়ই জানা আছে, ও বাড়িতে একবার কিছু ঢুকলে আর বের হয় না। তাছাড়া তোমাদের কারও বোধহয় সাহস হবে না বলটা চাইতে যাবার।
সেটা অন্তু খুব ভালো করেই জানে। অন্তুদের এলাকার সবচাইতে প্রভাবশালী পরিবার ওদের। খাঁ পরিবারের মানুষেরা একই সঙ্গে খুব নির্মম আর নির্দয়। টেনিস বল তো দূরের কথা, রিমোট কন্ট্রোল চালিত দামী খেলনা হেলিকপ্টারও ওদের পাঁচিল টপকে যাওয়ায় আর ফেরৎ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ওই বাড়িটাকে এড়িয়ে যাবার আরও একটা কারণ রয়েছে। এখন এই সন্ধ্যাবেলা অন্তু সেই কারণটা একদম মনে করতে চাইছে না।
বলটা চিরতরে হারিয়ে ফেলার শোকে অন্তুর চোখে পানি চলে আসে।
“কি, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে অনেক কষ্টের টাকায় কেনা বলটা হারিয়ে খুব খারাপ লাগছে, তাই না?”
আপনি কি করে জানলেন, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা? অন্তু যারপরনাই বিস্মিত হয়।
“তুমি এখন বাসায় চলে যাও। চেষ্টা করে দেখি, তোমার জন্য কিছু করা যায় কিনা!”
অন্তুর চোখে মুখে কিছুটা খুশির আভা দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।
“আপনাকে এত্তগুলা থ্যাংকস, আংকেল। কিন্তু আপনি কি সত্যিই পারবেন বলটা এনে দিতে?” গলায় সন্দেহের সুর অন্তুর।
লোকটা মুচকি হেসে অন্তুর চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়।
“অন্তু, বাসায় যাও। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তাছাড়া সময়টা ভালো নয়।”
লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে অন্তু চমকে ওঠে।
“আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?”
লোকটা অন্তুর কথার কোনো জবাব না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। অন্তু ওদের গলির মাথায় গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে, লোকটা খাঁ বাড়ির গেট ঠেলে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকছে।
খাঁ বাড়ির দোতলার একেবারে শেষের ঘরটার তালা খুলে ভেতরে ঢুকলো সেলিমের মা।
“আম্মা, আপনের জন্য নাস্তা নিয়া আইছি।”
ওই ছিনালের ঘরের ছিনাল। তর এইগুলান গু-মুত তুই খা।
“ছিঃ গো আম্মা! এইগুলান আপনে কি বলেন? আপনে না কত ভালা আছিলেন? জীবনে আপনের মুখ দিয়া একটা খারাপ কথা কইতে শুনি নাই। আমারেও কত ভালা পাইতেন।”
ভালা পাইতাম, না? তাইলে আয়। আমার কাছে আয়। তোর গলার রগে কামড়াইয়া রক্ত দিয়া সন্ধ্যাবেলার নাস্তা করি।
“ও আল্লাহ গো! এগুলা আপনে কি কন!”
সেলিমের মা হাত থেকে নাস্তাসহ ট্রেটা মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে ভেতর থেকে ভেসে আসা কিছু কথা কানে আসে।
“হারামজাদী বেটি। তুই যে সবাই ঘুমায় গেলে প্রতি রাতে চুপি চুপি রমজান চাচার ঘরে যাস, সেইটা আমি জানি না ভাবছোস? হাহাহা! ডরাইছ না, আমি কাউরে বলবো না! তোগো দুইটার ন্যাংটা শরীরের লীলাখেলা দেখতে আমার ভালোই লাগে। হাহাহা!”
বিছানায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শায়লা অপ্রকৃতিস্থের মত হাসতে থাকে।
সেলিমের মা ভয়ে নিজের বুকে থুথু দেয়। রুস্তম খাঁ’র ছোট মেয়ে শায়লার কথা অবশ্য সত্যি। সেলিমের মা প্রতি রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে রমজান আলীর ঘরে যায়। রমজান আলী মানুষটা ভালো। ওকে খুব আদর করে। স্বামী ছেড়ে যাবার পর এতগুলো বছর এই শরীরটা কারও আদর না পেতে পেতে শুষ্ক মরুভূমি হয়ে গিয়েছিলো। এতদিন পর একটা মানুষ তাকে ভালোবেসে কাছে টানতে চায়, সে নিষেধ করবে কেন? তাছাড়া এটা তো তেমন দোষের কিছু না। রমজান আলী তাকে বিয়ে করে ফেললেই সব দোষ কাটান যাবে।
কিন্তু শায়লা এসব জানলো কিভাবে? ওকে তো দিন-রাত খাটের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়। তাহলে শায়লা ওদের মিলন দেখলো কিভাবে? শায়লা কি সত্যিই পাগল, নাকি পাগলের ভান ধরে আছে? শায়লার ওপর সত্যি সত্যি কোনো জ্বীন ভূতের আছর নেই তো? সারারাত সেই আছর করা ভূতটা পুরো বাড়িতে চক্কর কেটে বেড়ায়। রমজান আলীর কামরায় উঁকি দিয়ে ওদের মিলন দৃশ্য দেখে। তারপর শায়লাকে এসে সব বলে দিয়ে যায়! ব্যাপারটা চিন্তা করে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সেলিমের মায়ের।
“হুজুর, ইনার কথাই বলছিলাম। বিরাট কামেল লোক।”
সামনে দাঁড়ানো সাদামাটা চেহারার লোকটাকে দেখে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না রুস্তম খাঁর। বরং উল্টোটা মনে হচ্ছে। এ লোককে দিয়েও কিছু হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। তারপরও এসেই যখন পড়েছে, একবার সুযোগ দিয়ে দেখা যাক।
“কি নাম আপনার?”
আপনার মেয়েকে দোতলার যে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছেন, ওই ঘরটায় নিয়ে চলুন।
কি বেয়াদব লোকরে বাবা! আদব-লেহাজ কিছুই নেই দেখা যায়! ভেবেছে দোতলার ঘরের কথা বলে রুস্তম খাঁকে চমকে দেবে? হুঁ! হুঁ! বাবা! রুস্তম খাঁ এত কাঁচা খেলোয়াড় নয়। এই তথ্য যে আগেই এই ব্যাটা দারোয়ান রমজান আলীর কাছ থেকে জেনে নিয়েছে, এটা বোঝার জন্য বিদ্যাসাগর হবার প্রয়োজন পড়ে না।
“দেখুন আপনি যা ভাবছেন, তা একেবারেই ঠিক নয়। আমাকে রমজান আলী বা অন্য কেউ আপনার মেয়ে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেয়নি।”
রুস্তম আলী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। এই লোক মনের কথা পড়তে পারে নাকি?
“আমার ভুল হয়ে গেছে। আসলে এই পর্যন্ত আমার মেয়েকে বহু ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি। তারা বলে, আমার মেয়ের নাকি মানসিক সমস্যা। একটাই মাত্র মেয়ে আমার। বড় মেয়ে ছোটবেলাতেই কলেরায় ভুগে মারা গেছে। এখন ছোট মেয়েও যদি..” বলতে বলতে রুস্তম খাঁর গলা ধরে এলো।
“আপনি টাকা-পয়সার জন্য..”
হাত উঁচিয়ে রুস্তম খাঁকে থামতে ইশারা করলো লোকটা।
“ওপরে আপনার মেয়ের ঘরে নিয়ে চলুন।”
দোতলার দরজার তালা খোলার পর লোকটা রমজান আলীর দিকে ফিরে বললো, “আমাদের সঙ্গে আপনার আসার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। নিচের বাগানে টেপ জড়ানো একটা টেনিস বল পড়ে আছে। ওটা খুঁজে বের করে আপনার কাছে রেখে দিবেন। আমি যাবার সময় নিয়ে যাবো। আরেকটা কথা- প্রতি রাতে নিয়মিত যে খারাপ কাজটা করে যাচ্ছেন, সেটাকে যত দ্রুত সম্ভব বৈধতা প্রদান করুন। খুব শীঘ্রই আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।”
রমজান আলী লজ্জায় জিভে কামড় দিয়ে বসে। বাবা তো অন্তরের কথা সব জেনে গেছে।
দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর পা রাখলো লোকটা। শায়লা দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে ছিলো, ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
“কিরে রুস্তম খাঁ, আবার কাকে ধরে আনছিস? ওই তুই কে?”
শায়লার কথা শুনে লোকটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটেই আবার মিলিয়ে যায়। শায়লার কথার জবাব না দিয়ে লোকটা এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে। শায়লা এবার যেন কিছুটা চমকে যায়।
“এই তুই কেরে? তুই কে? এতবড় সাহস তোর? কুত্তার বাচ্চা!”
গালি-গালাজ করে কোনো লাভ নেই, নিশু মালা। আমি স্পর্শ করার আগেই এই মেয়েটার শরীর ছেড়ে চলে যাও। আমি ছুঁয়ে দিলে কিন্তু খুব যন্ত্রণা হবে।
“তোর গলার রগ আমি কামড়ায়া ছিঁড়া ফালামু। তোর শরীরের সব রক্ত চুইষা তোরে ছোবড়া বানামু। আমার নাম তুই কেমনে জানলি?” কথা বলতে বলতে শায়লার রক্ত লাল চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। মুখটা আরও ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে।
আমি আরও অনেক কিছুই জানি। বেঁচে থাকাকালীন তুমি একজন বাঈজি ছিলে, সেটাও জানি।
“এই মাইয়ার দেহ আমি ছাড়ুম না। তুই আমার কাছে আয়, তোরে একটু ছুঁইয়া দেখি।”
লোকটা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ শায়লার কপালে নিজের ডান হাতটা রাখলো। রুস্তম খাঁ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তার ছোট মেয়ে বিছানায় জবাই করা মুরগীর মত তড়পাচ্ছে।
“ওই! ওই বান্দির পুত! হাত সরা! হাত সরা কইলাম! জ্বালারে! জ্বইলা যাইতাছে!”
লোকটা হাত সরিয়ে নেয় না। উল্টো নিজের বাম হাত দিয়ে শায়লার একটা হাত চেপে ধরে।
“ছাইড়া দে। আমি যাইতাছি। দেহ ত্যাগ কইরা চইলা যাইতাছি। কিন্তু তোরে আমি ছাড়ুম না। তোরে আমি দেইখা নিমু। আমার হাত থাইক্যা তুই বাঁচতে পারবি না।”
রুস্তম খাঁ অবাক হয়ে দেখলেন, কালো ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী ধীরে ধীরে তার মেয়ের শরীর থেকে বের হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
শায়লার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড জ্বর থেকে সেরে ওঠা কোনো রোগী। এই মুহূর্তে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। লোকটা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই রুস্তম খাঁ ছুটে এসে লোকটার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলেন।
“আপনাকে যে কি বলে আমি ধন্যবাদ জানাবো। আপনি মানুষ নন, সাক্ষাৎ দেবদূত। আপনি যা চান, যত টাকা চান আমি দিতে রাজী আছি। মুখ দিয়ে শুধু টাকার অংকটা বলুন।”
এই মুহূর্তে আমার টেনিস বলটা প্রয়োজন, যেটা আমি রমজান আলীকে খুঁজে রাখতে বলেছিলাম।
কথা বলতে বলতে ওরা নিচে নেমে আসে। দরজার একপাশে রমজান আলী আর তার পাশে ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিমের মাকে দেখা যায়। লোকটাকে দেখে রমজান আলী কাঁপা কাঁপা হাতে টেনিস বলটা এগিয়ে দেয়। লোকটা মৃদু হেসে টেনিস বলটা নিয়ে পকেটে পোরে।
“আচ্ছা, আমি চলি তাহলে।”
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে গেটের বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় লোকটা।
রাত সাড়ে নয়টা। স্কুলের পড়া শেষ করে অন্তু সবে খেতে বসেছে। ওর মন এখনও টেনিস বলের জন্য খারাপ হয়ে আছে। এমন সময় অন্তুদের বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো।
“এত রাতে কে এলো?” অন্তুর মা বিরক্ত মুখে দেখতে যান।
একটু পরেই ফিরে আসেন টেপ জড়ানো একটা টেনিস বল হাতে নিয়ে।
“কিরে, তুই নাকি বিকেলে খেলতে গিয়ে বল হারিয়ে ফেলেছিলি? লম্বা মতন একটা লোক এসে দিয়ে গেলো।”
বলটা দেখেই অন্তুর মুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠেছে। এঁটো হাত নিয়ে অন্তু বারান্দায় দৌড়ে যায়। খানিক দূরে লোকটাকে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে একসময় আঁধারে মিলিয়ে গেলো।
যাহ্! উনাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়া হলো না। উনার নামটাও জানা হলো না। লোকটার জন্য অন্তু অবশ্য মনে মনে একটা নাম ঠিক করে ফেলেছে। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ধূসর কুয়াশার মধ্যে লোকটাকে হেঁটে আসতে দেখেছিলো অন্তু।
লোকটার নাম ‘ধূসর মানব’ রাখলে কেমন হয়? আপাতত এই নামটাই বেশ মানাসই লাগছে। এরপর লোকটার সঙ্গে দেখা হলে ‘ধূসর মানব’ বলে ডেকে দেখবে। নামটা যদি উনার পছন্দ না হয়, তাহলে না হয় বদলে দেবে।