…বিকেলের ঘরছাড়া বাতাস গায়ে মাখিয়ে ছেলেটা বললো, আমি ঘুড়ি হবো।
আমরা হাসলাম। সেই হাসি বুদবুদের মত ভেসে রইলো বাতাসে। আমাদের সরব উপস্থিতির সংস্পর্শে সেগুলো চিকচিক করে।
একসময় নিজেদের সামলে ছেলেটাকে বিশ্রাম নিতে বলি। আশ্বাস দিয়ে বলি, এরকম হতেই পারে।
সবারই কখনো না কখনো হয় এমন। বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফিরে যেতে যেতে আমরা বাতাসে আরও কিছু বুদবুদ রেখে যাই।
পরদিন আমরা আবিস্কার করি, ছেলেটা আমাদের মাঝে অনুপস্থিত। আমরা তৃপ্তির হাসি ঠোটে মেখে বলি, “যাক, ছেলেটা কথা শুনেছে।
বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘুড়ির ভূত ওর মাথা থেকে নেমে যাবে।”
*
প্রতিদিন যে নদীর কাছে শীতল হতে এসে সূর্যটা নিজের স্থান ভুলে ডুবে যায়,
তার কাছে বসে কোন এক বিকেলে আমরা সূর্যের এমন কান্ডজ্ঞান নিয়ে কথা বলছিলাম। ডুবতে হলে সমুদ্রে যাও, নদীতে কেন?
নিজের বিশালত্বের প্রতি সামান্য সম্মান থাকলেও তো তোমার সমুদ্রের বিশালতায় ডোবা উচিৎ, লিকলিকে নদীতে কেন?
আমরা হয়তো আরও কিছুক্ষণ সূর্যের মূর্খতার কথা বলতাম।
কিন্তু আমাদের কাছ দিয়ে ছুটে যাওয়া মানুষটার থমকে দাঁড়িয়ে বলা কথা আমাদের কথা থামিয়ে দেয়।
“ছেলেটা ঘুড়ি হয়ে গেল? আশ্চর্য্য!”
আমরা সমগ্র কথা হারিয়ে একজন অপরজনের দিকে তাকিয়ে থাকি। সত্যিই ঘুড়ি হয়ে গেছে? ছেলেটা?
*
শহরের সমগ্র মানুষ ততক্ষনে জড়ো হয়ে গেছে। আকাশের যে অংশটাতে ঘুড়ি হয়ে যাওয়া ছেলেটা মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে,
সবার চোখ সেখানে স্থানুর মত জমে আছে। আমরা তাদের অনুসরন করি। আকাশের দিকে তাকাই। ঘুড়ির উড়ে বেড়ানো দেখি। এদিক সেদিক।
কয়েকবার গোপন করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আমরা আমাদের দীর্ঘশ্বাসের কূয়ায় ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম।
হয়তো আমরাও পারতাম ঘুড়ি হতে। আমাদেরও হয়তো এতক্ষনে ওড়ার কথা ছিল।
আর তখনই, কূয়ার অতলে পৌছে আমাদের কেউ একজন ফিনফিনে দড়ির মত ঝুলতে থাকা ঘুড়ির লেজ দেখলো।
আমরা সমস্বরে তখন বলে উঠি, এটা কোন ঘুড়ির লেজ? বেমানান, অসুন্দর, কুৎসিত!
আমরা তখন কূয়া থেকে ওঠার জন্য ঘুড়ির লেজ ধরে বসি। আমাদের আশেপাশের বাতাস আবারও হাসির বুদবুদে ভরে ওঠে।
এরপর আমরা ঘুড়ির রং, আকার নিয়ে কথা বলি।
খুব বেশিক্ষণ যে তার পক্ষে আকাশে উড়ে বেড়ানো সম্ভব হবে না, সে বিষয়ে একমত হয়ে আমরা এক ধরণের আনন্দ অনুভব করি।
মাটিতে আছড়ে পড়ার পর কেমন একটা ভালো শিক্ষা হবে তা ভেবে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে জড়ো হওয়া মানুষের কেউ কেউ আমাদের সাথে যোগ দেয়। আমাদের সাথে একমত হয়, ঘুড়িটা পড়লো বলে।
আমরা প্রার্থনার মত অপেক্ষা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি, ঘুড়িটার আছড়ে পড়ার।
*
দিন পার হওয়া সত্ত্বেও যখন ঘুড়ি আছড়ে পড়ে না, আমরা চিন্তিত হই। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! আমরা পুনরায় আকাশের দিকে তাকাই।
ধরাছোয়ার বাইরে থাকা ঘুড়িটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতে শুরু করি। আর তখনই আমাদের চোখে পড়ে, ঘুড়িটা আগের মত রঙহীন নেই।
তার মাঝে কেমন রঙের আভাস! আকারেও কেমন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করি। আর সেই ফিনফিনে লেজটা, সেটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট।
আমরা আমাদের মাঝে ঝাউয়ের পাতায় আটকে পড়া বাতাসের মত এক গর্জন টের পাই।
আমরা কেউ কাউকে বলি না, কিন্তু আমরা জানি আমরা সবাই সুতোটার খোঁজে হাঁটছি। ঘুড়িটার সুতো।
আশেপাশে কোথাও নিশ্চয় আছে। সুতোটা দরকার আমাদের।
*
আমরা যখন সুতোটার খোঁজ পাই, ততক্ষনে শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আমরা আমাদের মাঝে একধরনের তাড়া অনুভব করি।
দ্রুত কাজটা সেরে ফেলতে হবে। আমাদের কেউ একজন তখন এক হাতে সুতোটা ধরে পকেটে ভাজ করে রাখা ছুরিটা বের করে।
সন্ধ্যার ঝাপসা আঁধার চিরে চকমকিয়ে ওঠা ছুরিটার দিকে তাকিয়ে আমরা এক আদিম উল্লাস অনুভব করি।
আর ঠিক তখনই “ফানুস, ফানুস” শব্দে আমরা চমকে উঠি।
“ঘুড়িটা ফানুস হয়ে গেছে, ঘুড়িটা ফানুস হয়ে গেছে!”
কোন একজনের চিৎকার শুনে আমরা আকাশের দিকে তাকাই। কোথাও ঘুড়িটাকে খুঁজে পাই না।
তার পরিবর্তে সন্ধ্যার আকাশ আলো করে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা ফানুস।
ততক্ষনে গুরত্বহীন হয়ে যাওয়া সুতোটা হাতে নিয়ে আমাদের একজন বলে, “ওর যে ফানুস হওয়ারও ইচ্ছা ছিল, বলেনি তো কখনো।
বললে আমরাও না হয় একবার ফানুস হওয়ার চেষ্টা করে…..”
আমাদের জমে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা ফানুসটাকে দূরে চলে যেতে দেখি।
আমাদের থেকে একটু একটু করে দূরে চলে যাওয়া ফানুসটাকে দেখি।