বাবা

বাবা
“হোসনেআরা খেয়ে যেয়ো কিন্তু”। হোসনেআরা ইতস্তত করে হতাশ হয়ে উত্তর দেয়, “আফা, আমার পোলাডা ছোট মানুষ বাসায় একলা থাকবো”।
শারমিন নাহার পেঁয়াজুর শেষ দলা টা তেলে ছেড়ে তার গৃহ পরিচারিকা হোসনেআরার দিকে তাকিয়ে বলেন, ” সে কি কথা? হাতের কাজ টা সেরে চট করে নিয়ে চলে আসবে, আর রমজানের এই ত্রিশ দিন কিন্তু তোমরা আমার বাড়িতেই ইফতার করবে”। খুশিতে হোসনেআরার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে, সে উচ্ছ্বাসিত হয়ে শারমিন নাহারের হাত থেকে চামচ টা নিয়ে বলে, “দ্যান দ্যান আফা আমি করি, আপনে না আজকে জিলাপি বানাইবেন? আটা কি কইরা দিমু?” শারমিন কিছুটা চুপ থেকে উত্তর দেন, “না, জিলাপির সবটা আয়োজন আমি একাই করবো। তুমি বরং চপ গুলো ভেজে নাও। “
হাতের কাজ টা হোসনেআরা কে বুঝিয়ে দিয়ে শারমিন নাহার জিলাপি প্রস্তুতে মনযোগি হয়। আজ রমজানের প্রথম রোজা, পরিবারের ছোট সদস্যরা ও সিয়াম ব্রতে পিছিয়ে নেই। রোজা মুখে ঘরের মাঝে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ । চোখের সামনে কড়াইয়ে তেল টা টগবগ করে ফুটছে, শারমিন অতি যত্নের সাথে ফুটতে থাকা তেল টায় জিলাপির পেঁচ ঘুরাচ্ছেন। জিলাপি গুলো ভাজা হয়ে মনের মত রঙ ধরছে, প্লেট ভর্তি কমলা রঙের জিলাপি গুলোর দিকে তাকাতেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে শারমিন নাহারের।
এইতো কয়েক বছর আগের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন সময় টাতেও রান্নাবান্নায় ভীষণ অপটু ছিলো শারমিন। মা বরাবরই তাকে বলতেন, “শশুড়বাড়ি গিয়েও আমি রেঁধে খাওয়াবো তোকে? কিছু তো শিখ!” বাবা জাফরুল্লাহ সাহেব মেয়ের পক্ষ হয়ে বলতেন, “আহহা, কেন বকছো অযথা? আমি না হয় রান্না করতে হয়না এমন ঘরেই ও কে বিয়ে দিবো” বাবার সাথে হাত মিলিয়ে জোর গলায় হেসে ফেটে পড়তেন শারমিন। মা রেগে থাকলেও বিরক্ত হতেন না। একদিন হঠাৎ করেই ইউটিউব দেখে জিলাপি বানানোর ভূত চাপে শারমিনের মাথায়৷ জীবনের প্রথম রান্নাঘরের খুন্তি কড়াই নেড়ে সবচেয়ে বিস্বাদ জিলাপি টা তৈরী করলেও সেগুলো জাফরুল্লাহ সাহেবের কাছে ছিলো অমৃত। এরপর থেকে পারার মধ্যে কেবলই জিলাপি, ক’দিন পরপরই বাবার মদদে জিলাপি তৈরী করতেন শারমিন। জাফরুল্লাহ সাহেব সেটা বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেতেন।
এরপর বছর দু’য়েকের মধ্যে এক প্রকৌশলী পাত্রের হাতে মেয়ে শারমিন নাহার কে তুলে দেন জাফরুল্লাহ সাহেব। মেয়ের বিয়ের পর নিঃসঙ্গ দম্পতির আর হুটহাট মেয়ের হাতের জিলাপি খাওয়ার ভাগ্য হতো না। তবে প্রতি রমজানের প্রথম রোজায় তারা চলে আসতেন মেয়ের বাড়ি, পাশাপাশি চেয়ারে বসে সেই পুরনো তৃপ্তি নিয়ে জিলাপি খেতেন তিনি। সেখান থেকে রমজানের প্রথম রোজায় জিলাপি ছিলো শারমিন নাহারের সবচেয়ে প্রিয় রেসিপি। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে টেবিল সাজিয়ে চেয়ারের পাশে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শারমিন। বেশ কিছুক্ষণ তাকে এ অবস্থায় দেখে তার স্বামী ফয়সাল বলেন, “কি হলো শারমিন? বসো, মোনাজাত ধরো আজান হয়ে যাবে।”
ফয়সাল আহমেদের ডাকে বাস্তবে ফিরে শারমিন, মাথায় ঘোমটা দিয়ে চেয়ার টেনে বসে পরে৷ সব আয়োজন ঠিক ঠাক রয়েছে, সামনে জিলাপির প্লেট টা ও আছে, কেবল পাশের চেয়ার টা খালি। গত বছরও এইদিনে শারমিনের পাশের চেয়ার টায় আয়েশ করে বসে ছিলেন জাফরুল্লাহ সাহেব। আজ তিনি পৃথিবী ছেড়ে অনেকটা দূরে! এ রমজানের তার আর মেয়ের হাতের জিলাপি খাওয়া হলো না। দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরতেই দুই গাল বেয়ে দরদর করে পানি বেয়ে পরছে শারমিন নাহারের, বাহির থেকে আজানের ধ্বনি এসে কানে আওয়াজ দিচ্ছে। এই সময় টা রোজাদারের দোয়া কবুলের সময়, শারমিনের ঠোঁট কাঁপছে, চোখ বুজে তীব্র আকুতি নিয়ে শারমিন অনবরত পড়ছেন, “রব্বীর হামহুমা কামা রব্বা ইয়ানী সগিরা! “
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত