পরিবার

পরিবার
যোহরের নামাজ শেষ করে নামাজের বিছানাটা হাতে নিতেই দরজায় নক। দরজাটা খোলাই ছিল।পর্দা সরাতেই দেখলাম মা।
-কি করছো মা? খারাপ লাগছে না তো?
-নামাজ শেষ করলাম মাত্র।না না খারাপ লাগছে নাহ।আমার ছোট বেলা থেকেই রোজা রাখার অভ্যাস আছে।
-ওহ আচ্ছা তাহলে খুব ভালো। আচ্ছা আমি যেটা বলতে আসছিলাম আজকে আমরা সবাই বাইরে ইফতারি করতে যাব।তুমি মা আসরের নামাজের পরই রেডি হয়ে যেয়ো।
-বাইরে ইফতার কেন মা?
– তোমার বাবার (শ্বশুর) ইচ্ছা।
-আচ্ছা ঠিক আছে মা।
বিয়ের পর আমার প্রথম রোজা।আরিফের সাথে বিয়েটা আমার পারিবারিক ভাবেই হয়। মাস তিনেক আগে।বলতে গেলে শ্বাশুড়ি মায়ের পছন্দেই আমার এই বাড়ির বউ হওয়া। আমাদের সিলেটিদের মধ্যে মেয়ের বাড়িতে নতুন বিয়ে হলে দুইবার ইফতারি পাঠাতে হয়।প্রথম রোজায় একদিন আর মাঝে আরেকদিন। দিন সাতেক আগে শ্বাশুড়ি মা হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠালেন,মায়ের রুমে গিয়ে দেখলাম আমার হাসবেন্ড থেকে শুরু করে বাসার সবাই আছেন।বুঝলাম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাই হবে। আমাকে উনার পাশে বসতে বলে উনি কথা শুরু করলেন। শুনো মা,আমরা সিলেটি হলে ও আমি আমার পরিবারের মধ্যে কুসংস্কার ডুকতে দেই নি। দুই ছেলেকে শিক্ষায় নয় মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে ও বড় করে তুলতে চেয়েছি।সমাজের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ সেটা বুঝতে শিখিয়েছি। এবার উনি সরাসরি আমাকে বললেন, তোমার ভাইয়াকে ইফতার পাঠাতে না করে দিয়ো।
মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠানোর পক্ষপাতী আমি না আমার পরিবার ও না।তুমি শিক্ষিত মেয়ে।নিশ্চয়ই বুঝবে আমার কথা।এটা আমাদের মধ্যে একটা কুসংস্কার। যাদের অবস্থা ভালো তারা না হয় দিলো কিন্তু যাদের অবস্থা খারাপ তাদের মেয়ের বাড়িতে কিভাবে পাঠাবে।অনেকে ধার ধ্যানা করে মেয়ের বাড়িতে গাড়ি ভরে ইফতার পাঠায়।নইলে নাকি মান সম্মান থাকবে না।আর শ্বশুর বাড়ির লোকজনের মানসিকতা কেমন।ছেলে বিয়ে করানোর সময় তো সব কিছু জেনেই বিয়ে করায় তাইলে ইফাতারির বেলায় ওরা মানা করে না কেন?এটার বীজ গোড়া থেকে উপরে না ফেললে কখনো নির্মুল হবে নাহ। আমাকে কিছু সুযোগ বলার সুযোগ না দিয়ে আমার জা বললো
-এটা কিন্তু তোমার বেলায় নয়,আমার বেলায় ও কিন্তু মা ইফতারি নেন নি।আমার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ও ইফতারি আসে নাহ। আর এই বাসায় তো কেউ ইফতারি পাঠানোর নাম মুখে আনে না।
-কিন্তু মা ভাইয়া তো এসব বুঝবে নাহ।ভাইয়া ইফতারি নিয়ে আসবেন-ই।
-তাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়ো দাও।আর তুমি ও বুঝিয়ে বলবে।
– জ্বি মা।
যদিও এর পরে ভাইয়াকে বুঝাতে আমার শ্বাশুড়ি মায়ের অনেক কথা বলতে হয়েছে।উনি মোটেও বেশি কথা বলা পছন্দ করেন নাহ।ফোনে কথা বলে উনি ভাইয়াকে বুঝাতেই পারছিলেন না ব্যাপারটা। শেষমেষ আমাকে সাথেই গেলেন ভাইয়ার ওইখানে।ভাইয়ার এক কথা আন্টি আপনি নিশ্চয়ই আমাদের উপরে কোনো কারনে রেগে আছেন তাই না করতেছেন।মা যখন সবকিছু খুলে ক্লিয়ার করে বললেন তখন ভাইয়া বুঝলেন। তবে সাথে এটা এ বললেন আমি কিন্তু আমার বোনকে দেখতে খালি হাতে যাব না। শেষমেষ রেগে গিয়ে শ্বাশুড়িমা বললেন তোমার বোনকে তুমি দেখতে অবশ্যই যাবে।কিন্তু আমার বাড়িতে যেন ইফতার না যায়। অতঃপর আমার ভাই ও শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে হার মারলেন।উনি ইফতারি পাঠান নি। আসরের নামাজ পড়েই আমি রেডি হয়ে গেলাম। আমার ভাসুরের পাচ বছরের পুচকে টা দরজায় নক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো মামনি তুমি কি রেডি?
-ভেতরে আসো আব্বু।
-আরেহ তুমি তো রেডি। দাদুমনি বলেছে তুমি রেডি হয়েছো কিনা দেখতে।
-আমি তো রেডিই।আচ্ছা আব্বু তুমি আজকে কয়টা রোজা রাখছো?
-আম্মু বলছে আমার আজকে দুইটা রোজা হইছে।
-তাই নাকি!তাহলে তুমি ত্রিশ দিনে কয়টা রোজা রাখবে বলোতো?
-আমি তোমাদের চেয়ে বেশি বেশি রোজা রাখব।
– আচ্ছা রেখো।এবার দাদুমনিকে বলে আসো যে মামনি রেডি।
সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা বের হলাম। আমি এখনো জানি না কোথায় ইফতার করব। গাড়িতে শ্বাশুড়ি আম্মু আমাকে মাঝখানে বসতে বললেন আর দুইপাশে উনি আর আমার জা। পুচকে তার দাদুর কোলে বসে বসে হিসাব করছে সে আজকে ইফতারিতে কি কি খাবে।
হঠাৎ শ্বাশুড়ি মায়ের কি মনে হতে উনার ফোনটা আমাকে দিয়ে বললেন দেখো তে মা আমার ফোনে কি যেন সমস্যা হইছে কথা শোনা যায় নাহ।টার্চ স্কিনে ও কি যেন সমস্যা। আমি উনার ফোনটা হাতে নিয়ে সমস্যা খুজলাম কিছুই পেলাম নাহ। তাও মা বারবার বলছেন দেখো সমস্যা আছে কিছু।এমনিতে তো সমস্যা হওয়ার কথা নাহ।এভাবে বেশকিছুক্ষন চলার পর, হঠাৎ করে গাড়িটা থেমে গেলো। মা আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন বাসায় গিয়ে সমস্যা খুইজো এখন বাদ দাও বলে গাড়ি থেকে নামলেন।আমি গাড়ি থেকে নামার আগে আশেপাশে কোথাও তাকাই নি তাই বুঝতে পারি নি যে গাড়িটা আমার ভাইয়ার বাসায় সামনেই এসো থামলো।আমি নামতেই সবাই আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে রইলো।আমি কিছুই বুঝলাম নাহ।অবাক হয়ে মায়ের দিকে একবার আরিফের দিকে একবার তাকাই।
-মা বললেন এত অবাক হওয়ার কিছুই না বাসার ভিতরে চলো তোমার মত বাকি সবাইকে ও সারপ্রাইজ দিতে হবে বলেই তিনি হাতে অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট নিয়ে বাসার ভিতরে চলে গেলেন।তার পিছুপিছু বাবা আর আমার জা ও গেলেন।আমি বোকার মত তখনো দাড়িয়ে আছি। আরিফ আমার হাত ধরে বললো তুমি কি এখনো কিছুই বুঝো নাই?
-হঠাৎ করেই আমার কাছে সব ক্লিয়ার হয়ে গেলো। আর আমি ভীষণ খুশি হয়ে গেলাম।বেশি খুশী হলেই আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসে।
-আরেহ তুমি কাঁদো কেন? তুমার চোখের পানি দেখতে তো তোমারে আমি এখানে নিয়া আসি নাই। আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,সকালে তুমি যখন প্রীতির সাথে (ছোটবোন)ফোনে কথা বলছিলে আমি সব শুনে ফেলছি।আমি ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম।
দেখলাম আমার বউ তার ভাই আর বোনরে খুব মিস করতেছে আর তোমার তো প্রথমবার তাদেরকে ছাড়া রমজান তাদের জন্য মন খারাপ করাটা স্বাভাবিক।তাই ভাবলাম বউটারে একটু খুশি করে আনি। আম্মাকে বলতেই উনি রাজি হয়েগেলেন। আমার কাছ থেকে সব শুনে বললেন এই বুদ্ধিটা কেন আগে মাথায় আসে নাই তাহলে বড়বৌমাকে ও একটু সারপ্রাইজ দেয়া যেতো। সব শুনে আমার কেন জানি ভীষণ আনন্দ লাগছিল।এমন একটা পরিবার পাওয়ায় মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কাউকে উদ্দেশ্যে করে বললাম প্রতিটা মেয়ে যেন এরকম পরিবায় পায়।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত