মেঘের সিঁড়ি

মেঘের সিঁড়ি
আমি যেদিন বড় মাপের নেতা হবো, সেইদিন তোর সিগারেট খাওয়ানোর কথা জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে বলবো। সেইদিন চিৎকার করে বলবো, একসময় আমার পকেটে টাকা ছিলো না। আমার বান্ধবী আমাকে তার নিজের টাকা দিয়ে সিগারেট খাইয়েছে।’ বর্ণের কথা শুনে অনু শব্দ করে হেসে বলে, ‘মামা, কত বিল হলো?’ দোকানদার চায়ের কাপে থেঁতানো আদা দিতে দিতেই বলে , ‘২৪ টাকা, আপা’ বর্ণ অনুর দিকে সিগারেটটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে,খেয়েই দেখ একবার?’
মুখ বাঁকিয়ে অনু ফিরিয়ে দেয় বর্ণের দেওয়া সিগারেট। ‘তোর ছাইপাঁশ তুই খা। আমি এইসবে নেই। ছেড়ে দিতে পারিস না এইসব? ‘ বর্ণ নিশ্চুপ ভঙ্গীতে হেসে বাতাসে ধোয়াঁ উড়িয়ে অনুকে দেখায়। অনুর নাকে মুখে ধোয়াঁ লাগে, অনু কেশে উঠে। অনু ৮ টাকা হাতের মুঠোয় করেই বর্ণের সাথে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটতে থাকে। বর্ণ ও একা হাঁটছে না তার দুই হাতে সদ্য ছেঁড়া এক জোড়া স্যান্ডেল । স্যান্ডেল জোড়া দেখিয়ে অনুকে সে বুঝাচ্ছে যে, ‘৫ টাকা দিয়ে সেলাই করে নিলেই এই স্যান্ডেল জোড়া নির্দ্বিধায় সে মাসছয়েক চালিয়ে দিতে পারবে।’ কিন্তু বারংবার অনুর মানা করার পরেও বর্ণ স্যান্ডেল জোড়া হাত থেকে ফেলেনি। অণুর থেকে ৫ টাকা ধার নিয়ে সে রাস্তার ধারে বসা মুচির থেকে একখানা স্যান্ডেল সে সেলাই করলো।
কিন্তু এইবার সে বিপাকে পড়লো অনুর কথায়, কারণ স্যান্ডেল দুখানা মেয়েদের। আর বর্ণ ছেলেমানুষ হয়ে এই স্যান্ডেল কিভাবে পড়বে? স্যান্ডেল পাওয়ার খুশিতে সে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি তা। বর্ণ তার লজ্জামাখা দৃষ্টিতে অনুকে বলে, ‘ স্যান্ডেল দুখানা তুই নিয়ে যা? বাসায় পড়তে পারবি? অনু তিক্তভাবে উত্তর দিলো, ‘তোর কুঁড়িয়ে পাওয়া স্যান্ডেল তুই পড়। আমি এইসব পড়িনা। অনেকক্ষণ বর্ণ স্যান্ডেল দুখানার উপকারিতা বুঝানোর পরও যখন ব্যর্থ হলো তখন ফুটপাতের শুয়ে থাকা এক ঘুমান্ত মাথার কাছেই স্যান্ডেল জোড়া রেখে দিয়েই বাড়ির রাস্তা ধরলো।
চেয়ারের কাঠের সাথে বারংবার পা ঘষতে ঘষতে অনু শুধুই ভাবছে আজ টিউশনির টাকাটা দিবে তো পিহুর মা? গত তিনদিন যাবত অনু আশায় থাকে এই বুঝি টাকার খাম টা এগিয়ে দেয় পিহুর মা দরজা ঠেলে। কিন্তু না মাসের ১০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর ও পিহুর মায়ের খেয়াল নেই অনুর টিউশনির টাকার কথা। প্রতিটা মাসেই শুরু হওয়ার সাথে সাথেই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে কবে বাদামী রঙের খাম টা হাতে আসবে? যেনো মনে হয় বাদামী রঙের খামেই বন্দী একরাশ অপেক্ষার দীর্ঘ শ্বাস। বিরস মুখেই ২ ঘন্টা পড়িয়ে বের হয় অনু। সদর দরজা ঠেলে বের হতেও মিনিট দুয়েক সময় নেয়। এই বুঝি পিহুর মা ডেকে বলে, অনু খাম টা নিয়ে যাও। ভুলেই গিয়েছিলাম এইবার। কিন্তু পেছন ফিরে আর ডাক শোনা হয় না।
ল্যাম্পপোস্টের সব বাতিই আজ নিভানো। তবু অন্ধকার হাতরিয়ে হেঁটে যায় অনু। খালি মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে অনু। খুব ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারে সেইখানে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। যেনো মনে হচ্ছে ঘুটঘুটে অন্ধকার তাদের গিলে খাচ্ছে। পরক্ষণেই অনু দ্রুত পা ফেলে এক নিঃশ্বাসে মাঠ পেরিয়ে যায়। চশমাটাও ঘোলা হয়ে আসছে। কয়েকদফা পরিষ্কার করেও লাভ হচ্ছে না তেমন। পেছন থেকে রিক্সার টুংটাং আওয়াজ শোনা যেতেই অনু দোটানায় পড়ে যায় রিক্সায় করে বাকি পথটুকু চলে যাবে কি না? সাইড ব্যাগে হয়তবা ১০ টাকার নোট থাকতে পারে। রিক্সা সামনে আসতেই অনু হাত দিয়ে ইশাড়া করে রিক্সায় উঠে পড়ে। ব্যাগ থেকে ১০ টাকা বের করে দিতেই রিক্সাওয়ালা বলে উঠে আরো ৫ টাকা দিতে। অনু জোর দিয়ে বলে উঠে, ‘এতটুকুন মাত্র রাস্তা ভাড়া কি না ১৫ টাকা? আমি রোজ ১০ টাকায় আসি।’
রিক্সাওয়ালা রাগ দেখিয়ে বলে, ‘১৫ টাকায় আরেক যাত্রি নামায় দিয়া আসছি। আর আপনার জিগায় উঠুন দরকার ছিলো। এখন ঘ্যানঘ্যান না কইরা টাকা দেন।’ শূণ্য ব্যাগের পকেট হাতরিয়ে ৫ টাকার একটা কয়েন এগিয়ে দেয় রিক্সাওয়ালার কাছে। অনুর মেজাজ যেনো আরো চড়ে যায়, ইচ্ছে করে কিছু কথা শুনিয়ে দিতে তবুও অনু থেমে যায়। যখন অনুর কাছে টাকা থাকে অনু এমনিতেই ৫-১০ টাকা বেশি দেয়। কিন্তু যখন হাতে গুণা কয়েক টাকা থাকে তখন বড্ড অসহায় লাগে রিক্সাওয়ালারদের অধিক ভাড়া আদায়ে। তবুও অনু নিশব্দে নিজের বাড়িতে চলে যায়।
অনু ছাদে দাড়িঁয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পিহুর মা টিউশনের টাকা টা দিয়েছে। অনু এসেই মায়ের হাতে খাম টা তুলে দেয়৷ পরক্ষণেই অনুর মায়ের মুখে এক ফালি চাদেঁর ন্যায় হাসির রেখা প্রকাশ পায়। অনুর সেই হাসির জন্যই হয়তোবা হাজার খানিক বছর বেঁচে থাকতে পারবে। দুই সদ্যেসের পরিবার অনুদের৷ অনু আর তার মা। অনু চারটে টিউশনি আর একটা স্কুলে চাকরি করে। এতেই দুজনের বেশ কেটে যায়। মাঝেমধ্যেই অনুর মা কান্নাকাটি করেই বলে উঠে, তিনি না থাকলে কি হবে অনুর? অনু তখন ছলছল চোখে বলে, ‘তুমি আছো তো মা। কোথায় যাবে আমায় ছেড়ে। যেতেই দিবো না দুই হাত দিয়ে ঝাপটে ধরে রাখবো। অনুর মা হাসে অনুর বাচ্চাদের মত কথা শুনে। সাথে অনুও হাসে৷ মা মেয়ের হাসিতে যেন চারপাশও গুনগুন শব্দ করে উঠে। ‘জানিস এই পাঞ্জাবি টা বাবার।’ এই বলেই পাঞ্জাবির গায়ে হাত বুলাতে থাকে বর্ণ। অনু বর্ণের দিকে হেসে বলে, ‘জুতো খানা আর জিন্সটা বুঝি বড় আর ছোট ভাইয়ের?’
বর্ণ মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়, ‘তুই বড্ড চিনে ফেলেছিস আমায়। তোর সাথে আজকাল কথা বলে শান্তি বোধ হয় না। অন্যেদের সাথে জম্পেস গোলগপ্প করা যায়। তুই অনেকটা ঠোঁটকাটা প্রকৃতির মেয়ে।’ এই বলে বর্ণ উঠে দাড়াঁলো আর হনহন করে হাঁটা শুরু করলো। অনু খিলখিল করে হেসে বর্ণের পিছু ছুটে। দুজনের রাস্তা বড্ড কাদাঁটে। অনু সারাদিন খেটেখুটে মায়ের জন্য সুখ কিনে আর বর্ণ বড় নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বর্ণ বর্তমান কে নিয়ে বাঁচে আর অনু আগামীকে ঘিরে। অনু আর বর্ণে প্রচুর পার্থক্য তবুও অনু আর বর্ণ দুজন ভালো বন্ধু। এই বন্ধুত্বর সিঁড়িতে হঠাৎ হুটহাট মেঘ ছুঁয়ে দেওয়া যায়।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত