কুলির কথা

কুলির কথা

একটা মধ্যবয়সী মেয়ের ব্যাগ নিতে গিয়ে উনার চুলের ঘ্রাণে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। বড়লোক মানুষের শরীর থেকে কত মনোরম, কতো রকমের ঘ্রাণ আসে। আমি চোখ বুজে আছি। মেয়েটাও হয়তো দেখতে বেশ সুন্দর। মেয়েদের দিকে তাকালে তারা লুচ্চা ভাবে। আর আমার ওরম কোনো ইচ্ছা বা দৃষ্টি কোনোটাই নাই। মেয়েটাই আমার ঘোর ভাঙালো। “কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি ট্রেনে তুলো। আমি হকচকিয়ে গিয়ে ব্যাগটা টেনে তুললাম ট্রেনে। বিশ টাকা পেলাম। টাকাটা নিয়ে বললাম “আপা যাই সাবধানে যাইয়েন। উনি বললেন “আচ্ছা যাও যাও। ”

বিরক্ত নিয়ে বললেন কিনা ভাবার দরকার বোধ করিনি। রোজ কত রকমের মানুষের ব্যাগ কাঁধে নিই। কত রকম কথা শুনতে হয়। গালিগালাজ সেতো নিত্যদিনের ব্যাপার। ট্রেন আরও ৫ মিনিট পর ছাড়বে। বিমানবন্দর থেকে রাজশাহী যাবে ট্রেনটি। ট্রেন থেকে নেমে ভাবলাম একটু সামনের গেইট থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু কিছুটা সামনে যেতেই দেখলাম এক বৃদ্ধ ঠাকুমা দুটো ব্যাগ নিয়ে ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছেন। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার তবুও কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল উনাকে জাগানো উচিত। উনি হয়তো ট্রেন মিস করবেন। আমি উনার পাশে বসে ডাকলাম “ও ঠাকুমা, এই যে ঠাকুমা যাবে কোথায় বল দিকিন? উনি আস্তে আস্তে উঠে চশমাটা ঠিকমতো লাগিয়ে বললেন “এ কে রে? রাজন দাদু? ”

“আমি রাজন নই গো। তুমি কোথায় যাবে ট্রেন তো মিস করে ফেলবে? দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাচ্ছ?”

” আমি তো রাজশাহী যামু দাদুভাই। কখন ঘুমালাম যে। এই হলো রে ট্রেন কি চইলা গেল দাদুভাই? ”

“যায় নাই তাড়াতাড়ি আসো তুমি।”

ট্রেনে টিকেট করেও আজকাল কোন লাভ নাই। বিনা টিকিটের টিটির আত্মীয়রা আপনাকে আপনার সিট পর্যন্ত পৌঁছতেই দিবেনা। কাপড়ের কোণ হতে টিকিটটা আমার হাতে দিলে আমি ঠিকমত উনার সিটে বসিয়ে দিলাম উনাকে। তাও আবার কত ঠেলাঠেলি কত চিল্লাচিল্লি করতে করতে। উনাকে বসানোর পর বললাম “ঠাকুমা তুমি কেমন করে যাবে এতদূর? একা একা যেতে পারবে? আর এখানে একা একা এলেই বা কী করে? ”

“একা আসি নাই দাদুভাই। রাজন দিয়ে গেল । ও আমার মেয়ের ছেলে। রাজন ঢাকা থাকে। আর আমি যেতে পারি রে। কত গেলুম। এসব বলতে বলতে উনি টাকা বের করেছিলেন হয়তো পুরাতন ময়লায় ঢাকা ব্যাগটা থেকে। আমি বললাম

“সেকি গো নাতিকে কেউ টাকা দেয় শুনেছ কাজের বিনিময়ে। তোমার কিছু দেয়া লাগবেনা। ”

” সে কি কথা এই নে কিছু কিনে খাস।”

” দাদু লাগবে না গো। দোয়া কইরো।”

” তা তো করবোই। এদিকে আয় তো।”

উনি আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বসলেন। শহরের মানুষের কাছে হয়তো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি, অপ্রাসঙ্গিক লাগলে লাগতেও পারে কিন্তু আমি গাঁয়ের ছেলে তাও আবার নিচু সম্প্রদায়ের মানুষ আমার খারাপ লাগেনি বরং নিজের দাদুর কথা মনে পড়ে চোখ দুটো ভিজে উঠলো। ভাবছিলাম ব্যাপারটা শেষ কিন্তু শেষ হলো না। উনি ওই পুরাতন ব্যাগটা হতে পুতুলের মতন কি একটা পুরাতন জিনিস আমার হাতে দিয়ে বললেন “এইটা রাখিস আমার স্মৃতি হিসেবে। ” এই বলে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ গুলো মুছলেন।

ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। উনাকে সাবধানে যেতে বলে নেমে গেলাম। কেনো যেনো পা গুলো চলছে না। অল্পতেই কান্না করে দেয়া মানুষগুলোর মন খুব নরম হয়। কত রকম আঘাতের পর মনের এই অবস্থা হয় সেটা অনেকেরই অজানা। আমার দাদু আমার ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন। শীতের সকালের ঝাপসা রৌদ্রের মতো কিছু কিছু মনে পড়ে তিনি কত আদর করতেন। “ভাইয়ু “ভাইয়ু ” বলে ডাকতেন। দাদু আমার এখন সেই অচেনা পরকালের অজানা অবস্থায় বিরাজ করছে।

আমি ক্লাস টেনে পড়ি এখানকার একটা স্কুলে। জীবিকার জন্য কুলি হিসেবে কাজ করি। তবে ইচ্ছা আছে যখন চাকরি করবো, প্রতি সপ্তাহে দাদা, দাদীর নামে মিলাদ পড়াবো। ভুলেই গেছি, আমার হাতে না সময় নেই। আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ঠাকুরমার দেয়া পুতুল মতন জিনিসটা সযত্নে সঙ্গে নিয়ে উনার নিরাপদ যাত্রা কামনা করতে করতে প্রথম গেইটের দিকে এগোতে লাগলাম।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত