বেরসিক কর্পোরেট অফিসের ইট, পাথরের ভবন আর স্বচ্ছ কাঁচের বারান্দা থেকে মাতাল হাওয়া, স্নিগ্ধ সকাল, পাগল করা ঝমঝম বৃষ্টি, রামধনুর সাত রঙ, রৌদ্রোজ্জ্বল স্বর্নালী দিন,বিষন্ন বিকেল কিংবা গোধুলীর শেষ আলো নিতান্তই বেমানান লাগে । দূরে বিল্ডিংয়ের মাথার উপর জমাট বাঁধা মেঘ, বাঁকা ঠোঁটের মতো চাঁদ অথবা একফালি রোদ হালকা কোন এক আভা নিয়ে ঝুলে থাকে ঠিকই, কিন্তু চোখ ধাঁধানো ইলেকট্রিসিটির আলোর ঝলকানি আর ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুভুতির মাঝে তাদের সৌন্দর্যগুলো ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে যায় । রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অফিস নামক খাঁচা থেকে প্রায়ই রোবটের মতো মানুষদের দেখি।
তাদের নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে, চালচলনে, সমগ্র অবয়বে ক্লান্তি, অবসাদ আর অনুভূতি শূন্যের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকানোর অবসর কিংবা ইচ্ছা খুব বেশি জনের হয় না। ফুল, পাখি, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র নিদানপক্ষে পূর্ণিমা, অমাবস্যা, রোদ, বৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মনটাও হয়ত হারিয়ে যায় অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে। ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যেতে হয় নিজের সাথে, অনেকের সাথেই। ফরম্যাল ড্রেসে ফর্মালিটি করাটা যে কতোটা কষ্টের তা নিজে বোঝা যায় কিন্তু অন্যকে বোঝানো যায় না। আমরা এখন ভালো লাগা নয়, স্বপ্ন নয়, বাস্তবের পিছনে ছুটি, ভবিষ্যতের ভান্ডার পূর্ন করি। আর নিতান্ত আবেগ নিয়ে যারা ভাবেন, মুগ্ধ হওয়ার অবসর পান তাদের বসবাস ভিন্ন কোন জগতে, হয়ত পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে যার সাথে আমাদের মতো কেতাদুরস্ত মানুষদের বিস্তর ফারাক।।
মর্টগেজে জমা রাখা মূল্যহীন সম্পদ- মেঘ, বৃষ্টি, চন্দ্র, সূর্যের আবেদন আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিকভাবেই আজ শূণ্যের কোঠায়। আজ তবে কাব্য হোক, কাজল কালো চোখের নিচের স্বপ্নালু চাউনির নিরাসক্ততায় বদলে যাওয়ার কোন কাব্য। আজ তবে কাব্য হোক প্রানোচ্ছ্বল এক তরুনীর উচ্ছ্বলতা হারিয়ে যাবার কাব্য। সন্ধ্যা মিলানোর পর আকাশের শেষ অলোক ছটা যখন ক্ষীণ হয়ে যায়, অফিসের গাড়ি থেকে নেমেই প্রচন্ড ক্ষুধা পায় আমার, হয়ত আমার মতো আরো অনেকের পেটের মধ্যে মোচড় দেয় তীব্র ক্ষুধা। রাস্তার পাশেই নানা ধরনের খাবারের দোকান। মাঝে মাঝে কোন একটাতে ঢুকে যাই। কখনো কখনো সুন্দর কিছু দৃশ্য চোখে পড়ে, বাবা তার পুতুলের মতো মেয়েকে আইসক্রিম খাইয়ে, পরম যতনে রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে তার গোলাপী ঠোঁট, ভেতরের টেবিলে হাতে হাত রেখে প্রেমিক প্রেমিকার স্বপ্ন মাখা মায়ার চোখ, কোচিং ফাঁফি দেওয়া একদল ছেলেমেয়ের উল্লাসে হৈচৈ করার দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগে।
আজ তবে কাব্য হোক কিছু পার্থিব ভালোলাগার, স্নেহ আর ভালোবাসার। অন্যদিকে মন খারাপের দৃশ্যও পিছিয়ে থাকে না। পুরু কাঁচের চশমা টেবিলে রেখে, বিষাদগ্রস্ত চোখের কোন ছেলে এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকে পথের দিকে চেয়ে, হয়ত কারো প্রতীক্ষায়। রেস্তোঁরায় কোন ছেলের একা খাওয়ার দৃশ্য হয়ত জগতের সবচেয়ে মন খারাপের দৃশ্য । খাওয়ার সময় অন্তত কোন একজন মানুষের পাশে থাকা উচিত, যে কফিতে চুমুকের মাঝখানে হাত নাড়িয়ে চোখ বড়বড় করে গল্প শুরু করবে, ‘ তারপর কি হলো আজ শোনোই না! একা বসে খাওয়া মানুষের কাপ, পিরিচ, চামচের নিঃসঙ্গ টুং টাং শব্দে কোথায় যেন অনেকখানি হাহাকার মিশে থাকে, মধ্যরাতের বেহালার করুন সুরের মতো । প্রায়শই ইচ্ছে হয়, বিষন্ন চোখের ছেলেটার সামনে যেয়ে বসি, জিজ্ঞাসা করি, বিষন্নতার অতল কোথায়? যা ইচ্ছে হয় তা কি কখনো করা যায়? খাবার অর্ডার করে কোনের এক টেবিলে বসি, মাথার মধ্যে গুনগুন করে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় গানের কিছু লাইন “যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, নিরাশার পাখি দু হাত বাড়ায়, খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোণ, কি আর করে তখন…স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন…স্বপ্ন দেখে মন।” আজ কাব্য হতে পারে বুকের খুব গভীরে থাকা হৃৎপিন্ডের গায়ে প্রতিনিয়ত অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করে চলা প্রিয়জন হারানোর নিঃসীম শীতল বেদনারও ।
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশে অনেক টং দোকান পড়ে, খাবারের ভ্যান ও দেখা যায়। মাঝে মাঝে পেয়ারা মাখানো বা আম মাখানো কিনি। ফেরিওয়ালা মামা আন্তরিকভাবে ছোট্ট কৌটায় বেশ ঝাল ঝাল করে পেয়ারা মেখে প্যাকেটে করে হাতে তুলে দেন । তাই নিয়ে খেতে খেতে আবার হাঁটা ধরি বাসার উদ্দেশ্যে। খাওয়া শেষ করে টিস্যুতে হাত মুখ মুছে ফেলার পর খেয়াল হয় সন্ধ্যার অন্ধকারে খোলা রাস্তায় বেগানা মেয়ে মানুষের কোন কিছু খেতে নেই, নইলে ভূত – পেত্নীরা ঝামেলা করে….!
চুপকথার এ দিনে আজ তবে কাব্য হোক সেসব রুপকথার, যখন রাজপুত্র পঙ্খীরাজে করে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে ঘুমন্ত রাজকুমারীর পেলব ঠোঁটে চুমু খেয়ে তার শাপ ভাঙ্গাতে পারতো । বাড়ি ফেরার নতুন একটা পথ খুঁজে পেয়েছি সম্প্রতি । নির্জন, নিরিবিলি সরু একটা রাস্তা। ব্যস্ত, আপাদমস্তক বৈষয়িক অফিসের গাড়ি থেকে নেমে সে পথের নির্জনতা কেমন যেন অপার্থিব, অবাস্তব লাগে । বিহ্বলতা কাটে আশপাশের মানুষের চিৎকারে । এক রিকশাচালক আরেক রিকশাকে ওভারটেক করতে গিয়ে আরেকটু হলে আমাকে সহ তার পুরো রিকশাই ট্রাকের নিচে নিয়ে গিয়েছিলেন, ট্রাক ড্রাইভার একসিডেন্ট এড়াতে রাস্তা ছেড়ে অনেকখানি মাটিতে নেমে যাওয়ায় রক্ষা । রিকশাচালককে কিছু গালি আমি দিতেই পারতাম, হয়ত আশে পাশের লোক ডেকে মারও খাওয়াতে পারতাম, উচিতও ছিলো। কিন্তু মারা হয় না । তার ভীত চাউনি দেখে মায়া লাগে খানিকটা। মরতে তো একদিন হবেই ।
আজ তাই মৃত্যু নিয়েও কাব্য হোক । বড় রাস্তার বাঁকের শুরুতেই এলাকার মসজিদ – মাদ্রাসা । আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা এক মহিলা তার সন্তানকে মাদ্রাসার গেইটের বাইরের ফুটপাতে ছোট্ট একটা টিফিন বাটিতে করে কিছু এনে খাওয়াচ্ছেন, সন্তান মাদ্রাসায় পড়ে । পাঞ্জাবি, টুপি পড়া বাচ্চা ছেলেটা মায়ের গা ঘেঁষে বসা, মায়ের একটা হাত তার শীর্ণ পিঠের উপর, পরম মমতায় রাখা। গোধুলীর শেষ আলোর সকল কোমলতা সে হাতে । ঐটুকুন ছোট্ট বাটিতে কি এনেছেন মহিলা সন্তানের জন্যে? পিঠা, নাকি কোন ফল? ইচ্ছা হয় একটু উঁকি দিয়ে দেখি, লোভীর মতো একটু ভাগ চাই …… আজ পৃথিবীর সব নিরাশ্রয়ের জন্যে এক চিলতে আশ্রয়ের কাব্যও না হয় হলো।
এক সময় গন্তব্য ফুরোয় । আমি বাড়ি ফিরি, যাকে কোন দিক দিয়েই বাড়ি বলা যায় না, দু কামরার নোনা ধরা অন্ধকার একটা স্যাঁতস্যাঁতে ফ্ল্যাট। যেখান থেকে চাঁদ দেখা যায় না, বৃষ্টিতে ভেজা যায়না, উদাসী হাওয়ায় ভেসে যাওয়া যায়না, যেখান থেকে স্বপ্নকেও বড্ড ঝাপসা লাগে। কিশোরী বয়সের ফ্যান্টাসির মতো জ্যোছনা রাতের হিমু অথবা গৌতম বুদ্ধের মতো গৃহত্যাগী হওয়ার রোমান্টিক ইচ্ছের সময় বুঝি ফুরিয়েই এলো, এখন সময় কেবল কঠিন কঠোর বাস্তবতার। কল্পিত ভাবনার উপসংহার টেনে, নিশি যাপনের প্রস্তুতিতে আর কাব্য করা হয়না, বলা হয়না কোন গল্প, নিদ্রার গায়ে কাঁথা চাপিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় আরো একটা কর্মব্যস্ত দিনের…! দীর্ঘশ্বাসের মতো ক্রমশই ফুরিয়ে আসে গল্প কবিতার প্রহর। অদৃশ্যে মিলিয়ে যায় রঙ তুলিতে আঁকা স্বপ্নলোকের বাসর। অতীতের সেই কবেকার কোন ফেলে আসা বিগত বসন্তের ভালোবাসাবাসির দিনগুলো বুঝি আর কখনওই হাতছানি দেবেনা আমাদের…!