বহুদূরের যাত্রা

বহুদূরের যাত্রা

চুল ধরে জঘন্য ভাবে জামাল তার বউকে মেরেছে। বউয়ের অপরাধ খুব অল্প। ভাত সামান্য পুড়েছে বলেই এই শাস্তি। সরল-সোজা গ্রাম্য এই বধূ কান্নাকাটি করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে।

পড়ন্ত বিকেলের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পায়ে যাচ্ছে জামালের বউ। আশপাশ জনমানবহীন। একটা হাওরের রাস্তা দিয়েই তার বাপের বাড়ি যেতে হবে। পথিমধ্যে বৃদ্ধ হাসান মিয়ার সাথে দেখা। হাসান মিয়া বললো, “ও বউ এই অসময়ে যাও কই? দিনটাও ভালো দেখছি না ঝড় নামলো বলে” “চাচাজান বাপের বাড়ি যাই। অভাগীর মরণ যদি পথেও হইত তাও ভালো হইতো ” বলেই কান্না শুরু করে দেয় জামালের বউ। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি ফেরায় হাসান মিয়া। অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে জামাল। সামনে হাসান মিয়াসহ আরো কজন মুরব্বি। জামাল কোমল সুরে বলে,” আর করুম না চাচা। ভুল হইছে মাফ দেন। ”

গলা খাকারি দিয়ে হাসান মিয়া বলে “জামাল বউ মানে দাসী না। সে তোমার বান্দি না। তোমার যেমন অধিকার আছে তারও অধিকার আছে। সামান্য ভুল ত্রুটি নিয়ে ঘাটতে গেলে সংসার করা যায় না। দুজন মানুষ মিলে একজন চিন্তা না করলে চলে না সংসার। কেউ ভুল করলে আরেকজন সে ভুলটা ভাঙায়া দিবা। তোমাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক পৃথিবীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মনে রাখবা বউ শুধু ভোগের জিনিস না তার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাও তোমার অবশ্য-কর্তব্য।”

জামাল মিয়া অপরাধ স্বীকার করে বলে “চাচা এমন আর করুম না। এবারের মত মাফ দেন।” পাশের মুরব্বিরা বলে,” মাফ দিলাম এইবার। তবে ফের এমন করলে এলাকায় তোমার থাকা না থাকা নিয়া বিহিত ওইব।” এসময় হাসান মিয়ার প্রতিবেশী এক নাতি এসে ডাক দেয় “দাদা দাদা পোলাপান আবার আইছে, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।” বৃদ্ধ হাসান মিয়া মোটামুটি দৌড় দিয়ে তার নিজের বাড়ির দিকে এগোয়। গলা ছেড়ে চিল্লান দেয় হাসান মিয়া “দাঁড়া শয়তানের দল দাঁড়া। তোদের একদিন কি আজকে আমার একদিন।”
বালকের ছোট্ট দলটা হাসান মিয়ার চিৎকার শুনে দৌড়ে পালায়।

হাসান মিয়া এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ফুলগুলো ছিঁড়তে পারেনি। পাখির বাসাগুলোও আগের মতই আছে।
খানিকবাদে আকাশ কালো কুচকুচে হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়। একটা বড় গাছের নিচে এসে হাসান মিয়া দাঁড়ায়। এলাকার পোলাপান গুলোর জন্য ফুলগুলো রাখা যায়না, ঘুঘুর দুইটা বাসা এগুলাও রাখা যায়না। বহু যত্নে লালন করে এই জিনিসগুলো হাসান মিয়া। রাঙা বউটা হাসান মিয়ার ঘরে যখন এসেছিল, একমাস যেতে না যেতেই আবদার করতো “আফনে ফুলের বাগান করতে পারেন না। আমার না ফুল খুব ভালো লাগে। আপনি পাখির বাসা পছন্দ করেন? আমার খুব ইচ্ছা হয় পাখির বাসা দেখতে। যদি থাকতো আমাদের বাড়িতে। ” হাসান মিয়া তখন থেকেই বাগান করার চেষ্টা করত কিন্তু কোনভাবেই ফুলের গাছ গুলো টিকতো না। পাখির কোন বাসাও তখন তার বাড়ির আশেপাশে বাধতো না।

দুনিয়ার কিছু নিয়ম খুবই অদ্ভুত। রাঙা বউ থাকাকালীন সেসব কিছুই হয় নাই অথচ যখন সেই পল্লীবধূটি মাত্র দু মাসের সংসার করে মারা গিয়েছিল এরপর থেকেই ফুলের বাগানটা কেমন যেন তাজা হয়ে উঠেছিল। তখন থেকে পাখিরাও বাসা বাঁধতে শুরু করলো হাসান মিয়ার বিশাল বাড়ির আঙ্গিনার এই গাছগুলোর মধ্যে। হাসান মিয়া ভাবে এগুলা হয়তো তার সেই রাঙা বধূ জুলেখা কোন না কোন ভাবে দেখতে পায় আজও। তাইতো ষাটোর্ধ্ব এই লোক কত যত্ন করে সেসব আগলে রাখে। অদ্ভুত এই হাসান মিয়া ভাবে জুলেখার প্রতি যে ভালোবাসা তার ছিল সেটা আর কারো প্রতি সে দিতে পারবেনা আর এজন্যই এই বিশাল শূন্যতার মাঝে নতুন কাউকে নিয়ে সুখী হওয়ার পরিকল্পনা তার মাথায় আসেনি।

রাতের আঁধার খুব তাড়াহুড়া করে নেমেছে এই বিশাল বাড়ির সবটা জুড়ে। পাখিরাও ফিরে এসেছে নিজ নিজ বাসায়। শুন্য বিশাল বাড়িতে আলো জ্বালিয়ে দেয় হাসান মিয়া। বারান্দায় গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরের পশ্চিমাকাশের লালিমার উপরে দৃষ্টি রাখে হাসান মিয়া। মনে হয় আজও সেই দূর আকাশের মেঘের ভেলার পেছনে সেই রাঙাবধূটি মিষ্টিমুখ মুখে তাকিয়ে আছে হাসান মিয়ার দিকে। সেই লজ্জা মাখা সুরের আবদারগুলো, সেই মিষ্টি হাসিটা আজও কানে বাজে হাসান মিয়ার। খুব সতর্কতার সাথে নিজের চোখের অশ্রু মুছে নেয় এই প্রাপ্তবয়স্ক লোকটি। মানুষ দেখলে বড্ড হাসবে।

ধীরে ধীরে রাতের আগমন ঘটে। শূন্যতাতে আগুন দেওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় আঁধারের গহীনে। হাসান মিয়া ভোরের অপেক্ষায় জেগে থাকে, “কখন ভোর হবে?

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত