পোষা জানোয়ার

পোষা জানোয়ার
আমাদের এক চেনা বাড়িতে মানু আর পানু বলে দুই ভাই, তাদের মা-বাবার সঙ্গে থাকত।
এক বাদলা দিনে মানু পানু দেখে দুটো খুদে খুদে কুকুরছানাকে কে যেন ওদের বাড়ির সামনে, পথের ধারে ফেলে দিয়ে গেছে।
সবে চোখ ফুটেছে, কুৎকুৎ করে চাইছে। কাদা মেখে, এ ওর গায়ে উঠছে, পড়ছে; কুঁইকুঁই করে কাঁদছে। তাই দেখে ছেলেদের বড় মায়া হল। ওরা ওদের কাদা থেকে তুলে, বুকে করে, বাড়ি নিয়ে এল। সদর দরজা দিয়ে নয়। খিড়কি দোর দিয়ে ঢুকে, আগে রান্নাঘরে গিয়ে, রঘুয়ার কাছ থেকে গরম জল নিয়ে, কুকুরছানা ধুয়ে, বাসন-মোছা ন্যাকড়া দিয়ে মুছিয়ে, শুকিয়ে নিল। রঘুয়া একটা তোবড়ানো বাসনে একটু গরম দুধও দিল। ছোট ছোট লাল জিব দিয়ে ওরা কতক খেল, কতক গায়ে মাখল, কতক মাটিতে ফেলল, আবার চেটেও নিল।
তাই দেখে ঘরের সকলে ওদের কত আদর করল। ওরাও সকলের মুখ চেটে দিল।
এমন সময় মা এসে ঘরে ঢুকলেন। ছানা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল!
“এ মা! নেড়ি কুকুরের ছানা আবার কে ঘরে ঢোকাল! তোদের বাবা দেখলে রেগে যাবেন।”
ঠিক এই সময় ছানা দুটো এগিয়ে এসে, মায়ের পা চাটতে লাগল! মা তো গলে জল। দুটোকে দু হাতে তুলে নিয়ে, বাবাকে দেখাতে চললেন।
গোড়ায় বাবা লাফিয়ে উঠেছিলেন!–“এ রাম! ছি ছি! নেড়ি কুকুরের ছানা ঘরে ঢোকাতে নেই। কুকুর চাও তো বাসুকে বলি। তার কেনেল থেকে ভালো জাতের কুকুর দেবে।”
মা বললেন, “পথে ফেলে দিলে এতটুকু ছানা কখনো বাঁচে?”
বাবা বললেন, “তবে রাখো। দেখো যেন বসবার ঘরে শোবার-ঘরে না ঢোকে।”
এই বলে কাগজ পড়তে লাগলেন। একটু আদরও করলেন না।
ছানা দুটো থেকে গেল। একটা কালোর ওপর সাদা ফুটকি। তার নাম কেলো। একটার সাদার ওপর কালো ফুটকি। তার নাম ধেলো।

তারা সারাদিন গলিতে দৌড়াদৌড়ি করে। যা দেওয়া যায়, চেটেপুটে খায়। বাড়ির লোক দেখলে নেচে-কুঁদে সারা। বাইরের লোক এলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত। সারা রাত চটের ওপর শুয়ে, রান্নাঘরের বারান্দায় একটানা ঘুম। তবে এতটুকু আওয়াজ পেলেই সাড়া দেয়। বেশ চলেছিল মাস দুই।

তারপর একদিন বাসুকাকু এসে বললেন, “ওরে মানু পানু তোদের জন্য খাস আএক বিলিতি কুকুরের ছানা এনেছি। তাকে একবার দেখলে আর ঐ নেড়িয়েলের ছানার দিকে ফিরেও তাকাবি না। ও-দুটোকে তাড়িয়ে দে। তাহলে সেটাকে দিয়ে যাই।
বাবা কিছু বললেন না।
মানু বলল, “তাড়ালেও যাবে না। আবার ফিরে আসবে।”
বাসুকাকা রেগে গেলেন, “খেতে না দিলে, আর এলেই লাঠিপেটা করে ভাগালে, কেমন না যায় দেখে যাবে।”
বাবা তবু কিছু বললেন না। মানু পানু ঘর থেকে চলে গেল।
রান্নাঘরের রোয়াকে, কুকুর কোলে দুজনে বসল।
মানু বলল, “তোর কত টাকা আছে রে?”
পানু বলল, “কেন, পাঁচ টাকা। তোর কত?”
মানু বলল, “আমারও তাই।”
পানু বলল, “দশ টাকা তো অনেক টাকা। চল্‌ আমরা কেলো-ধেলোকে নিয়ে পালাই।”
মানু বলল, “যত দূরে পারি। এক্ষুনি।”
পানু বলল, “তাই চল। টাকাগুলো নেব। দুটো গামছা আর ওদের গলায় বাঁধার দড়ি আর দুটো বেঁটে লাঠিও নেব। আমরা খেটে খাব, গাছতলায় শোব। ওদের আমাদের খাবারের ভাগ দেব। চল্‌।”
যেমন কথা তেমনি কাজ।
দেখতে দেখতে শহর ছেড়ে ধানক্ষেত। ধানক্ষেতের পর আম বন। সেহানে গেলে চাকরি পাবে না। তাছাড়া, বাঘ থাকলে কেলো-ধেলোকে খেয়ে নিতে পারে। পথে পথে চলাই ভালো।
এদিকে কুকুরছানারা আর হাঁটতে চায় না। একটু দূর যায়, আবার বসে পড়ে। কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়। হাত ব্যথা করে। শেষটা কেলো-ধেলোকে গামছায় বেঁধে, পুঁটলির মতো পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটতে হল।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে, রোদ পড়ে এল। পায়ে ব্যথা করতে লাগল। কেলো-ধেলোর ওজন বাড়তে লাগল। সূর্য ডুবে গেল। আর তো পারা যায় না। তখন একটা গাছে ঠেস দিয়ে বুসে পড়ে দুজনে একটু কেঁদে নিল। তারপর ঘুমিয়েও পড়ল। পোঁটলা-বাঁধা কেলো-ধেলোকে কোলে নিয়ে। তারাও ঘুমিয়ে কাদা।
হঠাৎ চোখে-মুখে আলো পড়ল। হইচই শোনা গেল। কেলো-ধেলো পুঁটলির ভিতর থেকে মহা ডাকাডাকি শুরু করল।
কে যেন চেঁচাতে লাগল, “পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! আর ভয় নেই!”
একটা গাড়ির হেডলাইটে চারদিক আলোয় আলো। গাড়ির দরজা  খুলে মা-বাবা নেমে, ছুটে এসে, কুকুরছানা আর ছেলেদুটোকে জড়িয়ে ধরলেন।
আরো কারা যেন ভিড় করেছিল। ঘুমের ঘোরে ততটা মালুম ছিল না। মা-বাবা ওদের কুকুর-কোলেই গাড়িতে তুলে, বাড়িমুখো চললেন।
ঘুমঘুম সুরে মানু বলল, “কেলো-ধেলোকে খেতে দেবে?”
মা বললেন, “না তো কী শুকিয়ে রাখব?”
“মেরে তাড়িয়ে দেবে না?”
বাবা হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে বললেন, “কেন দেব? আমাদের কি দয়া-মায়া নেই?–উঃ! গিছি! গিছি! গিছি!”
আসলে কিছুই হয়নি। বাবার কানটা মুখের কাছে পেয়ে, কুট করে কেলো একটু কামড়ে দিয়েছিল।
সে যাই হোক। এখন ওদের বাড়ি গিয়ে দেখে এসো। কেলো-ধেলো বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের খাটের পাশে নতুন চটের উপর ঘুমোয়। ওদের চেন কলার কেনা হয়েছে। তাই পরিয়ে, হাতে একটা বেঁটে লাঠি নিয়ে, বাবা নিজে ওদের রোজ দু বেলা হাঁটান।।
গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত