মা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘শতবর্ষজীবী হও।’ মায়ের সেই আশীর্বাদটা স্রষ্টা কবুল করেছিলেন। আবিদের বয়স এখন একশ বছর। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। নিজের কাজ গুলিও ঠিক মত করতে পারে না। উঠতে বসতে তাকে অন্য কারোর সাহায্য নিতে হয়। চোখ মেলে তাকিয়ে তিনি দেখলেন তার ঘর ভর্তি মানুষ। তার দুই ছেলে বউ মাথায় ঘোমটা দিয়ে তার পাশে বসে আছে। তিনি শ্লেষ জড়ানো গলায় জানতে চাইলেন
-বাড়িতে এত মানুষ কেন বউমা? তাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে যেন একটু মনঃক্ষুণ্ণই মনে হলো দুইজনকে।
-বাবা, আপনি ঠিক আছেন?
-আমার আবার কি হবে?
-না মানে কালকে রাতে আপনার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তাই ভাবলাম আবিদ হেসে বলল
-তাই ভাবলে বুড়োটা বুঝি এবার সত্যি সত্যিই পটল তুললো।
-ছি: বাবা এসব কি বলেন! একে একে সবাই বিদায় নিচ্ছে। একজন যাওয়ার আগে বলল
-বুড়োটা কি অমর গোটা খেয়ে এসেছে নাকি। বাপরে বাপ। আমরা তো ভাবলাম এইবার বুঝি আসলেই মারা যাবে।
-নাতিনের ঘরে পুতিন হলো তবুও মরার নাম নেই।
আবছা আবছা ভাবে পাশের ঘর থেকে এই কথা গুলি ভেসে আসছে। যদিও আবিদ কানে এখন আগের মত শুনতে পারে না। তাই এই কথা গুলিও শুনতে পেলো না। কিন্তু আবিদ বুঝতে পারলো ও মারা গেলে হয়ত ভালোই হতো। আবিদ তার বড় বৌমাকে ডেকে তার ছেলেদের কথা জানতে চাইলো।
-অরুন আর মহিন কোথায় বউমা?
-বাবা, উনারা তো এখন অতিথিদের নিয়ে একটু ব্যস্ত আছেন। আমি কি ডেকে দিবো?
-না থাক।
-আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
-একটু পাশে বসো বউমা। আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
-আমি হাতের কাজ টা সেরে এসে আপনার পাশে বসছি বাবা।
এই বলে বড় বউ চলে গেলো। আবিদ জানে তার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। ঘরের কাজ সব কাজের লোকেরাই করে। তবুও সে চলে যাবে। বুড়ো মানুষদের সাথে কি নিয়েই বা কথা বলা যায়। বড় বউ আর আসবে না তার সামনে।
আবিদের খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার সাথে কথা বলার কোনো মানুষ নেই। তাই মাঝে মাঝেই তার মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে ছবির সাথেই কথা বলেন। তার কিছু কিছু কথা হয় এরকম
-তুমি ভালো আছো তো? বেঁচে থাকা অবস্থায় তোমাকে খুব একটা সময় দেয়া হয় নি। কাজ নিয়েই সারাক্ষণ পরে থাকতাম। ছেলের স্কুলের ফিস, নতুন জামাকাপড়, জুতো কিনতে হবে। মাথার মধ্যে শুধু এগুলোই থাকতো। এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়। তোমার কি এখন একটু সময় হবে আমাকে দেয়ার জন্য? ছবি কথা বলে না। কিন্তু আবিদের মনে হয় এই প্রাণহীন সাদাকালো ছবিটা একদিন যদি কথা বলে উঠে তবে মন্দ হতো না।
লাঠিতে ভর দিয়ে আবিদ বিছানা থেকে নামলো। আজকে আর কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করলো না তার। তিনি মারা যাবেন ভেবে এমনিতেই বউদের কান্না কাটি করে বেহাল অবস্থা। যদিও সেটা লোক দেখানো। অনেক দিন জানালার সামনে দাঁড়ান না। বাইরে যে এক বিশাল দুনিয়া আছে সেটা তো তিনি ভুলেই গিয়েছেন প্রায়। কিন্তু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যেটা দেখলেন সেটা দেখে হাত থেকে লাঠি টা পড়ে গেলো। তিনি শক্ত করে জানালার শিক ধরে রইলেন। তার বাড়ির সামনে খুব সুন্দর কারুকার্য করা একটা খাটিয়া রাখা। সামনে তার দুই ছেলে। খাটিয়া নিয়ে আসা লোকটাকে খুব রাগান্বিত মনে হচ্ছে। অনেকটা চেঁচিয়েই বলে উঠলো
-বাপ মইরা যাওনের আগেই খাটিয়া খবর দিছেন। কেমন সন্তান আপনারা??
ছেলে দুইটা অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আবিদের চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আর মনে মনে বলল ‘আমার মা আমাকে শতবর্ষজীবী হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করেছিলো। তবে সেটা হয়ত আশীর্বাদ না অভিশাপ ছিল। মা আমাকে শতবর্ষজীবী হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলো। তোদের কে আমি সেই অভিশাপ দিবো না।’