করোনা

করোনা

আমি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘরের মধ্যে ফিসফিস করে কথার আওয়াজ শুনতে পাই।ঘরের মধ্যে আমার শ্বাশুড়ি মা আমার স্বামী রিয়াদকে বলছে, বৌমা যে হাঁচি কাশি দিচ্ছে তুই দেখছিস না? রিয়াদ পাত্তা দিল না।বললো দেখছি তো,ঠান্ডা লেগেছে হয়তো। তুই এখনো বোকাই রয়ে গেলি।চারিদিকে করোনা দেখছিস না? যদি করোনা হয়।তুই সাবধানে থাকিস বাবা। সামান্য একটু ঠান্ডা লেগেছে এ নিয়ে এত উতলা হয়ো নাতো মা।তুমি সবসময় বেশি বেশি ভাব।দেখছো তো জীনাত সব কাজকর্ম করছে।ঠিক মত খাচ্ছে। কোন সমস্যা নেই। তুইতো কোনদিন আমার কোন কথা শুনলি না।সাবধানে থাকিস।বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল মা।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানালাম। টেবিল গুছিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলাম। কিন্তু শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনের মধ্যে ভয় ধরে গেছে। ভাবছি সত্যিই আমার করোনা হয়নি তো।সারাদিন সব কাজ ঠিক মত করলেও মনের মধ্যে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এমনিতেই শ্বাশুড়ি সারাদিন দোষ খুজতে ব্যস্ত থাকে। তারপর যদি করোনা হয় তাহলে কী যে করবে আল্লাহই জানে।অথচ উনিই আমাকে পছন্দ করে ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছেন। তখন কত ভালো ভালো কথা শুনিয়েছেন। আমি নাকি তার মেয়ের মতো থাকব।সে আর কয়দিন বাঁচবে তারপর তো সব আমারই হবে। এইসব কত কথা। বিয়ের পরও একমাস ভালোই ছিলাম। এরপরই শুরু হলো দোষ ধরা। কেন যে এমন করছে বুঝতে পারছি না। রিয়াদ আমাকে নিয়ে একটু হাসি ঠাট্টা করলে, একটু কোথাও ঘুরতে নিয়ে গেলে বা কিছু কিনে দিলে দেখা যায় মুখটা কালো হয়ে গেছে। তখন মুখে কিছু বলে না কিন্তু এই ব্যাপারগুলো পছন্দ করছে না এটুকু বুঝতে পারি।

আজ দুপুরের পর শরীরটাও খুব ব্যথা ব্যথা করছে। শ্বাশুড়ির কথা শোনার পর ভয়ে রিয়াদকেও কিছু বললাম না।তবে রিয়াদও মনে হয় একটু সন্দেহ করছে। মুখে কিছু বলছে না তবে রাতে একটু দূরত্ব নিয়েই শুয়েছে। আমিও শরীরটা ভালো লাগছে না বলে কিছু বলছি না। রাতে আমার জ্বর আসলো সাথে মাথাব্যথা। রাত তিনটার সময় উঠে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে পানি নিলাম। এরপর একটা নাপা খেলাম।নাপা বাসায়ই ছিল। এর কিছুক্ষণ পর জ্বরটা একটু কমে আসলে আমি একটু আরাম বোধ করলাম। সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল আটটা বেজে গেল। আমি উঠছি না দেখে রিয়াদ আমাকে ডাকলো।বললো, উঠছো না কেন?নাস্তা বানাবে না?মা, না খেয়ে আছে।

দেশে এখন লকডাউন চলছে তাই সবাই একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। আমি লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে দেখি খুব দুর্বল লাগছে। তবুও উঠলাম। রিয়াদকে বুঝতে দিলাম না যে রাতে জ্বর এসেছিল। নাস্তা বানালাম। সবাই মিলে নাস্তা খেলাম।দুপুরের রান্নার যোগাড় করতে গিয়ে দেখি আমি আর পারছি না। খুব শীত করছে। শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। রিয়াদ বললো, তোমার কি জ্বর আসছে? হ্যা। একটা নাপা খাও। রাতে একটা খেয়েছি। আবার একটু পরে খাব।একটু শুয়ে থাকি। রিয়াদ গিয়ে শ্বাশুড়িকে বলতেই সে চেচিয়ে উঠলো। তোকে বললেতো কোন কথাই শুনিসনা।যদি করোনা হয় তবে তো ঘরের সবার হবে। তখন কি করবি?আমাকে মেরে ফেলতে চাস।

রিয়াদ আমাদের রুমে ঢুকে আমাকে আস্তে করে বললো, শোন জীনাত, তুমি মনে কষ্ট পেও না। মায়ের যা বয়স মায়ের যদি করোনা হয় তাহলে কি তাকে বাঁচানো যাবে? যদি তোমার করোনা হয় তো তোমাকে আলাদা থাকতে হবে। তোমার সবকিছু মাকে করে দিতে হবে। তার চেয়ে তুমি যদি তোমার বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে তাহলেই মনে হয় ভালো হতো। আমি রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোথায় আমাকে চিকিৎসা করতে নিয়ে যাবে তা না বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে চাইছে। ভাবলাম এ বাড়িতে আসছি বেশি দিন না।তাই হয়তো কেউ আপন ভাবতে পারছে না।
রিয়াদকে বললাম, ঠিক আছে আমি চলে যাব।

শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ির দূরত্ব বেশি না।দুই তিন কিলোমিটার হবে। রিয়াদ আমাকে একটা অটোরিকশা করে দিল।শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি ভাইয়াকে একটা ফোন দিয়েছিলাম। বললাম ভাইয়া আমার জ্বর।শ্বাশুড়ি বললো, কয়েক দিন তোমাদের কাছে থাকতে। আমি আসছি।ভাইয়া চুপ করে রইল। আমি লাইনটা কেটে দিয়ে রওয়ানা দিলাম। অটো করে বাবার বাড়ির দিকে যাচ্ছি। জ্বরে শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে পড়ে যাব।তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছি। বাসার কাছে পৌছলাম। গলির মুখে নেমে কিছুদূর আগাতেই ভাবি এসে সামনে দাঁড়ায় একটু দূরে।

দূরে থেকেই বললো,শোন জীনাত এরকম জ্বর নিয়ে তোমার ও বাড়ি থেকে বের হওয়া উচিত হয়নি।তাছাড়া তোমার যদি করোনা হয়ে থাকে তাহলে তো বুঝতেই পারছো বাসায় আমরা আছি বাচ্চারা আছে। তাছাড়া আমাদের আলাদা কোন রুম বা ঘর নেই। তোমাকে কিভাবে রাখবো বলো।এ অবস্থায় তোমার এ বাড়িতে থাকা চলবে না।তুমি বরং শ্বশুর বাড়ি ই চলে যাও। একথা বলে ভাবি বাসার মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

আমি দাঁড়িয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। ব্যগ নিয়ে রাস্তায় উঠে কিছু দূর হাঁটলাম। আর হাঁটতে পারছি না। রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে বসে পড়েছি। কাঁদতে চাইছি না কিন্তু চোখ থেকে পানি ঝরে যাচ্ছে সমানে। রাস্তায় লোকজন নাই। দূরে দূরে দু’একটা দোকান খোলা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু লোক জড়ো হলো আমার চারপাশে তবে বেশ দূরে। নানা প্রশ্ন করছে। আমি বললাম, আমার জ্বর। আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? কেউ এগিয়ে এলো না। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে আমার কান্না দেখতে লাগলো আর নানা ধরনের কথা বলতে লাগলো। কেউ বলছে করোনা মনে হয় কাছে যাইস না,ইত্যাদি। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম। কতক্ষণ চলে গেছে জানি না। হঠাৎ শুনি লোকজন বলছে চেয়ারম্যান সাব আইছে। দূরে সর।এরপর সে আমাকে ডাকলোএই মেয়ে তোমার নাম কি? আমি চোখ খুলে বললাম, জীনাত।তোমার কি হয়েছে? আমার জ্বর। তা এখানে পড়ে আছো কেন?তুমি কোথায় থাকো?তোমার কি বিয়ে হয়েছে? হ্যা শ্বশুর বাড়ি থাকি। তা এখানে কিভাবে এলে?

আমার জ্বর তাই বাবার বাড়ি পাঠিয়েছিল কিন্তু তারাও রাখল না।আপনি আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?
আহারে, কেউ জায়গা দিল না। আচ্ছা তুমি কোন চিন্তা কোর না। তোমাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করছি।
এরপর তিনি ফোন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা এম্বুলেন্স আসলো।আমাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। সেখানে ঔষধ দেয়ার পর একটু ভালো বোধ করলাম। হাসপাতালে দুই দিন ছিলাম। এখানে করোনা টেস্টের জন্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি একটু সুস্থ বোধ করায় আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল।আমি তাদের বললাম আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই আমি কোথায় যাবো? নার্স বললো, আমরা কিভাবে বলবো? আমি বললাম, আপা আপনি একটু চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন দেন দেখি সে কি বলে। তারা ফোন করলো।চেয়ারম্যান সাহেব আসলো। এসে বললো, তুমি তো ভালো ই আছো,কোথায় যাবে এখন? বাবার বাড়ি না শ্বশুর বাড়ি? আমি বললাম, তারা তো কেউ রাখবে না গিয়ে কি করবো?

কিছু সময় ভাবলো সে,তারপর বললো ঠিক আছে তুমি আমার বাড়িতে চলো।ওখানে তোমাকে আলাদা থাকতে দেব টেস্টের রিপোর্ট আসুক তারপর দেখা যাবে কি করব। আমি চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলাম। পরের দিন রিপোর্ট আসলো করোনা নেগেটিভ। চেয়ারম্যান এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার তো করোনা হয়নি।এখন তো তুমি শ্বশুর বাড়ি যেতে পার।আমি চুপ করে রইলাম। এরমধ্যেই কয়েকজন সাংবাদিক আসলো।চেয়ারম্যান সাহেব বাইরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে লাগলো। আমি ঘর থেকে শুনতে পেলাম সে বলছে, আসলে মেয়েটি করোনায় আক্রান্ত হয়নি।একটু সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তাই আমি থাকতে দিয়েছি। ভুল ভাঙলে আবার সে চলে যাবে। আমি ঘরে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি। কার কবে ভুল ভাঙবে আর আমি কার কাছে আশ্রয় পাব।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত