জীবনের পরাজয়

জীবনের পরাজয়

“মৃত্যু যেন আমার থেকে ফিরিয়ে নিয়েছে মুখ
পথে ঘাটে হুমরে পরি পাইনা কোন দুখ
জীবনের এই জীর্ণ পথে চলছি আমি এক পরাজিত সৈনিক”
সময়টা এখন ফাগুন মাস। রাস্তার দুপাশে দানবাকার গাম্ভরী গাছ। ঝরে পরেছে তাদের শুকনো পাতা। বসন্তের এই রোদে শুকিয়ে হয়েছে খাঁ। ছেড়া জুতোর পারা পরতেই খসর মসর শব্দ হয়ে গেল আরম্ভ। চলছি একা। সামনে একটা চায়ের দোকান পরবে। রহিম চাচা সেই থেকে এখাটায় চা বিক্রি করে। ছোট বেলায় বাবার সাথে আসতাম । না আজ আমি এখানে চা খাব না। দোকানটার পাশ দিয়ে চলে যাব। চাচাকে একবার জিজ্ঞেস করব, “চাচা কেমন চলছে?” চাচা তার কালো দাঁত গুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে বলবে, “এই তো বাবা চলছে। দোয়া করি আজকে যেন সফল হও।” আমি চলে যাব মাথাটা একটু নাড়িয়ে। সৃত্মিতে আসবে সেই দিন গুলি। সেই সময়টায় বাবার কনিষ্ট আঙ্গুলটা ধরে রোজ সকালে আসতাম। বাবা চা বিস্কুট নিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে জেদ চেপে বসতাম আমাকে এটা নিয়ে দিতে হবে। ওটা নিয়ে দিতে হবে। বাবার কাছে টাকা না থাকলেও আমাকে নিয়ে দিতেন। সবাই বাবাকে বলত, “আজিজ ছেলেকে এত মাথায় তুলো না।” বাবা হেসে বলতেন, “এই আমার মানিক রতন রাজার মুকট আমার। মুকুটকে সব সময় মাথায় রাখতে হয়।” সবাই হাসতো। বাবাও হাসতো। আমি সবাইকে জিহ্বা দেখিয়ে ভেংচি কাটতাম। বাসায় গিয়ে মায়ের কোলের মধ্যে বসে থাকতাম। আমাকে কোলে চাপিয়েই মা রান্না করত। সবার কাছে শুনতাম আমি নাকি ঘর আলো করে এসেছিলাম। আমার জন্মের দিন বাবার চাকুরি হয়েছিল। বাবা এলাকার একটা হাই-স্কুলের কেরানি। আমি হলাম ভাই বোনের মধ্যে মেঝো। আর পরিবারের এক মাত্র ছেলে হওয়ায় চারিদিকের আদর পেতাম। আপু আদর করত। ছোট বোনটা এসে জড়িয়ে ধরে বলত ভাইয়া আমাকে পুতুল এনে দিবি? মুখে ইয়া বড় একটা হাসি ফুটিয়ে বলতাম, “হুম এনে দিব। আগে আমি বড় হই।” বাবা আমাকে প্রায়সই জিজ্ঞেস করত বড় হয়ে কি হব। আমি বলতাম, আমি পুলিশ হব। ছুটে গিয়ে সব অপরাধীকে ধরব। আবার বলতাম ডাক্তার হব। কখনও আবার বলতাম ইন্জিনিয়ার হব। বাবা আমার কথা শুনে হাসতো। বলতো, “বাবা জীবনে বড় হতে হলে একটা হতে হয়।” বাবাকে বলতাম, “কিন্তু সিনেমায় তো দেখি একজনই সব হয়। তাহলে আমি কেন পারব না?” বাবা আমার কথা শুনে বলত, “বাবা সিনেমায় সব হয় কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।” অবাক হয়ে বলতাম, “বাবা বাস্তব এটা কেমন? কোথায় দেখা যায়?” বাবা হেসে বলত, “বড় হলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে বাবা। তুমি তো এখন ছোট তাই বুঝবে না। আগে বড় হও তখন আমাকে বলতে হবে না।” লাফিয়ে চেয়ারের উপর দাড়িয়ে বলতাম, “এই দেখো বাবা আমি বড় হয়ে গেছি। কই বুঝতে পারছি না তো?” বাবা আমার কান্ড দেখে হাসতো। আর বলত, “চল মা খেতে ডাকছে। এখন খাও বড় হতে হবে না।” বাবার সাথে খেতে যেতাম। কিন্তু তখন না বুঝতে পারলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারি। আসলেই বাস্তবতা কি। ধীরে ধীরে যখন বড় হতে লাগলাম একটু একটু করে সব যেন পরিবর্তন হতে লাগল। স্কুলে বাবা ভর্তি করিয়ে দিল আমাকে। গ্রামের এক প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। স্কুলটার পরিবেশটা ভাল ছিল না। স্যারেরা যেন স্কুলটাকে নিজেদের শয়ন কক্ষ ভাবত। যখনই অফিসের দিকে যেতাম তখনই দেখতাম কেউ ঘুমিয়ে আছে আবার কেউ কেউ খোস গল্পে ব্যস্ত। কে কোন মামাতো ভাইয়ের চাচাতো শশুড়ের ছেলের বিয়েতে গেছে। বউটা কত সুন্দর। কিন্তু ব্যবহারটা খুব খারাপ এই সব নিয়েই থাকত। বাবা সব দেখতো। কিন্তু তিনি নিরুপায়। আমাকে কোন কিন্টার্গাডেন স্কুলে পড়ানোর তার সামর্থ নেই। যতটা সম্ভব আমাকে বাসায় নিজেই পড়াতেন। প্রাথমিক শিক্ষা এভাবেই শেষ হয়েছিল আমার। বাবাকে আমাকে তার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় আপুর সাথে একই স্কুলে পড়তাম। একসাথেই যেতাম। কিন্তু আপুকে এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলেরা উত্যক্ত করত। ভীষণ রাগ হত আমার। ইচ্ছে করত ধরে ইচ্ছা মত উত্তম মাধ্যম কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু তা আর হয়নি। বাবাকে বলাতে বাবা বলেছিল, “খবরদার কিছু বলবে না। না হলে গ্রামে চলা ফেরা দায় হয়ে যাবে।” বাবার কথার মানে কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু পরদিন যখন ওরা আপুকে খারাপ কথা বলছিল সেদিন খুব রাগ হয়েছিল আমার। রাস্তা থেকে একটা ইটের টুকরা নিয়ে ঢিল মেরে ছেলেটার কপাল ফাটিয়ে দিয়ে ছিলাম। ফল সরুপ আমার নামে বিচার বসল। বাবাকে নানা কথা শোনালো। ঘরে একটা গুন্ডা মানুষ করতেছে। বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিল সেদিন। আমাকে প্রথম বারের মত গায়ে হাত তুলেছিল। কিন্তু আমাকে লাগেনি। লেগেছিল বাবাকেই। বুঝেছিলাম টাকাই সব কিছু।
কিছুদিন পর…আপু হঠাৎ করেই আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল। চোখে পানি। কিছু না বলে কিছূক্ষণ আমিও চুপ থাকলাম। আপুকে কিছু বলতে যাবো তখনই আপু বলল, “আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে রে ভাই। আমি আর তোকে আদর করতে পারবো না।” কিছু বলতে পারিনী সেদিন। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আপুর নবম শ্রেণী পড়া অবস্থাতেই। সব কিছু ভালই ছিল। কিন্তু সুখ যে সবার কপালে শয় না। বিয়ের পরের বছর আপু অন্তসত্মা। আমার জীবনের সব চেয়ে খুশির দিনটা মনে হয় সেদিন ছিল যেদিন শুনেছিলাম আমি মামা হব। বাবা সেদিন খুব আনন্দিত হয়েছিল। তারপর আর বাবার এমন হাসি মাখা মুখটা দেখিনী। কিন্তু এত আনন্দ শেষ করে দিয়ে আপু আমাদের ছেড়ে চলে গেল। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করায় আপু চলে গেল না ফেরার দেশে।
ম্যাট্রিক পাস করলাম। খুব একটা আহা মরি রেজাল্ট করতে পারিনি। শহরের কলেজে ভর্তি হলাম। তখন একটু বড় হলাম। সব কিছু আরও পরিবর্তন হয়ে গেল। বাবা টাকা পাঠাতে খুব কষ্ট করত। মাথার উপরে বিয়ের উপযুক্ত আর একটা বোন। ইন্টার পাস করার পর ডিগ্রতে ভর্তি হলাম। তখন চাকরির খোজ শুরু করলাম। এখনও খুজেই যাচ্ছি। কিন্তু পাইনি সেই সোনার হরিণটির দেখা। ছোট বোনটার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু ওর মুখের দিকে আমি তাকাতে পারিনা। চোখে চোখ রাখতে আমি ভয় পাই। যখন বাসায় আসে শুধু একবার আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শার্টা আমার ভিজে যায়। বোনটা আমার সুখি নেই। যৌতুকের টাকা যে পুরো দিতে পারিনি। যখন ওর সর্ম্পক আসল তখন আমার একটা চাকুরির ইন্টারভিউয়ের চিঠি আসল। চাকরিটা বেশ বড়। বাবা অনেক খুশি হয়েছিল সেদিন এই ভেবে আমাদের দুঃখ বুঝি এবার ঘুচে যাবে। সরকারি চাকরী এমনিতে হবে না। মামা চাচা লাগবে। বাবা সব চিন্তা বাদ দিয়ে বোনের বিয়ের টাকার অর্ধেকটা দিয়ে দিল ফুফাতো ভাইকে। বোনের বিয়ে ঠিক। আমার চাকরি হবে জেনে বর পক্ষের সব চাওয়া পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। তারাও রাজি। আবারও এক মহা খুশি জীবনে নেমে এল। তখনই মনটা ডেকে বলেছিল সব কিছূ ঠিক হচ্ছে না। বিয়ে হয়ে গেল বোনের। আর শুরু হয়ে গেল মনের সেই ডাকাডাকি। ফুফাতো ভাই বেইমানি করেছে আমাদের সাথে। সে অন্যজনের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে তার কাজটা করিয়ে দিয়েছে। আর আমাদের টাকা নেওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করেছে। রাগটা আমার চরম উপরে উঠে গিয়েছিল। সোজা ওর অফিসে চলে গিয়েছিলাম। কলারটা ধরে বলেছিলাম, “ঐ কুত্তা আমার টাকা দিবি কিনা বল?” আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “কিসের টাকা চাস তুই? আমি কোন চাঁদা দিব না।” চাঁদা কথাটা শুনে আরও মেজাজ তেতো হয়ে গিয়েছিল। টেবিলের উপরে রাখা ছুরিটা নিয়ে, “টাকা দিবি কিনা বল।” ভয় পেয়ে বলেছিল, “আজকে রাতে দিয়ে দিব।” আর কিছু বলিনী। বাসায় চলে গিয়েছিলাম। বাবা মাথা নিচু করে বসেছিল। সন্ধ্যাকালে বসেছিলাম। হঠ্যাৎ বাইরে কিছু লোকের ডাকাডাকিতে বের হলাম। একদল পুলিশ। আমাকে দেখে বলল, “এটা কি আজিজ সাহেবের বাসা?” বললাম হ্যাঁ। আবার বলল, “জ্যোতি বাসায় আছে?” খানিকটা অবাক হয়ে বললাম, “আমিই জ্যোতি। কোন দরকার।” আর কোন কথা না বলে আমার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দিল। কিছু বুঝতে পারলাম না। বললাম, “হাতকড়া কি কোন পড়ার জিনিস?” আমার কথা শুনে ভুরিওয়ালা দারোগা বলেদিল, “না তোমার জন্য আর.এইট কম্পানিতে ঘড়ির ওর্ডার করেছি।” চেচাঁমেচি শুনে বাবা বাইরে চলে আসল। আর আমার এই অবস্থা দেখে অনেকটা আত্মংকিত হয়ে বলল, “আমার ছেলে কি করেছে। ওকে এভাবে ধরেছেন কেন?” দারোগাটা ধমক দিয়ে বলল, “আপনার ছেলে একটা চাঁদাবাজ। চাঁদা না পাওয়ায় সে অন ডিউটি অফিসার আরিফকে মারতে চেষ্টা করেছে। তাই তাকে অ্যাটেম টু মাডারের অপরাধে গেরেফতার করা হচ্ছে।” বাবাকে আর কোন কথা বলতে সুযোগ না দিয়ে আমাকে গাড়িতে তুলে সোজা থানায় নিয়ে আসে। তিন দিন জেলে ছিলাম। বাবা অনেক কষ্ট করে আমার বেল নিয়েছিল। কিন্তু আমার শেষ রক্ষা হয়নি। টাকার অভাবে মিথ্যা মামলার কারণে হারিয়েছি দেড় বছর। জেল থেকে যখন ছাড়া পেলাম তখন সময়টা শীতের শেষের দিকে। মাঘ মাস চারিদিকটা রুক্ষ। বাসায় যাওয়ার মত টাকা না থাকায় হেটে হেটে গিয়েছিলাম। মা একটা নোংরা আধ ছেড়া শাড়ী পড়ে কপালে হাত রেখে ঝোক দোড়ে বসেছিল। আমাকে দেখে অনেকটা আতকিয়ে উঠেছিল। চোখে ছিল জল। কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু মা বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। কতক্ষণ ছিলাম জানা নেই। মাকে বললাম, “বাবা কোথায়?” একটা রুক্ষ হাসি দিয়ে বলেছিল, “বকুলকে আনতে গেছে।” ভেবেছিলাম সব মনে ঠিকই আছে। কিন্তু যখন বাবার সাথে বকুলকে এই মাঘ মাসের পশ্চিমা বাতাসে একটা শুধু রক্ষ শাড়ী পড়া দেখেছিলাম বুঝেছিলাম কিছুই ঠিক নেই। রাতের বেলা খেতে বসলাম সবার সাথে বাইরে কিছূ লোক বাবাকে ডাকছে। বাবাকে বললাম। কিন্তু মা বেড়িয়ে গিয়ে বলল, “উনি বাড়িতে নেই। মেয়ের বাড়িতে গেছে।” এভাবে বেশ কয়েকজন আসল। আর সবাইকে মা একি কথা বলল। বুঝলাম পাওনাদার ওরা। পরদিন রহিম চাচার কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, “চাচা আমার বাবা মা কেমন ছিল? তাদের মন মরা দেখায় কেন। আর মা মানুষজনকে মিথ্যে বলে কেন?” চাচা অনেকটা মুখ ভার করে বলল, “কিছু ঠিক নেই বাবা। সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। তোমার জেলে যাওয়ার পর থেকে খুব চিন্তা করতে দেখতাম। দোকানে তেমন আসত না। তোমাকে ছাড়ানোর জন্য কতজনকে ধরেছে কত কি করেছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। শুধু টাকার ছড়াছড়ি গেছে। একমাত্র আবাদি জমিটা পযন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। তোমার বোনের বিয়ের য়ৌতুকের টাকাটা মনে হয় পুরোটা দিতে না পারায় সুখটা চলে গেছে। শুনেছি জামাই নাকি প্রচন্ড মারধর করে। অনেক ধার দেনা করে টাকা জোগার করে কিছুটা দিয়েছে। কিন্তু তাতেও রক্ষা পায়নি। শুনেছি ছেলে নাকি আবার বিয়ে করবে। তুমি এত দিন পর এসেছো বাবা কিছু একটা করো। তোমার বাপকে বাঁচাও।” আর কিছু শুনিনী। সোজা চলে এসেছি। আর সেই থেকেই চলছি।
“চলেছি এই অজানা পথে, বুকে আশা চোখে স্বপ্ন নিয়ে
রোজই চলি তবুও অচেনা রয়ে থাকি, পথ আমাকে চেনেনা।
বিভিষীকাময় এই পথে ক্লান্ত আমি পরাজিত এক সৈনিক বেসে
চলেছি দুর্নিবার পথে একটু প্রশান্তির আশে।।”
চলেতে হবে থেমে কি হবে। পা চলছে পাথরে রাস্তার উপর দিয়ে। হৃদয়ে নিয়ে অতৃপ্তি। বোনটাকে আর পাঠাতে পারিনি শশুড় বাড়ি। স্বামীর বিয়ের কথা শুনে বোনটা আমার গলায় দিয়েছে দড়ি। বাচাতে পারিনি এই ছোট্ট বোনটাকে। বাবার যেন চোখের জলটা শুকিয়ে গিয়েছিল। সব কিছুর মূলে নিজেকে মনে হচ্ছিল। বোনটার সাথে আমিও যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি চোখের সামনে বাবা আর মায়ের করুণ মুখের ছবিটা বার বার ভেসে উঠছিল। কিছুই যেন দিতে পারলাম না পরিবারটাতে। শুধু সব গুলো মানুষের জীবনটা অতিষ্ট করে তুলেছি। শত ধীক্কার হয় এই জীবনটার উপর। বাবার মুখে হাসি দেখিনা কত বৎসর যাবৎ ভুলে গেছি। পারিনি মুখে হাসিটা ফোটাতে। চলেছি সেই সন্ধ্যানে।
সময়টা এখন বেলা দুপুর হবে। বসে আছি কিছু আশায় পাতানো ফাদে। আমার ডাক এসেছে। যেতে হবে ভিতরে। ভিতরে যাওয়ার সাথে সাথে ঘৃণ্যসব মুখগুলো চোখে পড়ল। কত সেজেগুজে বসে আছে দেখে বোঝার উপায় নাই। শিক্ষিত ডাকাত একটা স্বার্থ হাসিল করার জন্য আপনজনকেও রেহাই দেয় না। এক ছোবলে ধ্বংস করে দেয় গোটা একটা পরিবার। যদিও বা ঘৃণা তবুও তাদের সামনে মাথা নত করে দাড়াতে হয়। দাঁড়িয়ে থাকা দেখে ডিসিপ্লিন মেইটেন করার জন্য আমাকে বসতে বলল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসতে হল। পেটমোটা চশমাওয়ালা লোকটা দেখে মনে হয় হেড সবার। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি জ্যোতি?” বললাম, “হুম আমিই জ্যোতি।” মাথা নাড়িয়ে বললেন, “বাবা আজিজুল হক।” বললাম, “জ্বি” এবার অন্য একজন বলল, “কি করে আপনার বাবা?” একটু অবাক হলাম। ইন্টারভীউয়ে বাবা কি করে এমন প্রশ্ন করা হয়। তবুও মাথাটা নাড়িয়ে বললাম, “জ্বি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কেরানি।” অন্যপাশ থেকে আর একজন বলে উঠল, “তা এতদিন চাকরি করেনি কেন?” মাথঅটা এবার একটু তুলে বললাম, “মামা চাচার অভাব তাই।” আমার কথা শুনে সবাই কি যেন একটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। অতঃপর পেট মোটা লোকটা বলল, “আপনি এখন আসতে পারেন। আপনার সাথে পরে যোগাযোগ করা হবে।” বললাম, “ধন্যবাদ!” বেড়িয়ে আসলাম। আসার সাথে সাথে একটা টেকোকে আমার দিকে আসতে দেখলাম। এসেই আমাকে বলল, “আপনি তো জ্যোতি। স্যার আপনাকে থাকতে বলেছেন।” খানিকটা অবাক হলাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?” লোকটা মুখে একটা আলাদা ভাব নিয়ে নিল যা তাকে একদম মানায় নি। তবুও তার মত সে বলল, “সেটা আমি জানি নাকি।” কিছু না বলে লোকটার সাথে গেলাম। কিছুক্ষণপর পেটমোটা লোকটা এসে হাজির। লোকটাকে দেখে বললাম, “স্যার আমাকে থাকতে বলেছেন?” বসতে বসতে বলল, “তোমার কথা তো শুনলাম। চাকুরিটা অনেক ভাল পোস্ট। এর জন্য অনেক প্রার্থী রয়েছে। তো তোমার অবস্থান যেহেতু একটু ভাল তাই একটু দৌড়াদৌড়ি করলে হয়ে যাবে।” কথাটা আসলে কি বলতে চেয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। ইনিও লাল বাসায় দেখা করার কথা বলছেন। যা কোন দিনও আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাইতো মাথাটা একটু নিচু করে বললাম, “তাহলে আমি আজ আসি স্যার।” বলেই চলে আসলাম। পিছন থেকে অনেকবার ডেকেছেন তিনি। কিন্তু সামনে পথ আমাকে ডাকছে যেখানে আমাকে ছুটে যেতে হবে।
“চলতে চলতে পথের শেষে পৌছেঁছি আমি গোধূলি লগ্নে
যেতে হবে আমায় দিতে হবে পাড়ি স্বপ্ন ভেঙ্গে বির্চূণ করি”
বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। বাড়ির যেতে রাস্তার মোড়ে যে পুকুরটা পরে সেখানে থাকব কিছুটা সময়। আজও আমি নিঃস্ব পথের যেন এক পথিক। স্বার্থের কাছে পরাজিত সৈনিক। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে বলি বাবা আমার চাকরিটা হয়েছে বাবা। আর কষ্ট করতে হবে না। কিন্তু তা আমি পারিনা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে র্সূযটা পরেছে ঢলে। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিচ্ছে কুসুমের মত র্সূযটাকে। আবছা হয়ে আসছে চার পাশ। ঘরে ফিরে যাচ্ছে শালিকের দল। ফিরব আমি। বসে রব এখানটায়। রাত্রি গ্রাস করে না আমায়। বিবর্ণ এই খনে আমি ফেলব চোখের জল। পরাজিত পরাজিত আমি একজন।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত