আজ ছুটির দিন। অফিস নেই। বাইরে কোনো কাজও নেই। রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। হুট করে বেডরুমে কিছু একটার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু ছানাবড়া।আমার তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটা বাথরুমের সব সাবান,শ্যাম্পু,ফেসওয়াশ,হ্যান্ডওয়াশ,ডিটারজেন্টসহ যা যা পেয়েছে,সব কিছু এনে রুমের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাখিয়ে একাকার করে ফেলেছে। মেয়েকে সেখান থেকে তুলে সবেমাত্র একটা ছোট্ট ধমক দিয়েছি। অমনি তার ঠোঁট উল্টে নাক ফুলিয়ে কান্না শুরু হয়ে গেছে। আর মেয়ের কান্না শুরু হতেই কোথা থেকে যেন ঝড়ের মতো হাজির হলেন শুভ্র। এসেই আমার কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে আমাকে এক ধমক দিয়ে বললো,
“খবরদার!আমার মেয়েকে বকবে না।”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
“বকছি কোথায়?দেখুন ও কি করেছে। সবগুলো জিনিস নষ্ট করেছে। এসব যে খেলার জিনিস না,ওকে তো সেটা বুঝাতে হবে।”
শুভ্র ঘরের মেঝেতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর বললো,
“বেশ করেছে নষ্ট করেছে। আমার প্রিন্সেসের যা খুশি ও তাই করবে। তুমি ওকে বকতে পারবে না।”
“কিহ!?বকতে পারবো না মানে?আমি ওর মা।ওকে আমি একশ বার বকা দিব। ইচ্ছা হলে মারও দিব।”
উনি আমাকে আরেকবার ধমক দিলেন।
“চুপ করো। আমার প্রিন্সেসকে ভুলেও তুমি মারতে পারবে না।”
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো এবারে। চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“ও কি আপনার একার প্রিন্সেস? আমার না?”
“না,তুমি শুধু শুধু ওকে বকা দাও। তাই ও শুধু আমার প্রিন্সেস।”
এবার আমার রাগ সপ্তম আসমানে উঠে গেলো। ফাজলামি পেয়েছে নাকি?! আমার মেয়েকে আমি শাসন করতে পারবো না?! রেগে কিছু বলতে যাব তার আগেই মেয়ে আমার খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো,
“মাম্মি,তুমি পঁতা মেয়ে। আমাল বাবাই অনেক ভালো।”
মেয়ের কথা শুনে মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।কি বলল এটা!আমি পঁচা!?আর বাবাই শুধু ভালো?!বেইমান মেয়ে কোথাকার!
বাপ মেয়ে দুজনই হাসছে।আর সেটা দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।বেরুনোর আগে বলে এসেছি,
“আমি পঁচা,না?আর ও আপনার একার প্রিন্সেস,তাই না?থাকুন আপনারা দুজন।আমি এতই যখন খারাপ,তখন আমাকে আর কি দরকার?গেলাম আমি।থাকুন আপনি আপনার প্রিন্সেস নিয়ে।আর তুইও থাক তোর বাবাই নিয়ে।”
আমার কথাগুলো শুনে বাবা মেয়ে আবার হেসে উঠলো।উনি বললেন,
“দেখেছো মামনি?তোমার মাম্মি কত্ত হিংসুটে!”
“হিহি…পঁতা মেয়ে।”
আমি আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না।আমার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে চলে এসেছি।
ফাজলামি করে আমার সাথে?আমার মেয়েকে আমি কিছু বলতে পারবো না?থাক তোরা একা একা।যত্তসব…!
বাড়ি থেকে বেরিয়েছি ঠিকই।কিন্তু কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।একটু ভেবে বাড়ির পাশের পার্কে গেলাম।ওখানে বসে বসে বাদাম চিবালাম খানিকক্ষণ।তারপর ঝালমুড়ি মামাকে দেখে এগিয়ে গেলাম।আমার যখন রাগ হয়,তখন আমি একা একা বসে খাই।পার্কে প্রায় আধঘণ্টা ছিলাম।হঠাৎ একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে আমার মেয়ের কথা মনে পরলো।মেয়েটাকে উনি সামলাতে পারছেন তো?ধুরর…যা পারে করুক,আমি ভাববো কেন?উনার প্রিন্সেস,উনি সামলাক!
পার্ক থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম।উদ্দেশ্য কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া।রেস্টুরেন্টে গিয়ে একগাদা খাবার অর্ডার করলাম।ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলো।আমি মোবাইলে দেখলাম দুপুর ১২:৩০ বাজে।এই সময় আমি মেয়েটাকে খাওয়াই।শুভ্র ওকে খাওয়াতে পারবে তো?একগাদা খাবার অর্ডার দিয়েও কিচ্ছু খেতে পারলাম না শুভ্র আর মেয়ের চিন্তায়।কিন্তু না,আমি কিছুতেই এখন বাড়ি যাব না।ওদের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে একটা শপিংমলে গেলাম।বেবি কর্ণারের দিকে গেলাম।মেয়ের জন্যে কয়েকটা খেলনা আর পুতুল কিনেছি।একজোড়া ছোট্ট জুতোর উপর চোখ পড়লো।এত কিউট জুতোজোড়া যে না কিনে পারলাম না।
বাড়ি থেকে বেরিয়েছি প্রায় ঘন্টা দুয়েক হয়ে গেছে।শপিং করতে করতে আবার মনে পড়লো বাড়ির কথা।মেয়েটা কি করছে কে জানে!উনি কি খাওয়াতে পেরেছেন মেয়েটাকে?!উনি নিজে খেয়েছেন?!নাহ,এভাবে আর মনের বিরুদ্ধে বাইরে থাকা যাচ্ছে না।তাই এবার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বাড়ির সামনে যেতেই আমার মেয়ের চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠলো।হাতের শপিং ব্যাগ সব ফেলে দিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।গিয়ে দেখলাম দরজা খোলা।তার মানে আমি যাওয়ার পর উনি দরজাটাও লাগান নি!দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম শুভ্র মেয়েকে খাওয়ার জন্য সাধ্য সাধনা করছে।কিন্তু বদমাশ মেয়ে কিছুতেই খাচ্ছে না।আমাকে দেখতে পেয়েই ও “মাম্মিইই” বলে চিল্লিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি ওকে কোলে নিয়ে চুমু দিতে লাগলাম।ও কান্নাভরা মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“মাম্মি,তুমি আল কোতাও যেও না।আমি আর দুত্তু কলবো না।”
শুভ্র ধীরে ধীরে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো।তারপর বললো,
“বুঝলাম!তোমাদের মা মেয়ের মধ্যে আর কখনো আসা যাবে না।শেষে তোমরা দুজন আম আর দুধের মতো মিশে যাবে।আর আমি বেচারা অাঁটি হয়ে গড়াগড়ি খাব।”
আমি উনার দিকে একবার চোখ বাঁকা করে তাকালাম।তারপর মেয়েকে নিয়ে উনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরে চলে এলাম।এর অর্থ…আমি আপনার উপর এখনও রেগে আছি।কঠিন রাগ!এই রাগ এত্ত সহজে ভাঙবে না।এবার বুঝেন ঠেলা!