একটি সফলতার গল্প

একটি সফলতার গল্প

তোমার বাবা রিক্সা চালায় আর তুমি আমায় সেটা জানালে না??? হোয়াট দ্যা হেল হৃদিতা???” আশফাকের কথা শুনে কিঞ্চিৎ নয়,, বরং অনেকটা অবাক হলাম…

-“হ্যাঁ, আমার বাবা রিক্সা চালায়! তো!! কি হয়েছে? রিক্সা চালানো কি অপরাধ?? নাকি এটা কোনো গুনাহ? কোনো কাজই ছোট নয়, হালাল সব কাজই নেয়ামত বয়ে আনে।”

-“হয়েছে হয়েছে, আর জ্ঞান দিতে হবে না,,, ফ্রেন্ডস,রিলেটিভস, কাজিনস সবাইকে তোমার কথা বলেছি,, তোমায় ভালোবাসি, তোমার সাথে রিলেশন! আজ ওরা যদি জানে তোমার আব্বু রিক্সা চালায়,, আমার মান সম্মান কই নেমে যাবে সেটা ভেবেই কান্না পাচ্ছে! মাই গড!”

– জাস্ট শাট আপ,, লিসেন মিস্টার আশফাক,, প্রপোজ আমি তোমায় করি নি,, তুমি আমায় করেছো, তাও এক্সেপ্ট করেছি ৭ মাস পিছে ঘোরার পর,,, তাও রিলেশন না,, বলেছি যদি বাবাকে রাজি করিয়ে বিয়ে করতে পারো তাহলে সেক্ষেত্রে আমি রাজি, কিন্তু প্রেম ট্রেম আমার দ্বারা হবে না,, আর যদি সত্যিই আমায় ভালোবেসে থাকো! তাহলে আমার বাবার অকুপেশন কেন বাধা হয়ে দাড়াবে? তোমার একচুয়ালি কি দরকার? আমায়, নাকি আমার বাবার টাকা, যোগ্যতা, বড়লোক শ্বশুর?

-“ওহহ জাস্ট কিপ ক্যাম! আগে যদি জানতাম তুমি এমন ছোটলোকের মেয়ে তাহলে কখনোই তোমার পিছে ঘুরতাম না,, ফকিন্নির ভাব কতো! মাই ফুট!” আশফাক এই বাজে কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো। কিছু বললাম না আর প্রত্যুত্তরে,, শুধু চেয়ে দেখলাম, গিরগিটি ছাড়াও আরও অনেক প্রানী আছে যারা নিমিষেই রঙ বদলাতে পারে!! বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বাবা কেবল রিক্সা রেখে খেতে বসেছে,, গিয়ে জলদি খাবার বেড়ে দিলাম,, কি ক্লান্ত চাহনী, কি মায়াময় চেহারা আমার বাবার! বাবা! আমার প্রথম ভালোবাসা,,, যার ভালোবাসা সাত আসমান সমান অসীম,, সেই বাবার অপমান কোনোদিন কোন মেয়ে সহ্য করবে না,, কখনো না।

বাবা যে কতো কষ্টে আমায় পড়াশোনা করাচ্ছে সেটা আমি জানি,, তবু ভাগ্যগুণে আমি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম বলে,,, নইলে হয়তো পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যেতো, বাবার পক্ষে প্রাইভেট ভার্সিটি কেন! ন্যাশনালে পড়ানোও প্রায় অসম্ভব হতো। আশফাক আমার ২ ব্যাচ সিনিয়র,, নর্থ সাউথ ভার্সিটিতে পড়ে,, একাউন্টিং। আর আমি ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা ভার্সিটিতে। আচার ব্যাবহার মার্জিত ছিলো বলে ভেবেছিলাম জীবনসঙ্গী করবো ওকে, কিন্তু আল্লাহ তার আগেই এই মা মরা মেয়েটাকে ওর আসল রূপ দেখিয়ে দিলেন। ৪ বছর পর হঠাৎ আশফাকের সাথে দেখা,, দেখলাম ক্লান্ত দেহে রোদে দাড়িঁয়ে আছে,, গাড়ি থামিয়ে গাড়ির ডোর খুলে গাড়িতে বসতে বললাম। ও ভূত দেখার মতো চমকে গেলো আমায় দেখে,, ধীরে গাড়িতে এসে বসলো। বললাম,,

-কি অবস্থা? কোথায় যাচ্ছো?
-অফিসে,, কিন্তু বাস পাচ্ছিলাম না।
-কিসে জব করো?
-প্রাইম ব্যাংকে, একাউন্টেন্ট এর জব।

(গম্ভীর গলায়) বাবা হঠাৎ করে ব্যবসায় লস করলো, এতো টাকার বিজনেস হারিয়ে বাবা স্ট্রোক করে একসাইড প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তখন সংসারের ৩-ভাই বোন আর বাবা মা, তথা পুরো ফ্যামিলির দায়িত্ব আমার কাধে এসে পড়লো,, শো রুমে জব নিলাম ফুল টাইম। ভার্সিটিতে ক্লাস মিস দিতে দিতে, আর এক্সামের ফি, বেতন ইত্যাদি জমা না দিতে পারায় বাধ্য হয়ে ভার্সিটি ছাড়লাম,, ওপেন ভার্সিটি থেকে অনার্স কমপ্লিট করতে হলো। আর এখন কোনোরকম এই চাকরী নিয়েই চলছে।” বাদ দাও, তোমার কি খবর?

-আলহামদুলিল্লাহ,, খুব ভালো,, গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে নিজস্ব একটা ব্র্যান্ডেড শো- রুম দিয়েছি,,মূলধন স্বল্প ছিলো, কিন্তু পরিকল্পনা আর পরিশ্রমের কমতি ছিলোনা। আলহামদুলিল্লাহ অনেকগুলো ব্রাঞ্চ খুলে ফেলেছি প্রোফিট থেকে। প্রচুর সুনাম আর লাভ আসছে। পাশাপাশি একটা নামী-দামী কলেজে লেকচারার হয়েছি। আল্লাহ খুব ভালো রেখেছেন। ও হ্যা,, তোমার কথিত ছোটলোক রিক্সাচালক ব্যাক্তিটা এখন আর রিক্সা চালায় না,,, শো-রুম টা আমার বাবার নামে,, তিনিই ম্যানেজার। আর তার ফকিন্নি মেয়েটা আজ সফল বিজনেসম্যান।

আশফাকের চোখে মুখে স্পষ্ট দেখলাম লজ্জা আর অনুশোচনার মিশ্রন। ও ভাড়াটা এগিয়ে দিতে গেলো ড্রাইভারের দিকে, ঈষৎ হেসে বললাম – “আশফাক!! কি করছো!! এটা আমার নিজেরই গাড়ি। ও অবাক আর বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালো। হয়তো এতো দামী গাড়িটা আমার,, সেটা মানতে পারছে না। বললাম- আশফাক!! রিক্সাওয়ালার ছেলে মেয়ে সবসময় রিক্সাওয়ালা হয় না,, অনেক সময় পয়সাওয়ালাও হয়! দরকার শুধু সৎপথে পরিশ্রমের। বাকিটা সময় নিরব গেলো। গাড়ি থেকে নামার আগে ও আমায় বললো,,

-“হৃদিতা! আরেকটা বার কি সুযোগ দেয়া যায় না?? দেখো আমি তোমায় আজও খুব কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে গাড়ির কাচটা তুলে দিলাম। তারপর শো-রুমের হেড অফিস থেকে বাবাকে পিক করলাম,, বাবা পাশে এসে বসে জান্নাতী একটা হাসি দিলো,, সেই ক্লান্তিভরা বিষন্ন মুখে যেন আজ দুনিয়ার সব হাসি-আনন্দ এসে ঝলমল করছে! এ হাসিই যেন আমার সব সুখ,, আমার দুনিয়া, আমার বেহেশত, আমার ভালোবাসা। বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বললাম

– “বাবা! তোমায় অনেক ভালোবাসি, সারাটা জীবন এভাবে তোমায় ভালোবেসে যাওয়ার সুযোগ দিও!”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত