চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে

–     যূথীইইই, চোর আসছিলো আজকে?!

আচমকা ডাকে ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলে দেখি- আম্মা! খাটের সামনে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন!

–     রান্নাঘরে?

–     না! আমার ঘরে!

বেশ রাত করে শুইছিলাম সেদিন! মুভি দেখতে দেখতে রাত তিনটা পার করে শুইতে যাবো এই সময় দেখি পানি তৃষ্ণা পায়া গ্যাছে। ঠান্ডা পানি খাইলে গলায় ব্যথা কোরবে! তাই গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে সামান্য পানি গরম দিবো, দেখি- রান্নাঘরের জানালা বন্ধ। জানালার থাই গ্লাস খানিকটা ফাঁক করে পানি গরম করে খেয়ে জানালা আটকাতে গিয়ে দেখি ঠেসে লাগানো যাচ্ছে না! এক আঙ্গুল চিকন ফাঁক রেখেই শুয়ে পরলাম। এমনিতেই বেশ রাত হয়ে গেছে! এখন শব্দে যদি আম্মু উঠে আসে তাইলে খবর আছে! খানিক পরেই ভোর হয়ে যাবে! এমনিতেই কয়েক দিন ধরে শীতের আলসেমীতে ফজরের নামাজ আদায় করার বিরতি পরছে! আম্মুর ধারণা আমি প্রতি রাতেই গভীর রাত পর্যন্ত জাগা থাকি বলেই এমনটা হচ্ছে!

আমি রাতের সেই কথা মনে করে হরবর করে বলতে লাগলাম-রান্নাঘরের জানালা আমিই একটু ফাঁক করে রাখছিলাম।

আম্মা বললো- আরে না! আমার ঘরে আসো!

এইবার উঠতেই হলো। লেপের ভেতর থিকা ঠেলায় না পরলে উঠতে ইচ্ছে করে না!

বড়ই অনাগ্রহ কিন্তু চোর আসার উৎকণ্ঠা নিয়ে আম্মার সাথে সাথে চললাম।

আম্মার ঘরে বিছানার সাথে লাগোয়া বড় থাই এর জানালার গ্লাসটা হাট করে খোলা, ভাঁজ ভাঁজ ডিজাইনের চার পিস পর্দার দুইটা এক পাশে গুছিয়ে গ্রিলের সাথে গুটানো আর জানালার কাছ ঘেঁষে বিছানার উপরে দুই ইঞ্চি চওড়া সোয়া হাত লম্বা একটা কাঠের ভারী টুকরা রাখা।

আমিতো ঐ ঘরে ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে এক্কেরে থ!

আম্মা বললো- আমার নতুন নোকিয়া ফোনটা নাই!

–     ক্কি বলো?

–     হ্যাঁ! দ্যাখো না, চোরে কত চালাক, পাশেই স্যামসাং সেটটা ছিলো, এইটা ন্যায় নাই। চোরেও বুঝছে যে এইটা পুরান সেট!

–     অন্ধকারে বুঝছে কেমনে? ঐটা যে টেপ দিয়ে তালি মারা, লাইট ছাড়া বুঝলো কেম্নে?

–     কি জানি!

–     যাহ, নিলো তো নিলো এই নতুন সেটটাই!

বুকের মধ্যে হাহাকার উঠলো আমার! মাত্র কালকে রাতেই মনে হচ্ছিলো ভাইয়া দেশে থাকতে থাকতে আরেকটু বেশি দামেই সেটটা কেনা যেতো! অযথা কম দামে কেনা হইছে! আর মাত্র ভাবতে না ভাবতেই সেটটা হারায় গেলো?

আম্মাকে রাতের ভাবনার কথাও বললাম। আম্মা এই নতুন নাম্বারটা খুব কাছের কয়েকজন ছাড়া বেশি মানুষকে জানায় নাই। আম্মার দুইটা নাম্বার। আগে ছিলো একটা দুই হাজার টাকা দামের স্যামসাং সেট। সিটিসেল নাম্বার ব্যবহার করতেছে ওইটায় দুই হাজার ছয় সাল থেকে। অনেক বার হাত থেকে পরে ও’র সি বাটন আর ফাংশন বাটন খুলে পরে যায় বলে ট্রান্সপারেন্ট সাদা টেপ দিয়ে পেচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কথা শুনা যায় স্পষ্ট। তাছাড়া ওটা পুরানা অনেকের সাথেই যোগাযোগ করার জন্য লাগে। কিন্তু অনেক আজেবাজে ফোনও আসে। তাই আম্মা মাস চারেক হলো বাংলালিঙ্ক নাম্বারটা নিয়েছে।

রান্নাঘরে চা বানাতে বসে মা আমাকে বলতে থাকলো- আমারেও আজকে এত্ত ঘুমে পাইছিলো! ফজরের আজানের সময় এলার্ম বাজছে তাও উঠি নাই। এলার্ম বন্ধ করে ফোনটা জানালার কাছাকাছি বালিশের উপরে রাখছিলাম। আর চোরেও সুযোগটা নিয়া নিলো। আমিতো খালি কই, সব দরজা জানালা বন্ধ বাতাস আসে কোইত্থিকা? মাথায় খালি ঠান্ডা লাগতেছে আর আমি অবাক হইতেছি! পরে উইঠা দেখি জানালা এইরকম করে খোলা! কি আশ্চর্য! ছয় বছর ধইরা এই বাসায় আছি কোনদিন তো কিচ্ছু হইলো না! চোরে কেম্নে জানলো যে আজকে তোমার আব্বা বাসায় নাই? কাঠের টুকরাটা দিয়া যে মাথায় বাড়ি দিয়া দেয় নাই তাই ভাগ্য! আল্লাগোওও এখনো গা কাপতেছে আমার!- বলে মা শিউরে ওঠেন।

সকাল সাড়ে আটটা নয়টা আমার কাছে মোটামুটি এখন ভোর বেলা! আমি এত সকালে ঘুম থেকে উঠি না। আম্মা চা বানাচ্ছে, বানাক। আমি আবার লেপের ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম। খানিক পরে আম্মা এসে আবার জিজ্ঞেস করলো-সিমটা তোলা যাবে না? নাকি আবার আরেকটা কিনতে হবে?

খুচরা পান সিগারেটের দোকান থেকে বাংলালিংকের এই সিমটা কিনেছিলাম। হঠাত মনে হলো- আচ্ছা কল দিয়ে দেখি তো? ভোর বেলায় যদি নিয়ে থাকে, সিমটা কি এখনি ফেলে দিয়েছে? ফোন করে কি একটু ঝাড়ি দেব?

আমি গ্রামীণ আর এয়ারটেল নাম্বার ব্যবহার করলেও গ্রামীণ নাম্বারটা সবসময় চালু রাখতে হয়। বন্ধ রাখা যায় না। দুনিয়ার এই মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত অনেক লোকজনের সাথে কনট্যাক্ট আছি গ্রামীণে। এয়ারটেল’টা বছর খানেক হলো নিয়েছি সবাই জানেও না তাই ওটা থেকেই আম্মার হারানো ফোনে কল দিলাম। দেখি- রিং বাজছে! আরেহ, সিম বন্ধ করে নাই?!!! সেকেন্ডের মধ্যেই শুনি রিং তো ঘরের মধ্যেই বাজছে! কি ব্যাপার? দৌঁড়ে গেলাম আম্মার ঘরে। শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে খাটের তলায় উঁকি দিলাম! জানালার ধার ঘেঁষে খাটের তলায় উঁকি দিয়েও ঠিকমত দেখি না। হাত ঢুকিয়ে দিলাম আরো নিচে। কোণা দিয়ে দেখি, এইবার মোবাইলের লাইট জ্বলতেছে! হাতড়ে তুলে নিয়ে এলাম ফোনটা।

চেনা রিংটোন শুনে আম্মাও রান্না ঘর থেকে নিজের ঘরে ছুটে এসেছেন। আম্মাকে দেখালাম-এই দ্যাখো তোমার ফোন। চোরে নিতে পারে নাই। কাঠ দিয়া টান দিয়া নিতে চাইছিলো! মোবাইল খাটের তলায় পইরা গ্যাছে!

আম্মা কয়-দেখছোওও তোমারে ডাইক্কা তুইলা তো ভালোই হইছে! আবিরও আরেকদিন ফোনে বলতেছিলো- সাবধানে থাইকো। দেশে যেই হারে হরতাল অবরোধে মানুষের আয়ের ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাতে চোরের উপদ্রব বেড়ে যাবে। তাইই হইলো। চোরেরাই কি কর্বো?

চোরে তো জিনিস নিতে পারেই নাই। উলটা আমাদেরকে সতর্ক করে থুয়ে গেছে। ঐ জানালার পশ্চিম দিকের লকটা লাগতো না! লক তো লাগানো হবেই। পাশের বিল্ডিঙটা একেবারে গায়ে গা ঘেঁষে বানিয়েছে! মাঝখানে খুবই চিপা জায়গা! চিপা দিয়া বিল্ডিং এর বাইরে নেট লাগানো হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কোন অঘটন না ঘটে!

এর পরে আমার ঘুমের পুরাই ফালুদা। ভাবলাম, ফোন তো উদ্ধার হইছে! এখন বাজে মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে! এগারোটা পর্যন্ত খানিকটা গড়াবো তা আর হলো নাহ! আম্মা আমার মামা-মামি, খালা-খালু, নানী-নানূ সবাইকে ফোন করে খবর দিচ্ছেন আর সবাই একটু পর পর আসতেছে আর দরজা খুলা লাগতেছে আর ঘটনার বর্ণনা দ্যাওয়া লাগতেছে!

ছোট মামা তো এসে বললো- আপনে যে মাঝেমাঝে একা থাকেন এই খবর চোরে ক্যাম্নে পাইছে? আপ্নের ঘরে যে বুয়া আছে অয় বস্তিত যাইয়া কয়! নাইলে এই চিপার জানালার লক লাগেনা এই খবর চোরে পাইছে ক্যাম্নে?

আম্মাও মামার সাথে গলা মিলায়া হ হ করে সায় দিলো। আবার মামা চলে যেতেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে- না জাইনা কাউরে সন্দেহ করা গুনা!

শেষ খবর হলো এই—বিকেলে ছোট মামা অফিস থেকে ফিরে জোরে টান মেরে জানালার লকটা ঠিকই লাগিয়ে দিয়েছে। অথচ, এই লক গত ছয় বছর ধরে এমনেই ছিলো। লাগে না! তাই জানালা ভিড়ানো থাকলেও লক লাগানো হতো না কোন সময়েই। অথচ, বিছানার উপরে মাথার কাছে কত সময় দামী হাত ঘড়ি আরোও এটা সেটা রেখে দেই আমরাই। ভাগ্যিস সেসবের কোনটা খোয়া যায় নাই। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! এই বেলা আমাদের শুধু বুদ্ধিই বাড়লো তা নয়, শিক্ষাও হলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত