দরিদ্রের আনন্দ ভ্রমণ

দরিদ্রের আনন্দ ভ্রমণ

ভার্সিটির বন্ধুরা সবাই সাত হাজার টাকা দিয়ে দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পিকনিকে যাচ্ছে। আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো যাওয়ার।কিন্তু টাকার অভাবে যেতে পারছি না সে কথা আর বন্ধুদের বলতে পারছিনা।বন্ধুরা যখন আমাকে বলে,
তুই বেশ মজার মানুষ, তুই গেলে বেশ জমবে।চলনা যাই।যাচ্ছিস না কেন? নারে এসব ঘুরাঘুরি আমার ভালো লাগেনা, বলে সেখান থেকে ওঠে চলে আসি। তখন আমার সামনে বাবার ঘামে ভেজা চেহেরাটা ভেসে ওঠে। আমার বাবা সামান্য একজন মুদি দোকানী।আট জনের পরিবারে বাবা-ই একজন আমাদের ভরসা।একটা ছেলের আশায় আমাদের ছয় বোনের জন্ম।ডাক্তারের চিকিৎসা,হুজুরের তাবিজের চিকিৎসা কোন কিছু বাকি রাখেনি বাবা।তাও ছেলে হয়নি,সব মেয়ে হয়েছে। আমি সবার বড়।

সবাই পড়াশোনা করছি।বাবা একজন তার ঘাম ঝরা শ্রম দিয়ে কোন কর্মী ছাড়াই দোকান চালায়।বয়সও কম হয়নি পঞ্চাশ উর্ধ্বে বয়স।মাঝেমধ্যে হার্টের অসুখে ভোগে।টাকার অভাবে শহরের ভালো ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়না। তখন আমাদের না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়ে যায়। বাবাকে মাঝেমধ্যে বলি, বাবা তুমিতো অসুস্থ হয়ে পড়।একজন যদি কর্মী থাকতো দোকান খুলে বসতে পারতো।কিছুটা হলেও ইনকাম হতো। বাবা তখন গোঙানির শব্দে অস্পষ্ট ভাবে বলে,মা রে,তোদের ছয় বোনের খরচ দিতে আমার হিমশিম খেতে হয়।যদি একটা ছেলে রাখি তারওতো বেতন চালাতে হবে সে টাকা কয় পাবো বল।ইনকাম হয় দশ-বারো হাজার। তোদের খরচও আছে দশ বারো হাজার।

যদিও আমি অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনটা টিউশন করে ছোট দুই বোনের খরচটা বহন করছি।বাবার ওষুধেও অনেক টাকা চলে যায়।মা সেলাই কাজ করে অল্প টাকা পেত আগে।আজকাল মা কেউ অসুখে ধরেছে,সেলাই কাজ করতে পারেনা কোমর ব্যথা হয়ে যায়। আজকাল বাবার অসুখটা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।বাবার দোকানটাও প্রায় সময় বন্ধ থাকছে।গোটা পরিবারের ভারটাও আমার কাঁধে পড়ল।

তিনটা টিউশন করিয়ে সাড়ে দশ হাজার টাকা পাই।বাবার ওষুধ,ছোট বোনদের খরচ সবকিছুই আমার দায়িত্বে।যে সাত হাজার টাকা দিয়ে পিকনিকে গিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে পারতাম, সেই টাকা দিয়ে পরিবারের মানুষগুলোর অভাব পূরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছি ভাবতে মন খারাপটা আনন্দের অশ্রুতে রূপায়িত হয়।আনন্দটা সবার সাথে শেয়ার করতে দেড় কেজি গরুর গোস্ত কিনে মায়ের হাতে দিই।আর সবাই এক বেলা তৃপ্তির সাথে খেয়ে তারা যে আনন্দটা পায়,তা পিকনিক, র্যাগ ডে,ক্লাস পার্টিতে যা পাওয়ার কথা আমি তার হাজার গুণ আনন্দ এখানে পাই।
ইদানিং বাবার অসুখ বেড়ে যাওয়ার পর আরো দুটা টিউশন খুজে নিয়ে মাসিক ইনকামটা সতেরো হাজারে আনলাম।

সকাল বিকাল পাঁচটা টিউশন করিয়ে রাত সাড়ে দশটায় বাড়ি ফিরে যখন দেখি সবাই আমার জন্য না খেয়ে বসে আছে।আর আমি আসার পর বাবা তার ওষুধের খুজ নেয়,এবার উচ্চমাধ্যমিক দিবে বোনটা তার টেস্ট পেপারের খোঁজ নেয়। আর ছোট বোনটা চকলেটের জন্য আমার ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়। তখন মা রান্না ঘর থেকে ডাক দেয়,মেয়েটা আসতে না আসতে তোমাদের চাওয়া-পাওয়া শুরু হয়ে গেলো?বসতে হলেওতো দিবি একটু।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,সবাই চলে আয়।

তখন বাবা-মা কে একটু শাসনের সুরে বলি,না খেয়ে আমার জন্য সবাইকে বসিয়ে রাখো কেন। বাবা-মা উল্টো কিছু বলেনা।সেজো বোনটা উত্তর করে বলে,তোকে ভাসি খাওয়ায়ে আমাদের তাজা খাওয়াবে তা কি আর বাবা হতে দিতে পারে? নানান অভিযোগ এবং অনুযোগ শুনে রাতটা বিশ্রাম নিয়ে আবার নেমে পড়ি পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটানের অভিযানে।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত