আমরা ছেলেটিকে কাঁদতে দেখলাম। একটা শক্তসমর্থ ছেলে কী করে হু হু করে কাঁদে, তা দেখলাম বাক্যহীন চোখে।
যার সঙ্গে তার এত দিন প্রেমের সম্পর্ক ছিল, আজ সেই মেয়েটির বিয়ে। আমরা কেউ-ই সে খবর জানতাম না।
বরং তাদের বিয়ের দিন গুনছিলাম। দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে আমরা তত বেশি রসিকতামুখর হয়ে উঠতে থাকি।
যেন আমাদের আলোচনার আর কোনো বিষয়ই নেই। আজ যখন ছেলেটিকে আমরা কাঁদতে দেখি, তখন বেশ বিহ্বল হয়ে পড়ি।
ভাবি, কোনো নিকট আত্মীয় বিয়োগ হলো কিনা। হা, বিয়োগ তো বটেই, আত্মীয়ও।
মানুষ কেন কাঁদে তার অনেক বিশ্লেষণ থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। আমরা সেসব কারণ খুঁজতে যাই না।
মোটা দাগে বলতে গেলে, ছেলেটিকে কাঁদতে দেখে আমরা সমব্যথী হই। তাকে শক্ত হতে বলি।
আর যতবারই শক্ত হওয়ার কথা ওঠে, ততবারই ভেঙে ভেঙে যেতে থাকে সে।
সমাজের ট্যাবু জানান দেয়, ছেলেদের এভাবে প্রকাশ্যে কাঁদতে নেই।
তাই, কান্না থামাতেই হোক, আর ট্যাবুর কারণেই হোক,
আমাদের মধ্যে একজন মেয়েটির সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে, ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করে।
ছেলেটি তার প্রেমিকার মোবাইল নম্বরটি আমাদের মধ্যে আগ্রহীজনকে দেয়। কল করা হয়। অন্য পাশে তখন বিবাহ আয়োজনের শব্দ।
মেয়েটি কথা বলে। প্রায় মিনিট দশেকের মতো কথা চলে স্বপ্ন ও বাস্তবতা নিয়ে। মেয়েটির অনেক অভিযোগ।
ছেলেটির কী কী গুণ বা বৈশিষ্ট্য নেই, কেন তার সঙ্গে জীবন পার করা সম্ভব নয়, তার লম্বা ফিরিস্তি দিলো।
বুঝলাম, মেয়েটি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আর বুঝলাম ঘটনা একদিনে ঘটেনি, একদিনে ঘটেও না।
যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যের সামনে ছোট করে, অপমানিত করে, বুঝতে হবে শ্রদ্ধার সুতাটি ছিঁড়ে গেছে কবেই।
যে ঘুড়িটি আপাতচোখে দেখা যাচ্ছে উড়ছে, ওটা আসলে বোকাট্টা; ঘৃণার বাতাসে দোল খাচ্ছে।
সম্পর্ক তো কেবল রূপকথার শেষ লাইন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারি নানা স্বপ্ন।
এই স্বপ্নগুলো দেখা হয় যৌথ প্রযোজনায়। আর এর একজন সেই প্রত্যক্ষ প্রতিবিম্ব থেকে সরে গেলে, পুরো আয়নাটাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।
একটা কথা বুঝতে হবে, কেউ যখন ‘নাই’ দিয়ে কাউকে বিচার করতে শুরু করে, ধরে নিতে হবে সেই সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
কে না জানে, গ্রহণ করতে হয় ‘আছে’ দিয়ে; ‘নাই’ তো অসীম।
আমি এমন একজনকে জীবনে দেখেছি, যে ভালোবাসতে বাসতে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গিনীটি যখন তাকে ছেড়ে যায়, সে মরতে বসেছিল।
বসে বসে কেবল ভাবতো, কী করে মরলে একটু কষ্ট কম অনুভব হবে। অথচ তার বন্ধু-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন সকলেই ছিল।
হয়ত, তাদের গুরুত্ব ছিল তার কাছে লঘু।
দেখেছি খুব কাছ থেকে কীভাবে একটি মানুষ হাজারো মানুষের ভীড়ে ব্যক্তিগত হয়ে যায়, বাঁচার একটি মাত্র অবলম্বন করে বেঁচে থাকে।
সে-ই ভালো বলতে পারে যে যাপন করেছে এমন জীবন।
হয়তো সে কারণেই, কোলাহলে থেকেও যখন সে কেবল ব্যক্তিগত হয়ে যায়, তখন নিজেকে বড়ো পরাজিত ভাবতে থাকে।
কিন্তু আমরা তখন উপলব্ধি করতে পারি না, কিংবা চাই না- সময় হচ্ছে জগতের সবচেয়ে বড় উপশমকারী মলম।
আজ যে ছেলেটি কাঁদছে, এমন করে অগুনিত মেয়েও কেঁদেছে, প্রকাশ্যে নয়তো নীরবে।
হয়ত আজকের মতো তার সঙ্গীটিও তাকে ছেড়ে গেছে ‘নাই’-এর সংজ্ঞা দিয়ে। মানুষ মাত্রই স্বপ্ন হারাবার বেদনায় কাতর একটি প্রাণী।
চোখের সামনে তিলতিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নকে যখন সে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে দেখে, তখন সেও ভেঙে ভেঙে পড়ে তারই সঙ্গে।
স্বপ্ন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় কেউ কেউ সঙ্গীকে আঘাত করে, নয়তো নিজেকে নিহত করে।
নিজেকে হত্যার পেছনেও কাজ করে সেই আঘাত দেওয়ার অভিপ্রায়।
কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির এতটুকু কষ্ট কোনোদিনই হতে দেবো না ভেবে যে প্রতিজ্ঞা করা, তা যেন কথার কথা হয়ে উবে যায় কোথায়।
এতকাল এত এত সব ভাঙন দেখে শিখেছি, যে অট্টালিকা যত দ্রুত গড়ে ওঠে, ভাঙনের শঙ্কা তার তত বেশি।
তারপরেও কথা থাকে; কিছু কথা তো থাকেই। যে যাবার সে যাবেই, নানা অজুহাত দেখিয়ে সে যাবে।
যে থাকার সে থাকেই, নানা অজুহাতে সে থাকে।