জীবনে প্রথমবার কোন মেয়েকে ভালো লাগাটাই সম্ভবত একটা ছেলের হঠাত করে বড় হয়ে যাওয়ার গল্প। সাধারণত ক্লাস টেনে থাকার সময় এই ব্যাপারটা ঘটে। এই ব্যাপারটা ঘটার পর ছেলেটা কিছু সময় একটা মোহের মধ্যে থাকে। বাংলা বইতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেহারার বদলে তার সামনে ফুটে ওঠে ওই মেয়ের চেহারা। ছেলেটা আয়নার সামনে দীর্ঘসময় পার করে, টিউশনির টাকা দিয়ে গোপনে একটি পারফিউম কিনে আনে। এইসব কাজ গোপনে করতে হয়, সবার সামনে করা যায়না। সে নিজেকে নানান ধরনের সৃষ্টিশীল ব্যাপারেও সংযুক্ত করে। যেমনঃ আজকে গীটার কেনা, কালকে কবিতা লেখা, পরশু ক্যামেরা কিনে ফটোগ্রাফার সাজা – সবই মেয়েটাকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যে সে অন্যান্য ছেলেদের মত না, সে একজন শিল্পী ঘরানার মানুষ, প্রতিভাই তাকে জোর করে এসব করাচ্ছে।
কলেজ লাইফ পর্যন্ত এই মেয়ের সাথে তার টুকটাক যোগাযোগ থাকবে। তারপর এই মেয়ে হুট করে একদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে। ছেলেটা এই সময়ে সামান্য কিছু পাগলামি করবে। বিষ খাবো, জীবনে কোনোদিন বিয়ে করব না ইত্যাদি হাবিজাবি। এইসব পাগলামি গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ফলে এইসব পাগলামি দিয়ে অদৃশ্য মেয়েটাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবেনা। মেয়েটার দেয়া টুক টাক গিফটগুলো ছেলেটা তার ড্রয়ারে এক কোনায় রেখে দেবে কাগজ দিয়ে পেচিয়ে। গিফট বলতে, কয়েকটা ডায়েরি আর কলম। এটা ছেলেদের জীবনের খুব ছোট একটা গল্প। শর্ট ফিল্মের মত। তবে ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। এই ছেলেটা জীবনে যতবার পিছু ফিরে তাকাবে, ততবারই সেই মেয়েটা এসে একবার টুক করে উঁকি দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ছেলেটা জীবনে চলার পথে আরো অনেক মেয়ের সংস্পর্শে আসবে, তাদেরকেও তার ভালো লাগবে। কিন্তু এদের সামনে সে আর হিরো সাজার চেষ্টাটা সেভাবে করবেনা। কারণ এবার সে বড় হয়ে গেছে।
আমি ক্লাস এইটে থাকতে কচি হাতে একজনকে একটা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিলাম। আমার সেই প্রেমপত্র দিয়ে সে সফলতা পেল। মেয়েরা সম্ভবত দুর্বোধ্য উচু দরের উপমা পছন্দ করে না। তাদের পছন্দের উপমা চাঁদ-পাহাড়-নদী-সূর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে আমার কচি হাতের প্রেমপত্রে ভালো কাজ হল। ছেলেটির সম্পর্ক হয়ে গেল। স্কুল পড়ুয়া ছেলের সম্পর্ক বড়জোর কলেজ পর্যন্তই গড়ায়, এর বেশী না। এই নিয়ম এই ক্ষেত্রেও খাটলো। সেই মেয়ে হঠাত একদিন উধাও হয়ে গেল। এরপর ছেলেটা টুকটাক পাগলামি করলো। সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে মেয়েটা তাকে কিছু চিঠি দিয়েছিল। সে চিঠিগুলো পকেটে নিয়ে ঘোরা শুরু করল। আমার সাথে দেখা হলেই ছেলেটা বলতো, চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলব। যে মেয়ে এমন প্রতারক, তার চিঠি পুড়িয়ে ফেলা উচিত।
আমি বলতাম, তা তো অবশ্যই উচিত। সাধারণ আগুনে পোড়ালে হবে না। কেরোসিন ঢেলে আয়োজন করে পুড়াতে হবে। পুড়ে ছাই হওয়ার আগ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে কেরোসিন ঢেলে যেতে হবে আগুনে। দহনের চূড়ান্ত কষ্ট দিতে হবে চিঠিগুলোকে। দুই তিন বছর পার হল। দুই তিন বছর পর সেই ছেলের সাথে আবারও আমার দেখা। সে ওই মেয়ের কথা অনেকখানি ভুলে গেছে। অনেক কথার পর এল সেই চিঠি প্রসঙ্গ। সে বলল, বুঝলে, চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আমি বললাম, এখনই পুড়িয়ে ফেল। আমার কাছে ম্যাচ আছে। সে বলল, এখন তো সম্ভব না, চিঠিগুলো বাসায়, আমি নিয়ে আসিনি।
ও আচ্ছা।’ কিছুক্ষন তার সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা চলল। এক পর্যায়ে সে তার মানিব্যাগ বের করে কী যেন খুজলো। আমি দেখলাম মানিব্যাগের এক কোনায় সেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মেয়ের চিঠিগুলো যত্ন করে রাখা। মানিব্যাগটা পকেটে রেখে সে বলল, চিঠিগুলো বাসায় ফেলে এসেছি বুঝলে? আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, আচ্ছা।