ঘর

ঘর

ফুলশয্যায় শুয়েই বালিশের পাশ থেকে মোবাইলের ভাইব্রেশন টের পেলাম। মৃদুবাতিতে আলো আঁধারি এক নীরবতায় এতক্ষণ শুধু আমাদের দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। সে সাথে কখনো কখনো ওর চুড়ির শব্দ। এ সকল মধুরতা কাটিয়ে তিক্ত এক ভাইব্রেশন বেজে যাচ্ছে। কে? শ্রী? শ্রীপর্ণা মুখার্জী? ও ঠিক আছে?

আমি ফোন হাতে নিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ঘর থেকে দুটো উৎসুক চোখ এদিকে তাকিয়ে আছে নিশ্চয়। সে চোখ দুটো আমার বর্তমানের। তাকিয়ে থাক। কাঁদুক। জ্বলুক। পুড়ুক। যা খুশি হোক। আমার এ মুহূর্তে একা থাকতে ইচ্ছে করছে। মানুষের ধর্মই হলো বর্তমানকে অবহেলা করে প্রাক্তনকে স্মরণ করা। শ্রী কি জানে আজ আমাদের ফুলশয্যা? হয়তো জানে। শ্রী কি কষ্ট পাচ্ছে? ও কি ঠিক ততটাই কষ্ট পাচ্ছে, যতটা কষ্ট আমি পেয়েছি দু হাজার আঠারো সালের জুনের তিন তারিখে?

সে বছর আমার জন্মদিন পালন করার দরকার হয়নি ওর। ও হয়তো কখনোই ওর বিয়ের তারিখ ভুলতে পারবে না কিংবা আমার জন্মদিন। ওর জন্য উপহারের শাড়ি গয়নার ফাঁকে এক জোড়া পেতলের চুড়ি রেখে এসেছিলাম। ওর ফুলশয্যায় কি সে পেতলের চুড়ির শব্দ ওর বর পেয়েছে? অত দামি গয়নার ভীড়ে পুরোনো সেই পেতলের চুড়ি ওর পরার কথাও না। পঞ্চমবারে কল ধরেছি। ওপাশ থেকে শীতল কণ্ঠ।

– গুছিয়ে নিলে তবে?

– নিলাম। আটা রুটি বেলবো কাল সকাল থেকে দুজন মিলে।

– ঘরের দেয়ালে এঁকে সাজাতে পারবে তোমার বউ?

– ওর ইচ্ছে মেঝেতে হবে সবুজ কার্পেট, ছাদ হবে মহাশূন্যের ত্রিমাত্রিক চিত্রকল্প। তাতে জ্বলজ্বল করবে রেডিয়াম ফোটা। হাত ধরে আকাশ দেখে প্রেমের কবিতা বুনবো, ও বুনবে ক্যামিস্ট্রির কেমিকেল রিয়েকশন সহজে মনে রাখার চুটকি কবিতা।

– ছবির মানুষ ভুলে ক্যামিস্ট্রি টিচার মানাবে?

– ছবির ঠিকানা তো মস্ত দেয়াল। সাড়ে আট হাজারে ভাড়া ঘরের দেয়াল ক্যামিস্ট্রি টিচার নিজের মতো করে সাজাক। ও ঘরটা এলোমেলো না হোক।

– আমায় ভুলে আর কারো সাথে বাঁচতে পারবি তুই? বল?

– খুব পারবো শ্রী! আট আনার জীবনে সোয়া সাত আনা অপেক্ষায় কাটিয়েছি। তারপর কিছুটা বিরহে। আমার অনেক সুখ পাওনা। আমার সুখের দায়িত্বও যার পাওনা, সে নিয়েছে।

– আমি যে তোকে এখনো ভালোবাসি!

– বরকে ভালোবাস। আমার জন্মদিনে তোর বরের দেয়া ম্যারেজ ডে গিফটের চেয়ে সস্তা দরের মানুষকে ভালোবাসলে তোর সেবারে আঁকা অষ্টাশি দেবতার ছবিও হঠাৎ হাসবে।

– তবে কি জানিস, মনে হতো কেউ একজন অপেক্ষা করে বসে আছে আমার জন্য। ভালো লাগতো।

– ভালো লাগানোর হলে আজ আমার মিষ্টি ঘরটায় তুই থাকতি শ্রী। জানিস, ওর ঘ্রাণ কত আদুরে?

– রাখছি।

শহর কি ঘুমোয় না? এত এত ঘরে আলো জ্বলে কেন? দিনের ব্যস্ততা ওদের ক্লান্ত করে না? আমার ঘরে ক্লান্ত দু চোখ কি এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে?

ঘরে এলাম। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অপরিচিতা, অথচ আমার সহধর্মিনী আমায় প্রশ্ন করলো, ‘আপনি জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারেন? জীবন তো সমতাবিধান করা প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া না, যে উদ্দেশ্যমতো সব মিলে যাবে! ঠিক না? আমি হাসলাম। মিহি আলোতে সে হাসি দেখা গেলো না। হেসে বললাম, ‘কফি খাবেন?’ ‘উহু, ঘরে তো কফি শেষ। টিব্যাগ আছে। চা খাবেন?’ ‘খাওয়া যায়।’ ‘ও হ্যাঁ, চিনিও নেই।’

‘কাল একটা লিস্ট করে দিয়েন তো..’ ‘আপনার মা যেভাবে আপনার বাবাকে লিস্ট ধরিয়ে বাজারে পাঠাতো? যে লিস্টের শেষে লেখা থাকতো- ফেরার সময় রিক্সায় ফিরবে, হেঁটে আসা যাবে না!’ ‘আপনি কি করে জানলেন?’ ‘আপনার কবিতা পড়ে জেনেছি।’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আমার কবিতাও পড়েছেন?’ ও রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ‘সংসারটা তো আমার। সব জানতে হবে না?’

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত