খোলা চিঠি

খোলা চিঠি

স্যার,
অনেক দিন পর আবার আপনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু লিখতে বসেছি। চারিদিকে যা অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য আপনাদের মতো আদর্শ শিক্ষকদের স্মরণ করা ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অথচ আপনি আজ কতদূরে। তারার দেশ থেকে হয়তো সবই প্রত্যক্ষ করছেন আর মনে মনে ভাবছেন, “ভাগ্যিস আমাকে এমন দিন দেখতে হয়নি।” জানেন, আজ আমারও মনে হচ্ছে ভগবান এই পাপাচারের আঁচ আপনার গায়ে স্পর্শ করতে দিতে চাননি বলেই হয়তো তাঁর কাছে আপনাকে তুলে নিয়েছেন। আজ আমি বারান্দায় বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের মাঝে আপনাকে খোঁজার চেষ্টা করছি। আর আমার মনের সমস্ত কথাকে আপনার উদ্দেশ্যে এই খোলা চিঠিতে লিখে রাখছি। খুব আফসোস হচ্ছে জানেন, আজকের ছোট ছোট নিষ্পাপ মন গুলো জানলোই না আদর্শ শিক্ষাগুরু কেমন হয়।

আপনার কাছ থেকেই শিখেছিলাম শিক্ষক হল মানব চরিত্র গঠনের কারিগর। আর আজ যখন কয়েক জন নিকৃষ্ট জীবের ঘৃণ্যতর কাজের জন্য ‘শিক্ষক’ নামক পবিত্র শব্দটিকে কলুষিত করতে উদ্যত হচ্ছে অনেকেই, কিছুতেই মন থেকে তা মেনে নিতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র ওই বর্বর গুলোর বর্বরতায় আজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কত নিষ্পাপ ফুলের জীবন। ওদের চোখে আজ শঙ্কা আর অবিশ্বাস। অভিভাবকদের চোখে মুখে নিরাপত্তা হীনতার ছাপ। অথচ আমাদের জীবন ছিল কত নিরাপদ। আমাদের শিক্ষা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের অভিভাবককে ভাবতে হয়নি। আপনার মনে আছে স্যার? আমি যখন পড়ার ব্যাচে সকলের মাঝে ঝিমিয়ে পড়তাম আপনি তা ঠিক লক্ষ্য করে, আমাকে পড়ানোর শেষে দাঁড়াতে বললেন। বন্ধুরা বাইরে অপেক্ষা করছিল। আমার কিন্তু একবারও মনে খারাপ চিন্তা আসেনি। কারণ আপনার স্নিগ্ধ চাওনি যে ছিল আমাদের অগাধ ভরসার স্থল। তারপর আপনি বিভিন্ন প্রশ্ন করে আমার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করলেন। শেষে বললেন, “তুই রবিবার আমার সাথে এক ডাক্তারের কাছে যাবি। মনে হচ্ছে হিমোগ্লোবিন কম তাই এমন মরার মতো ঝিমিয়ে থাকিস সারাক্ষণ। তোদের এখন তাজা রক্ত কোথায় টগবগ করে ফুটবে তা না নিস্তেজ হয়ে গেছে। আমাকে দেখ ষাট বছরেও কেমন চনমনে। আমার ছেলে মেয়েরা মরার মতো ঝিমিয়ে থাকলে আমার খুব রাগ হয়।” আপনার দাপটকে আমরা যেমন ভয় পেতাম তেমন শ্রদ্ধাও করতাম। তাই কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়ি গিয়ে মা – বাবাকে বলতেই তারা ঠিক করলো, বাবা আমার সাথে যাবে ঐদিন। প্রথম যেদিন পড়ার ব্যাচে আপনি সবার অভিভাবকদের ডাকলেন। বাবা প্রথম দর্শনেই আপনার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই দেখি আপনি শুভ্র ধুতি – পাঞ্জাবীতে সহাস্যে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। বাবাকে দেখে বললেন, “তুমি কাজ ফেলে এসেছো কেন ভাই? আমি ডাক্তার দেখিয়ে বাস থেকে ওকে যথাস্থানে নামিয়ে দেব। এই বাস তো তোমাদের ওখান দিয়েই যাবে। তাই আসার সময় আগেই ওকে নামিয়ে দেব। আর আমার ছাত্র তাপসকে ফোনে বলে রেখেছি ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দেখিয়ে চলে আসব। আমারও দুটো মেয়ে আছে তাই তোমার চিন্তার থেকে আমার চিন্তা কিছু কম নেই ভাই।” বাবা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আপনার হাত ধরে বলেছিল, “না না একি বলছেন? আমি বাবা হয়ে যা খেয়াল করতে পারিনি আপনি তা করেছেন। আপনার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমার কোনো চিন্তা নেই।” এই বলে বাবা বাড়ি ফিরে যায়। আমার সেদিন একটুও মনে ভয় আসেনি, জানেন স্যার। আপনি বাবার মতোই নিরাপদে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়ে বাস ধরে আবার আমাকে যথাস্থানে নামিয়ে দিয়ে ছিলেন। সেদিন আপনাকে আমার মানুষ মনে হয়নি, দেবতা মনে হয়েছিল।

আপনাদের মতো অমন পিতৃ স্বরূপ শিক্ষক ছিলেন বলেই তো আমরা কখনোই আঁধারে নিমজ্জিত হতে পারিনি। বাংলা অনার্সে আমাদের বীরাঙ্গনা কাব্য ছিল। আপনি ব্যাচে বোঝাতে গিয়ে দশরথের প্রতি কৈকেয়ীর পত্র সাহিত্য বর্ণনা করতে গিয়ে যখন বিগত যৌবনা কৈকেয়ীর শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গ বর্ণনা করছিলেন, কখনোই আপনার দৃষ্টিতে লোলুপতা দেখিনি। আর আজ এই নরপিশাচ গুলো সেই পবিত্র সম্পর্ককেই কেমন অবলীলায় কলুষিত করছে। তাও আবার অপরিণত বুদ্ধির নিষ্পাপ প্রাণের সাথে। সবথেকে খারাপ লাগে কোথায় জানেন এরা অন্যায় করেও আবার দিব্যি মাথা উঁচু করে বাস করছে সমাজে। অথচ আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, “তোরাও একদিন বড় হয়ে মস্ত বড় শিক্ষক হবি। তোদের মাঝেই যেন আমার শিক্ষা বেঁচে থাকে। স্বামীজির ভাষায়, ‘জন্মেছিস যেকালে একটা দাগ রেখে যা।’ সেই দাগ যেন স্বচ্ছ হয়। কখনোই অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। এমন কোনো কাজ কখনো করবি না, যাতে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লজ্জা হয়। স্বচ্ছ থাকা খুব প্রয়োজন জীবনে। সৎ থাকলে দেখবি মাথা কখনো নিচু হবে না সহজে। জানবি অন্যায় করা আর সহ্য করা সমান অপরাধ।” অথচ দেখুন স্যার, আজ এই স্বচ্ছতারই কত অভাব চারিদিকে। অন্যায়কারীদের কেমন নির্দ্বিধায় সমর্থন করছে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ। তবুও কোথাও আপনার মতো কিছু আদর্শ শিক্ষক এখনো আছেন যাঁরা হয়তো আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁরা এগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। আর আজও তারা সমাজ থেকে বিলুপ্ত হননি বলে সমাজ এখনো টিঁকে আছে। কিন্তু চারিদিকে যা অবস্থা তাঁদের মনেও আজ একরাশ চিন্তা। তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি আদেও নিরাপদ? বিশাল বড় এক একটা প্রশ্ন চিহ্ন তাঁদের মনে সব সময় ঘুরপাক খাচ্ছে।

আজ এই দুর্বিপাকের দিনে আমাদের মতো অসহায় শিক্ষার্থী যারা কোনো সন্তানের মা তারা ভীষণ ভাবে চিন্তিত তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে। আপনার মতো শিক্ষকদের ভীষণ প্রয়োজন সমাজের এই অবক্ষয়ের দিনে। যাঁর মেরুদন্ড সোজা, মুখে স্বচ্ছতার ছাপ। ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্যে দীপ্ত দুটি চোখ। ফিরে আসুন পুনরায় এ ধরিত্রীর বুকে ঠিক আগের মতোই একজন আদর্শ শিক্ষক রূপে।

—ইতি
আপনার প্রাক্তন ছাত্রী (এক অসহায় মা)

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত