রবিবাসরীয় সকাল। গৌতমবাবু বারান্দায় বসে বসে চা সহযোগে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ পাশে শ্যামলবাবুদের বাড়িতে ভীষণ চিৎকারের আওয়াজে শীতের সকালের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। শান্তিভঙ্গের ফলে গৌতমবাবুর মুখ বিরক্তিতে ভরে গেল। মনে মনে বললেন, “আহ্! এদের জ্বালায় যদি শান্তিতে একদিনও থাকা যায়!”
খবরের কাগজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে চিৎকার-গণ্ডগোলের প্রতি মনোনিবেশ করে দেখার বাসনা জাগলো গৌতমবাবুর।
তিনি কিছুক্ষণ শোনার পর বুঝলেন, শ্যামলবাবু আর তাঁর স্ত্রী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কার প্রতি যেন শাপ-শাপান্ত করছেন। ক্রমশ গালিগালাজের পরিমাণ এবং গুণগত মান উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকল। পাশাপাশি কণ্ঠস্বরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শেষে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, পাড়ার লোকজন এসে শ্যামলবাবুদের বাড়ির সামনে ভীড় জমাতে লাগলেন- কেউ অতিষ্ঠ হয়ে; কেউ আবার মজা লুটতে; আবার কেউ বা সেই গণ্ডগোলে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে। গৌতমবাবুও বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে এগিয়ে গেলেন শ্যামলবাবুদের বাড়ির দিকে।
তিনি দেখলেন, ঐ প্রাণঘাতী গণ্ডগোলের মূল লক্ষ্য রাধা।
রাধা শ্যামলবাবুদের বাড়ির ছোট-বড় কাজকর্মগুলো করে- অর্থাৎ ঐ ‘কাজের লোক’। রাধা শ্যামলবাবুদের বাড়ির উঠোনে অত্যন্ত ভয়ার্ত আর সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর শ্যামলবাবু, তাঁর পত্নী জয়িতাদেবী এবং পাড়ার অন্যান্য চেনা-অচেনা ব্যক্তিবিশেষ তার প্রতি ক্রমাগত বাক্যবাণ হেঁকে চলেছেন। ‘ছোটলোক’, ‘চোরের বাচ্চা’, ‘ইয়ের বাচ্চা’ মানে ‘বরাহনন্দন’-র চলতি ভাষা, ‘ইতর’, ‘হাঘরে-হাভাতে’, ‘অভাগী’ এবং অন্যান্য চলতি বাংলা ‘স্ল্যাং’ সবই যথেচ্ছ পরিমাণে এবং একাধিকবার ব্যবহৃত হচ্ছে।
গৌতমবাবু অনেক কষ্ট করে ধাক্কাধাক্কি খেয়ে শেষ পর্যন্ত আসল রহস্য উদ্ঘাটন করলেন। ব্যাপার খুব গুরুতর এবং গুরুগম্ভীর।
শ্যামলবাবু সক্কালবেলা বাজার সেরে বাড়ি ফিরে রান্নাঘরে জিনিসপত্র রাখেন এবং তার সঙ্গে দু’হাজার টাকার একটা কড়কড়ে নতুন নোটও রাখেন; ভাবলেন পরে সময় মতো সরিয়ে রাখবেন। তারপর রাধা ঘর-দোর মুছতে ঢোকে। প্রায় দশ মিনিট পর শ্যামলবাবু টাকাটা নিতে এসে দেখেন, সেটা আর নেই- যেন পি.সি.সরকারের যাদু! ব্যস; তারপরই শুরু হল আধুনিক কুরুক্ষেত্র, যার খলনায়ক………..থুড়ি, খলনায়িকা হল রাধা।
রাধা পাড়ার আরও অনেকের বাড়িতেই কাজ করত। তাঁরাও এসে ব্যাপারটা বুঝলেন এবং অত্যন্ত ভয়ঙ্করভাবে আঁতকে উঠলেন। আর তারপর তাঁরাও যোগদান করলেন ঐ কুরুক্ষেত্রে। সকলে মিলে ঠিক করলেন, রাধাকে এই গোটা অঞ্চল থেকেই বরখাস্ত করা হবে। এবং ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন রাধাকে এই অঞ্চলে দেখা যায়; তাহলে সে এই অঞ্চলে ঢুকবে ঠিকই, কিন্তু আর জ্যান্ত অবস্থায় বেরোতে পারবে না।
পাড়ার অনেক অতি-উৎসাহী দর্শক রাধাকে তখনই চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া বা পুলিশে খবর দেওয়ার মতো মূল্যবান এবং সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করছিলেন। কিন্তু গৌতমবাবু এবং তাঁর মতো কিছু বয়স্ক ও দয়াময় মানুষের জন্য রাধা সে যাত্রা রক্ষা পেল; সে পালিয়ে বাঁচল।
***********************
পরদিন বিকেল চারটে নাগাদ গৌতমবাবু আর তাঁর স্ত্রী বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন; এমন সময় দেখলেন, এক অল্পবয়সী ছোকরা একটা বিশাল পার্সেল হাতে করে এসে তাঁদের সামনে দাঁড়ালো। শ্যামল বসুর বাড়ির খোঁজ জিজ্ঞেস করতেই গৌতমবাবু শ্যামলবাবুর বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন।
গৌতমবাবু আর তাঁর স্ত্রী ভীষণ উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর শ্যামলবাবুর স্ত্রী জয়িতাদেবী এসে ঐ ছোকরার কাছ থেকে পার্সেলের প্যাকেটটা নিয়ে তাকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন। ছোকরাটি একটা দু’হাজার টাকার কড়কড়ে নতুন নোট পকেটস্থ করে চলে গেল।
গৌতমবাবুর স্ত্রী জয়িতাদেবীকে শুধোলেন, “কী ব্যাপার জয়িতা? কী কিনলে?”
জয়িতাদেবী হাসিমুখে জানালেন, “আর বলবেন না দিদি। কিচুদিন আগেই নুতুন ফোন কিনিচি একটা; আর নেট ঘাঁটাও শিকলুম। কাল নেটে এক জাগায় দেকলুম, ঊনিশ শো নিরুনব্বুই টাকায় হেব্বি অফার দিচ্চে একখান – তাতে আচে একখান ঢাকাই জামদানি শাড়ি আর সঙ্গে পাথর বসানো গলার হার, কানের দুল, সিটি গোল্ডের একজোড়া হাতবালা আর একখান নাকছাবি। বুজলেন কিনা?”
গৌতমবাবুর স্ত্রী তো শুনে থ মেরে গেলেন।
জয়িতাদেবী তখনও বলে চলেছেন, “ওরা দেকালে যে, একদিন পরেই বাড়ি বয়ে এসে দিযাবে। অর্ডার দিলুম তাই একখান। তবে জানেন, উনাকে না বলেই দিলুম। উনি একন তো বাড়ি নেই; তাই জানতিও পারবেন না জিনিসটা কেনার কতা। উনি কিচুতেই দিতেন না। বড্ড হাড়কিপ্টে। ব্যাবা গো! আর সহ্য হয় নাকো।” – এই বলে তিনি মুখে কেমন ভেঙচি কাটলেন।
গৌতমবাবুর স্ত্রী বললেন, “তাহলে দু’হাজার টাকা কোথায় পেলে? জমানো টাকা?”
জয়িতাদেবী উত্তর দিলেন, “না বাবা। উনি তো হাতখচ্চার টাকাও দ্যান না।”
গৌতমবাবুর স্ত্রী খুব অবাক হলেন, “সে কী? তবে টাকা পেলে কী করে?”
জয়িতাদেবী দুষ্টু হাসি উপহার দিয়ে চোখদুটো নাচিয়ে বললেন, “সে জোগাড় করে নিতে হয়। আর ওটা আমি একন হেব্বি পারি- এক্কেবারে ‘এক্ছপার্ট’।”
গৌতমবাবু চশমাটা খুলে কাচটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে মুচকি হেসে মৃদুস্বরে বললেন, “বাঃ! চমৎকার।”
জয়িতাদেবী উৎসাহ সহকারে হাতের প্যাকেটটা রাস্তাতেই খুললেন গৌতমজায়াকে দেখানোর অভিপ্রায়ে। প্যাকেট খুলতেই সকলের চক্ষু চড়কগাছ।
সর্বনাশ! প্যাকেটের ভেতরের বাক্সের মধ্যে তো প্রয়োজনীয় জিনিস বলতে কিছুই নেই- শুধু কয়েকটা ছেঁড়া কাপড় আর কিছু পাথরের টুকরো ভেতর থেকে যেন দন্ত বিকশিত করে নির্লজ্জভাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে।
জয়িতাদেবীর হাত থেকে বাক্সটা সশব্দে রাস্তার উপর পড়ে গেল। তিনি হাউমাউ করে উঠে প্রলাপ বকতে লাগলেন। আর ওদিকে গৌতমবাবুর স্ত্রীও হতবাক। শুধু গৌতমবাবু আবার একবার মুচকি হেসে অস্ফুটে বললেন, “আহা রে! অভাগী।”
জয়িতাদেবী হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। তিনি বোধহয় ততক্ষণে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন – এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করার জন্য তিনি তাঁর রাধাগোবিন্দকে স্মরণ করবেন; নাকি গোবিন্দকে ডাকবেন; অথবা রাধাকেই ডাকবেন- এটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
তিনি আজও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে দোদুল্যমান।।
………………………..সমাপ্ত………………………………..