আমাদের পাশের বাড়ির এক ভাই প্রায়ই তার স্ত্রীকে মারধর করতেন। নিয়মিতই তাদের সংসারে কলহ লেগে থাকত। ছোট পরিবার। সংসারে স্বামী স্ত্রী দুজন ছাড়াও তাদের পাঁচ বছর বয়সী একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা মায়ের খুবই ভক্ত। বাবাকে একদমই পছন্দ করত না।
একদিন দুপুরবেলা আমাদের বাড়ির কয়েকজন মিলে পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে বসে বসে গল্প করছিলাম। ভাইয়ের ছেলেটাও সেখানে ছিল। আমি তার সাথে দুষ্টামি করছিলাম। হঠাৎ সে আমাকে বলল, কাকা আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি ঘর থেকে একটু পানি খেয়ে আসি। ৫ মিনিট পরই হঠাৎ ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে পুকুর পাড়ে এসে হাজির হলো। আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। ছেলেটা তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে বলল, কাকা তাড়াতাড়ি আপনারা সবাই আমাদের ঘরে আসেন, আমার আব্বু আমার আম্মু কে মেরে ফেলছে। তাড়াতাড়ি আমরা সবাই তাদের ঘরের দিকে ছুটলাম। যেহেতু প্রায়ই তারা ঝগড়াঝাঁটি এবং কলহে লিপ্ত থাকে সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের অন্য কোন চিন্তা মাথায়ই আসলো না।
ঘরের কাছাকাছি এসেই আমরা কিছুটা থমকে দাঁড়ালাম। ঝগড়াঝাঁটি হলে তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা যেত, কিন্তু আজ সেরকম কিছুই শোনা গেল না। আবার ঘরের দরজাও বন্ধ। পরক্ষণেই চিন্তা করলাম, ভাই হয়তো দরজা বন্ধ করে ভাবিকে পিটিয়েছে, যাতে বাইরে থেকে এসে কেউ তাকে বাধা দিতে না পারে। অথবা এমন কিছু একটা দিয়ে আঘাত করেছে, হয় ভাবি অজ্ঞান হয়ে গেছে অথবা আরও খারাপ কিছু ঘটেছে। আর বাচ্চাও যেহেতু এভাবে কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে এসেছে, তার মানে নিশ্চয়ই সে কিছু একটা দেখেছে। তাড়াতাড়ি আমরা সবাই চিৎকার দিয়ে ভাইয়ের ঘরের দরজায় আঘাত করতে লাগলাম দরজা খোলার জন্য। পাশ থেকে একজন মুরুব্বী চিৎকার দিয়ে ভাই কে উদ্দেশ্য করে বাইরে থেকে বলতে লাগলো, “মাইরা ফালাইছে রে… মাইয়াটারে মাইরা ফালাইছে! ওরে শয়তান তাড়াতাড়ি দরজা খোল! তুই নিজে তো ফাঁসবি-ই সাথে আমাদের বাড়ির সবাইকেও ফাঁসাবি।”
ভাই-ভাবির কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে এবং দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে আমরা বাইরে থেকে আরো জোরে জোরে দরজায় আঘাত করতে লাগলাম। ইতিমধ্যেই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশ-পাশের বাড়ির ছেলে বুড়ো সবাই এসে হাজির। ছেলেটা আমার হাত ধরে আমাকে দরজার পাশেই ঘরের বেড়ার দিকে ইঙ্গিত করল। আমি সেদিকে তাকাতেই একটা ফুটো দেখতে পেলাম। সম্ভবত সে আমাকে সেই ফুটো দিয়ে ঘরের ভিতরে কি হচ্ছে তা দেখতে বলছে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হলো না। হঠাৎ দরজা খুলে গেল। ভাই মুখ কাচুমাচু করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার পুরো শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে। পরনে শুধু একটা লুঙ্গি। ভিতরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলাম ভাবি মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে মাথা নিচু করে খাটের উপর বসে আছে। দুজনের অবয়বেই বুঝা যাচ্ছে তারা ভীষণ বিব্রত। ছেলেটা দৌড়ে তার মায়ের কোলে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল।
আমরা যা বোঝার বুঝে নিলাম। লজ্জায় আমাদের কান দিয়ে রীতিমত ধোঁয়া বেরুচ্ছে। কেউ কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে দ্রুত সবাই সেখান থেকে সরে পড়তে লাগল। যাওয়ার সময় খালি বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ মুরব্বি জরিনার মা বলে উঠলো, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ কী যামানা আইলো, দিন-রাইত কিছুই মানে না।” সবাই সরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বাচ্চাটার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।