বিয়ের রাতে আমাকে বলা রিমির প্রথম কথা ছিল “আপনার কাছে একটা সিগারেট হবে?” ওর মুখে একথা শুনে আমি অবাক হলাম।ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হওয়া আল্ট্রা মর্ডান মেয়ে রিমি।তার ওপরে নামিদামি প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে সে।তার জন্য হয়ত এটা নরমাল ব্যাপার।আমি বললাম,’আমি তো স্মোক করি না।’এটা শুনে ও হতাশ দৃষ্টিতে বললো,’আসলে অনেক দিনের অভ্যাস তো।সহজে ছাড়তে পারি না।সমস্যা নেই আস্তে আস্তে ছেড়ে দিব’..সেদিন রাতে আমার মুখে হাসি ফুটানোর জন্য ওর শেষের দুইটা কথাই যথেষ্ট ছিল।
তবে পরের দিন আমি জানতে পারলাম রিমি আমার এক ছোট ভাইকে দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট আনিয়েছে।এটা নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে গেলে ও খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললো,’মেলাদিন আগের অভ্যাস সহজে ছাড়া যায় না।আপনি দয়া করে এটা নিয়ে কোন কথা বলবেন না।আপনি বলেন কবে ঢাকায় শিফ্ট হবেন?’।আমি বললাম,’এইতো কদিন পরেই।’
ঢাকায় আইটি ফার্মে জব করি আমি।রিমি আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মেয়ে।ওর বাবা আর আমার বাবার জোরাজুরিতেই বিয়েটা হয় আমাদের।আমি কিছুই জানতাম না।বাবা আমাকে দুইদিন ছুটি নিয়ে আসতে বললেন।আমি এসে দেখলাম বিয়ের সব আয়োজন শেষ।আর আমাকে পাত্রীর ছবি দেখোনো হল।অদ্ভুত সুন্দর রিমি।প্রথম দেখাতেই যে কারো পছন্দ হতে বাধ্য।ওকে ছোটবেলায় দুই একবার দেখেছিলাম।তবে চেহারা মনে ছিল না।
বিয়ের এক মাসের মধ্যে রিমিকে ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটে আনা লাগলো।আনতেই হোত।বিয়ের পর বুয়ার রান্না আর কয়দিনই বা খাওয়া যায়।ও টুকটাক রান্না পারত।বুয়া হেল্প করত।সবমিলিয়ে শুরুর দিনগুলা ভালোই কাটছিল।তবে সমস্যার শুরু হল কিছুদিন পর থেকে।আমি প্রতিদিন অফিস থেকে এসে দেখতাম ও গভীর ঘুমে অচেতন।ঘুম থেকে উঠত একদম রাতের খাবার সময়।তখন ওকে বলতাম একদম ভরা সন্ধ্যাবেলা এভাবে ঘুমানো ঠিক না।ও বলত সারাদিন ক্লাস করে এসে ওর নাকি খুব মাথা ব্যাথা।ঘুম থেকে ওঠার পর দেখতাম ওর চোখ লাল।এভাবে একদিন দুইদিন করে প্রতিদিনই একই জিনিস ঘটতে থাকে।আমিও খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিচ্ছিলাম যদিনা সেদিন আমার অফিস ছুটি না থাকতো।
সেদিন হঠাত রিমির ফোনে একটা কল আসে কলটা ওর বান্ধবী তমার।ওরা একসাথে পড়ে।তো রিমি বললো ওর নাকি এসাইনমেন্টের কাজ আছে তমার সাথে।বাইরে যাওয়া লাগবে।আমিও কিছু বললাম না।বিকালে রিমি যখন বাসায় আসলো তখন ওর চোখ মুখ দেখে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম।সাদা চোখ এতটাই লাল যে কেও দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে।আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হইছে।ও বললো ও নাকি এসাইনমেন্ট করার পর খুব টায়ার্ড।তারপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও রুমে চলে গেল।এবং যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ল।
এই সব ব্যাপারগুলা নিয়ে ওর সাথে কথা শুরু করার আগেই একদিন ও অসুস্থ হয়ে পড়ল।আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম।কিন্তু ডাক্তারি চেকআপের পর জানতে পারলাম ও প্রেগন্যান্ট।আমি এতটাই খুশি ছিলাম যে আমি কিছুদিন আগের টপিকটা নিয়ে কথা বলতেই ভুলে গেলাম।তবে ওর যতটা খুশি হওয়ার কথা ছিল ও ততটা খুশি হলো না।শুধু শুকনো মুখে বলেছিল,’ভালোই তোহ..’
তারপর আমি ওর বেশি বেশি কেয়ার নিতে শুরু করি।সবসময় ওর সাথে থাকার চেষ্টা করি।ও তখন আর স্মোক করতো না।শুধু দিনের একটা নির্দিষ্ট টাইম বাইরে যেতে চাইতো।মোটামুটি জোর করে বাইরে যাবার কথা বলতো।আমি প্রথম কিছুদিন যেতে দিতাম না।কিন্তু পরে সে ভার্সিটি যাবার নাম করে বের হতো।আমি অফিস থেকে এসে বুয়ার মুখ থেকে শুনে ওকে জিজ্ঞেস করলে বলতো কাজ ছিল একটু ভার্সিটিতে..
ঠিক ছয়মাস পরে এক রাতে রিমির প্রচন্ড বমি শুরু হয়।সেই সাথে ছোপ ছোপ রক্ত যেতে থাকে।ও ভয় পেয়ে আমাকে ডাকলো।আমি দ্রুত ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।বিভিন্ন পরিক্ষা নিরিক্ষার পর ডাক্তার জানালো রিমির পেটের বাচ্চাটার কোন নড়াচড়া বা হৃদস্পন্দন তারা খুঁজে পাচ্ছে না।দ্রুত অপারেশন করে সেটাকে বের করে ফেলতে হবে।নাহলে রিমিরও বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।এরপর রিমির অপারেশন হলো।মরা বাচ্চাটা বের করে ফেলা হল।তবে বাচ্চা মারা যাওয়ার কারণ হিসেবে ডাক্তার যেটা বললো সেটা শুনে আমি প্রচন্ড শক খেলাম।বেবির শরীরে ক্যাফেইন নামক এক বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে।আর এই ক্যাফেইন নাকি ইয়াবার প্রধান রাসায়নিক উপাদান..
সপ্তাহখানেক পর রিমিকে বাসায় নেওয়া হলো।ওর চোখমুখ প্রচন্ড শুকিয়ে গেছে।ডাক্তার ওকে রেস্ট নিতে বলেছে।পরদিন অফিসে আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলাম,এই এডিক্টেড মেয়ের সাথে থাকলে আমার পুরো জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে।যেকোন দিন নেশার টাকার জন্য আমাকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না এই মেয়ে।
এইসব হাজারো চিন্তা নিয়ে আমি সেদিন সন্ধায় বাসায় ঢুকলাম।ঢোকার পর দেখলাম রিমি ওর সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে জায়নামাজে বসে আছে।প্রথমবার ওকে এভাবে দেখে আমি আরও বেশি অবাক হলাম।ওর কাছে যেতেই ও ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে আমার দিকে মাথা তুলে বলল,”এক্সিডেন্টে মা মারা যাবার শক নিতে পারি নি আমি।বন্ধুর পরামর্শে একদিন সিগারেট খাই আর তারপর অন্যগুলোও..বিশ্বাস করো আমি ভাবতে পারিনি এমন কিছু হয়ে যাবে।আমি আমার নিষ্পাপ বাচ্চাকে খুন করেছি।আমি জানি আমার এই পাপের ক্ষমা নাই।তবুও আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেয়া যায় সোহেল?.শেষবারের মত একটা চান্স ভালো হওয়ার?.’ আমি ওর চোখের দিকে দেখলাম।চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে ওর। আমার চোখও যে পানিতে ভিজে আছে এটা কি ও দেখতে পাচ্ছে?? হয়তবা পাচ্ছে…