আমার যখন দু’বছর বয়স তখন আমার বাবা আমাকে আর মাকে একা করে আল্লাহ্’র ডাকে সারা দিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান । সেই মূহূর্তে মা আমাকে নিয়ে অসহায় । কারণ বাবা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের জন্য দাদু বাড়িতে আর ঘর হয়নি থাকার জন্য । দাদা,দাদু,কাকা,ফুফু সবার আসল রুপ বেড়িয়ে এসেছিল । তার উপর আমি ছিলাম মেয়ে। ছেলে হলে কি করত আমার জানা নেই। তবে তারা তাদের বংশের মেয়েকে তাদের বাড়িতে রাখতে নারাজ ছিলেন । মা আমাকে নিয়ে সোজা নানু বাড়ি চলে আসলেন । তখন মামারা সবাই সাদরে আমাদের দুজনকে গ্রহন না করলে হয়ত আজকের আমি এতদূর আসতে পারতাম না ।
বাবা চলে যাওয়ার পর মা পারতেন আবার নতুন সংসার গড়তে । কিন্তু তিনি তা করেন নি । মাত্র দুই বছরের আমিকে নিয়েই সে বাকী দিনগুলো কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । তখন থেকেই আমার অবিভাবক আমার মামারা । তবে দাদু বাড়ি থেকে আমার এক ফুফু আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন । তারও নিজের সংসার ছিল । মুখের খোঁজটুকু রাখতেন এটাই অনেক কিছু ছিল । ভাইয়ের মেয়ে বলে কথা । একেবারে ফেলে দেওয়া হয়ত তার উচিত মনে হয়নি ।
দাদু বা কাকারা কখনো খোঁজ খবর তেমন নেন নি । তবে আমি যখন বিয়ের উপযুক্ত হলাম তখন তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে নেমে পরলেন । যেহেতু আমি ওই বংশের মেয়ে । বাবার সম্পত্তিতে আমার অধিকার রয়েছে । তারা সেই অধিকার দিতে দ্বিধাবোধ করছিলেন । তাই ছোট কাকা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন তার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার । যেন বংশের মেয়ে বংশেই থাকে আর সম্পত্তিও। একে তো বাবা নেই তার উপর এরা কখনো আমার খোঁজ নেননি । আজ কেবল সম্পত্তির জন্য এমন ব্যবহার আমার মা মানতে পারেননি । সম্পত্তি না পাই তবুও এমন প্রস্তাব মেনে নেওয়া সম্ভব নয় ।
এই ছোট থেকে বড় হওয়ার প্রতিটা মূহূর্তে বাবাকে ভীষণভাবে মিস করেছি আমি । ছোট বেলায় সবাই যখন বাবার হাত ধরে হাঁটা শিখেছে তখন আমি আমার বাবাকে কাছে পাইনি । বাবার কাঁধে চড়ে ঈদগার মাঠে যাওয়া হয়নি আমার । দাদু বাড়ি থেকে বাবার স্মৃতিস্বরূপ তেমন কিছু পাইনি । তবে বাবার একটা ডায়েরি আর একটা বইয়ের সেল্ফ ছিল সেটা আমি ছাড়তে চাইনি । ডায়েরিতে বাবা তার সাথে ঘটা প্রতিটি কথা কি সুন্দর করে লিখে রাখতেন! যখনই ডায়েরিটা পড়ি তখন বাবাকে অনুভব করতে ইচ্ছে করে ভীষণ । বাবাকে একটু ছুঁয়ে দিতে মন চায় । একবার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে মন ছটফট করে । কিন্তু পারি না ! মায়ের কাছে শুনেছি বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন । সৎ মানুষ ছিলেন । আমার বাবা তো ! তিনি ভালো হবেন না তো কে হবে !
যখন কেউ তার বাবার গল্প করে তখন মনের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করি । যখন কোনো সমস্যায় পরি তখন মনে হয় ইস! যদি আজ বাবা থাকতেন তবে হয়ত তার কাছে আমার সমস্যার সমাধান মিলতো। বাবা থাকলে হয়ত আমার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত । জীবনে সমস্যা কি তাই হয়ত বাবা আমাকে বুঝতে দিতো না । বাবার প্রথম রাজকন্যা হতাম আমি ! বাবার সাথে রাজপুত্রের গল্প করাও হয়নি আমার । জীবন চলে যাচ্ছে শুধু বাবা মানুষটা নেই।
বাবাকে হারিয়ে জীবনের অনেক কিছু পাইনি আমি । তাই হয়ত সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন’যে মেয়ে তার বাবাকে পায়নি সে তো জীবনের এক-তৃতীয়াংশ পায়নি’ সত্যিই তাই ! আজ কত গুলো বছর বাবাকে হারিয়েছি । জীবনে আর চাইলেও বাবা কে পাবো না । বাবা বলে একবার ডাকা হবে না । বাবা যে কি তা বলে বোঝানোর নয় । যার বাবা নেই একমাত্র সেই এই অভাবটা বুঝতে পারবে । এই জীবনে বাবাকে পাইনি । আল্লাহ্’র কাছে দোয়া করি যেন পরকালে বাবার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি । একবার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারি ।