সংসারের গল্প

সংসারের গল্প

দরজা খুলতেই দেখি স্বামী ভদ্রলোক বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। উঁকি দিয়ে দেখি ব্যাগ ভর্তি কেবল বিভিন্ন রকম শাক। আমার ভয়ানক মেজাজ খারাপ হলো। শাঁক বাছাবাছি করা আমার অপছন্দের কাজগুলোর একটি । সাতদিন হয় হেল্পিং হ্যান্ড ছুটিতে গেছেন। কবে ফিরবেন তার ঠিক নেই। একা একা এতো শাঁক বাছতে হবে ভেবে মাথা গরম হয়ে গেল। আগপাছ চিন্তা না করে রাগে তার হাত থেকে ব্যাগ টান দিয়ে আমি মেঝেতে ছুড়ে ফেললাম। আনিস আমার কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চিৎকার করে বললাম,

— তিন দিনের কথা বলে বুয়া সাতদিন হলো আসে না। আজও ফোন দিয়েছি বলে ছেলের অসুখ আসতে দেরী হবে আর তিনি কিনা এতো রাতে দুনিয়ায় শাক- সব্জি নিয়ে এসেছেন। আরে দুই / চারদিন এসব না খেলে কি হয় !!?? আনিস অপরাধী গলায় মিনমিন করে বলল,

— তুমি “পালং ডাল” ভাল রাঁধ তাই রাস্তায় কিনতে থেমেছিলাম। শাকওয়ালা সস্তায় আরও কয়েক পদ জোর করে হাতে ধরিয়ে দিল। আমার কিছুটা খারাপ লাগলো । সে খেতে ভালবাসে । সামান্য পালং ডালই তো খেতে চেয়েছে অথচ আমি কিনা বুয়া না আসার রাগ এতক্ষন তার উপর ঝারলাম।

আনিস গোসল করে বেরুলে “সরি” বলব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু তার বিনা কারণে বাচ্চাদের খেলনায় লাথি মেরে….
“ঘর এতো এলোমেলো কেন!!”…বলে চিৎকার করা শুনে মত পাল্টালাম। এমন মানুষের কাছে “সরি” বলার প্রশ্নই উঠে না। আমাদের বেডরুমের বিছানাটা বিশাল। রাতে সেই বিশাল খাটের দুই প্রান্তে আমরা দুইজন ঘুমাই। আনিস গায়ে হাত- পা লাগা পছন্দ করে না। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বিছানার একপ্রান্ত থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, উত্তরে অপর প্রান্ত থেকে আমিও হাসি। আজ সকালে হাসাহাসি পর্ব বাদ গেল । সে মুখ গোমড়া করে অফিস যাচ্ছে । দরজার কাছে পৌঁছে ঘাড় ঘুরিয়ে হঠাৎ বলল,

– তুমি আজকাল আমাকে আর ভালবাস না।

– তাই নাকি.. !! কিভাবে বুঝলে??

– মাঝে মাঝে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকো দেখেছি।

– জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো মানে স্বামীকে ভাল না বাসা নাকি ?? সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল । ভদ্রলোক এমন মানুষ অফিসে গেলে সচরাচর ফোন করেন না। অথচ দুপুরে হঠাৎ তার ফোন। গলার স্বর অসম্ভব গম্ভীর।

– সুমি, আজ থেকে তোমার ফেইসবুক চালানো বন্ধ। আমি বিষ্মিত হয়ে বললাম,
— কারণ কি ?

– তোমার পোস্ট করা পর পর তিনটা ছবিতে দেখলাম একই লোক ‘বিউটিফুল ‘ বলে কমেন্ট করেছে । আমার ধারণা সেজন্য তোমার আজকাল অহংকার হয়েছে।

– কিসব আজেবাজে কথা বল !! সবার ছবিতেই খুশি করতে অমন কিছু মিথ্যে কথা কেউ কেউ লিখে । এতে অহংকার হবার মতো কি আছে..?!!

— কই আমাকে তো কেউ হ্যান্ডসাম লিখে না। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি ফেবু বন্ধ না কর এক মেয়ে আজ রাতেই আমাকে “হ্যান্ডসাম” লিখবে।

– আজ রাতেই কেউ একজন লিখবে জানলে কিভাবে? তুমি নিজেই অনুরোধ করে লেখাবে নাকি…??

আনিস উত্তর না দিয়ে ফোন কেঁটে দিল। আমার মেজাজ বিশ্রী রকম খারাপ হয়ে গেল। বাজারের ব্যাগ ছুড়েঁ ফেলার অপরাধেই যে তিনি এমন করছেন জানি। তবে এবার বাড়াবাড়ি করছেন মনে হলো। রাতেও সে ফিরল দেরী করে, মুখ থমথমে। .. ব্যাপারটা এতো দূর গড়াবে বুঝিনি। মনটাই ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । গেষ্ট রুমের বিছানার উপর বারান্দা থেকে তোলা কাপড়- চোপর রেখেছিলাম। সময় পাইনি বলে সেগুলো তখনও ভাঁজ করা হয়নি। আনিস সেসব দেখে বিকট চিৎকার শুরু করল ।

— “বিছানায় এতো কাপড় কেন ? ঘর এতো এলোমেলো। সংসারে তো তোমার মন নেই। কোন কাজ- কর্ম নেই, আছে কেবল সারাদিন বসে বসে ফালতু লেখালেখি করা” প্রচন্ড কষ্টে আমি বাকরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য।

আমার টিভি সিরিয়াল দেখার প্রতি আসক্তি নেই। মার্কেটে মার্কেটে ঘোরাঘুরির স্বভাব নেই। আমার দামি দামি জামা কাপড় না হলেও চলে। তবে আমি পড়তে ভালবাসি। আমি সময় পেলে ফেইসবুক চালাই তবে সেটা ঘন ঘন সেল্ফি আপলোড দিতে নয়। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসি বলেই সময় পেলে অনলাইনে থাকি । আর টুকটাক লেখালেখি করি সেটাও শখে, কারো ক্ষতি করতে নয়। সে কি করে পারল সেসব কথা তুলে আমাকে আঘাত করতে!?? রাগে, কষ্টে, অভিমানে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে চোখ ফেটে পানি বেড়িয়ে এলো। কি দুর্ভাগ্য আমার এমন লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে যে কিনা স্ত্রীকে নুন্যতম সম্মান দিতেও জানে না। যার কাছে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য নেই। আমার ইচ্ছে করছে এই লোকের থেকে সারাজীবনের জন্য একেবারে দূরে কোথাও চলে যেতে।

— ভাত খেতে এসো।

আনিস চুপচাপ ভাত খেতে বসেছে। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার পাশে দাড়িয়ে আছি। খাবারের আয়োজন তেমন বিশেষ কিছু না। সাদা ভাত, রুই মাছ, বেগুন ভাজা আর পালং শাক দিয়ে ডাল । গতকাল রাতে “পালং ডালের” কথা সে বলেছিল তাই রান্না করেছিলাম। আনিস খেতে বসে ‘পালং ডালের’ বাটি দেখে কেমন থমকে গেল। তার কঠিন মুখখানা হঠাৎই কেমন যেন বদলে গেল। নাহ, মুখখানা এখন আর কঠিন দেখাচ্ছে না কেমন কোমল, অপরাধি ধরনের দেখাচ্ছে।

– রান্না কেমন হয়েছে? ভাল? আনিস কথা বলছে না। নিচু হয়ে চুপচাপ খাচ্ছে। একবার কেবল আস্তে করে বলল,
– হুম।

হঠাৎ আমার মনের আকাশে জমে থাকা অভিমানের কালো মেঘগুলো ভীষণ দ্রুত কেঁটে গেল।। ” আনিস কাদঁছে।” সংসারজীবন কল্পনার মতো সুন্দর নয়। কল্পনায় আমরা সংসারের যে ছবি আঁকি তা কেবল ভালবাসার। বাস্তবজীবনে এখানে ভালবাসার পাশাপাশি রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, ভুল বোঝাবুঝি, মান অভিমানও থাকে। তবুও জীবন “অসুন্দরও” নয়।

যে মানুষটার দিকে একটু আগে ঘৃণায় আমার তাকাতে ইচ্ছে করছিল না, চিরকালের জন্য যার থেকে দূরে সরে যেতে ইচ্ছে করছিল। তার সামান্য চোখের পানি দেখে হঠাৎ আমার হৃদয় ভালবাসায়, মমতায় আর্দ্র হয়ে উঠলো । এই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তার মতো অসাধারণ মানুষ আর একজনও নেই। আনিসের দিকে একবার তাকালাম, কেন যেন মনে হলো সেও ঠিক আমার মতো করেই ভাবছে।। দিনটা শুরু হয়েছিল ভীষণ বিশ্রীভাবে তবে তার শেষটা তত খারাপ না। কি ভীষণ রহস্যময়, একই সাথে জটিল এই স্বামী – স্ত্রীর সম্পর্কগুলো। কি দ্রুত এর রঙ বদলায় !! ভদ্রলোক খাওয়া বন্ধ রেখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটো ভেঁজা।। আমি তার চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললাম, কি অদ্ভুত, তাই না!!??

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত