আজ ধর্ষকের ফাঁসি হবে। ঠিক রাত ১০টা ১ মিনিটে। উৎসুক জনতা টেলিভিশনের সামনে বসে আছে সর্বশেষ খবর জানার জন্য। আমিও বসে আছি শয়তানটার মৃত্যুর খবর শুনবো বলে। কলঙ্কিত দানবটার মৃত্যু না হওয়ার আগ পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু হৃদয়ের এক কোণে ঐ দানবটার জন্য মায়া হচ্ছিল। সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এটাই কি মায়া হওয়ার কারণ?
আমি জিয়ানকে পাঁচ বছর ধরে চিনি। কোনোদিন ওকে কোনো মেয়ে সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে শুনিনি। কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক করতেও দেখিনি। তাহলে এই ছেলেটা হঠাৎ করেই ধর্ষণের মত জঘন্য কাজ করতে যাবে কেনো?
চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলাম ওর রুমে। ঘটনার পর থেকে ঘৃণায় ওর রুমে যাইনি। ওর ডায়েরিটা খুঁজতে লাগলাম। ওর একটা অভ্যেস হলো প্রতিদিনের ঘটনা ডায়েরিতে লিখে রাখে। সর্বশেষ লেখাটার শিরোনাম দেখে আমার চোখ আটকে যায়। শিরোনাম ছিলো- “আমাকে হত্যা করো”। আমি ভিতরের লেখাটা পড়তে লাগলাম। সেখানে ঠিক এরকম লেখা ছিল– “আজ আমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল কাজটা করেছি। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম পাপটা আমি করেছি। একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করেছি। একটি পরিবারের সুখ কেড়ে নিয়েছি। জাতির বিবেক ধ্বসিয়ে দিয়েছি। আমাকে হত্যা করা উচিত। জন সম্মুখে পাথর মেরে মেরে নির্দয়ের মত মেরে ফেলা উচিত। তবে বিচার কেবল আমার একার হবে কেনো? যারা আমাকে এই কাজে সহযোগিতা করেছে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। আমি জানি যাদের বিপক্ষে আমি অভিযোগ আনবো তা মিডিয়ায় প্রচার করা হবে না। তাই ডায়রীর পাতায় লিপিবদ্ধ করে গেলাম।
আমি উঠতি যুবক। তাই নারীর সৌন্দর্য আমাকে চৌম্বকের মত আকর্ষণ করে। পত্রিকা পড়ার সময় বিনোদনের পাতায় আমার চোখ আটকে যায়। যেখানে মেয়েদের অশ্লীল ছবি থাকে। আবার সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে মেয়েদের অর্ধ নগ্ন ছবি দিয়ে ম্যাগাজিন বের হয়। দেখার সাথে সাথে আমার সারা দেহ কেঁপে ওঠে। দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেলি। মোবাইলে ডাটা অন করার সাথে সাথেই শত শত নটিফিকেশন আসে, অমুক নায়িকার গোপন ভিডিও ফাঁস, তমুকের অন্তরঙ্গ ছবি… ইত্যাদি। ইউটিউবে বা অন্যান্য সফটওয়্যারে ঢুকলেই অগনিত অশ্লীল ভিডিও চলে আসে। যা থেকে আমার মত যুবক ছেলের বেঁচে থাকা কঠিন। কোনো গানের ভিডিও ওপেন করলেও সেখানে নায়ক নায়িকার একান্ত মূহুর্তের দৃশ্য দেখায়। আর টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে অর্ধ নগ্ন মেয়ের শরীর না দেখালে মনে হয় পণ্য বিক্রি হয় না।
এসব আপত্তিকর দৃশ্য দেখে দেখেই আমার চরিত্রটা ধীরে ধীরে নষ্ট হতে লাগলো। আজ একটা লোকাল বাসে করে আসছিলাম। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তখন আমার গা ঘেঁষেই একটা অপরূপা সুন্দরী মেয়ে এসে দাঁড়ালো। লোকের ভীড় বেশি থাকায় আমি সড়তেও পারছি না। নরম দেহের স্পর্শ পাওয়ায় আমার ভেতরের অমানুষটা জেগে উঠতে লাগলো। নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। মেয়েটির পেছনে পেছনে আমিও নেমে পরলাম। নির্জন জায়গা বেচে নিয়ে বিশাল অন্যায় কাজটা করে ফেললাম। এই কথাগুলো লিখতে যেয়ে আমি অনেক কাঁদছি। অনেক অনুতপ্ত হচ্ছি। যে ভুল আমি করেছি, আমার একটা মৃত্যুই কি এর উপযুক্ত সাজা হবে? জানি না। তাই আমিই আমার ফাঁসি চাই। সেই সাথে আমার সহযোগীদের বিচার চাই।”
লেখাটা পড়তে পড়তে কখন যে আমার চোখের কোণে পানি এসে ভীড় করেছে জানি না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ১০টা ১ বাজে। তারমানে এখনই জিয়ানের ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে। আমার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝড়ছে। তবুও আমি চাই ওর ফাঁসি কার্যকর হোক। কারণ আখেরাতের শাস্তির তুলনায় দুনিয়ার শাস্তি কিছুই না। টেলিভিশনে ফলাও করে দেখানো হচ্ছে জিয়ানের মৃত্যুর খবর। জিয়ান একটা কথা সত্যিই লিখেছে- তার সহযোগীদের নাম মিডিয়া প্রচার করছে না। চ্যানেলগুলোতে সংবাদ বিরতিতে চলছে অর্ধ নগ্ন বিজ্ঞাপনও। মোবাইলে ডাটা অন করার সাহস পেলাম না। হয়ত এখনই নটিফিকেশনে ভেসে আসবে অশ্লীলতার হাতছানি। অ্যাপসে ঢুকলেই চলে আসবে আপত্তিকর সব ভিডিও।
পরদিন বড় শিরোনামে জিয়ানের ফাঁসির সংবাদ ছাপানো হলো। সম্পাদকীয় কলামে গুরু জনদের অনেক বাণী দেখা গেলো। সেই সাথে বিনোদনের পাতাতেও অশ্লীল ছবিতে ভরপুর। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে হয়তো অশ্লীল ছবিতে ম্যাগাজিন ছাপাতেও ভুল করবে না।
আবারো ওর ডায়েরিটা হাতে নিলাম। ঘটনাটির শেষ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলাম একটি প্রশ্ন লিখা রয়েছে– “কে আছো, ধর্ষণের এই নীরব উৎস গুলো চিরতরে বন্ধ করবে? বেঁচে যাবে হাজারো জিয়ান, বেঁচে থাকবে হাজারো মেয়ের সম্মান!”