নিয়তির লেখা

নিয়তির লেখা

যেদিন হৃদয় স্যালারি পেয়ে সরাসরি মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের হাতে সবটা টাকা তুলে দিলো,, সেদিন ওর মা, আর আমি, উভয়ের চোখেই পানি ছিলো,, ওর মায়ের চোখে ছিলো খুশির পানি, আর আমার চোখে ক্রোধের! শুধু স্যালারি নয়,, ঘুম থেকে উঠে বাবা- মায়ের ঘরে গিয়ে বাবা- মা কে সালাম করা,, মা বাবার সঙ্গে রাত জেগে গল্প করা,, শপিং-এ গেলে মা-বাবার জন্য সবচেয়ে দামী কাপড় কেনা,, ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে গেলে বাবা-মাকেও সাথে করে নিয়ে যাওয়া,, এসব দেখতে দেখতে কেমন যেন তাদের প্রতি ঈর্ষাবোধ কাজ করতো…আমাদের ৫ বছরের ছেলে রাইয়ানও সারাক্ষণ দাদা-দাদী ডেকে ডেকে সারা বাড়ি মাথায় তোলে।

তাদের নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে বুঝতাম না মায়ের একটু জ্বর এলে যেন নিজেই অসুস্থ হয়ে যেত,, ডাক্তার ডেকে আনতো একটু কিছুতেই। একদিন রাগ করে শাশুড়ী মাকে বললাম,, “এতো বয়স হয়েছে তবুও এতো বিলাসিতা কেন??” হৃদয় আচমকাই আমায় চড় মেরে ফ্লোরে ফেলে দিলো, আর বললো- “খবরদার,,আমার বাবা মায়ের সাথে নেক্সট টাইম এমন বিহেইভ করলে আমি ভুলে যাবো যে তুমি আমার স্ত্রী..! আমার বাবা-মা আমার সব। তোমার প্রতি ভালোবাসা, আর বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসা উভয়েই সমান গভীর ও সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সুতরাং ভালোবাসাকে তুলনা দিয়ে সম্পর্কে ভাঙন ধরিও না।” অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ওর সাথে ৪ বছর রিলেশনের পর বিয়ে হয়েছে, এর আগে কোনোদিন কোনোকিছুতে আমার গায়ে হাত তোলে নি, গায়ে হাত তোলা তো দূর,, ধমকও দেয় নি, সেই হৃদয় আমায় মারলো, ভাবতেই দু-চোখে বাধ – ভাঙা জোয়ার নেমে এলো। পরে হৃদয় আমায় সরি বলেছে,, আমার দুহাত ওর বুকে নিয়ে বলেছে,, “প্লিজ আমার বাবা মা কে কখনো কষ্ট দিও না,, তুমি তো আমার জীবন, আর তারা আমার জীবনের চেয়েও বেশি কিছু।” সবকিছুই আমাদের ছেলের সামনে হয়েছিলো,, আর ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। এরপর থেকে আর কখনো শ্বশুর -শ্বাশুড়ীর সাথে খারাপ ব্যবহার করি নি।

আজ ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আমি বৃদ্ধা হয়েছি,, হৃদয়ও রিটায়ার্ড করে অবসরে আছে। আমাদের ছেলে এখন ব্যাংকে জব করে, প্রিন্সিপাল অফিসার। ছেলেটাও ৫ বছর প্রেম করেই বিয়ে করেছে,,কোনো আপত্তি করি নি। ছেলেটা হয়েছে একদম ওর বাবার মতো। স্যালারি পেয়ে আজও আমার ছেলেটা আমার হাতেই টাকা দেয়,, আমার সাথে গল্প করে,, কোথাও বেড়াতে গেলেও আমায় আর হৃদয়কে সাথে করে নিয়ে যায়,, আমরা একটু অসুস্থ হলেই ডাক্তার ডেকে আনে। আর আমাদের নাতি রেদওয়ান,, সে তো দাদা – দাদী বলতে পাগল।

কতো সুখে দিন কাটছে আমাদের। এ বৃদ্ধ বয়সও যেন জীবনের স্বর্ণালী সময়। বারান্দার ইজিচেয়ারটাতে বসে মনে মনে ভাবছি, কেন যে তখন ওর বাবা মায়ের প্রতি এতো হিংসা করতাম, জীবন মানুষকে সবই ফীরে দেয়, প্রতিটা কাজেরই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেদিন হৃদয় আমায় শাসন করে সঠিক পথে না আনলে আজ হয়তো আমিও আমার ছেলের থেকে এতো ভালোবাসা পেতাম না, হয়তো বা আমার আর হৃদয়ের জায়গা হতো বৃদ্ধাশ্রমে।

চোখের পানি মুছে ইজিচেয়ার থেকে উঠে ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম, ঘরে ঢোকার আগেই ছেলের চোখে পানি দেখে থমকে গেলাম,, দেখলাম,, ও বৌমার হাত দুটো ওর বুকে নিয়ে বলছে- “প্লিজ আমার বাবা-মা কে কখনো কষ্ট দিও না,, তুমি তো আমার জীবন, কিন্তু তারা আমার জীবনের চেয়েও বেশি কিছু..।”

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত